উসমান বিন আব্দুল আলিম।।
আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। আমরা বাংলায় কথা বলি। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই মাতৃভাষার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছি। মাতৃভাষা রক্ষার রক্তের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি; বাংলায় ১৩৫৮ সনের ৮ ফাল্গুন- এদিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারাকে উপেক্ষা করে রাজপথে মিছিলে বের হয়। পাকিস্তানি প্রশাসন তাদের ওপর গুলি বর্ষণ চালায়। এতে সালাম, রফিক, বরকত, জাব্বার ও মশিউরসহ অনেকে মারা যান। তাদের রক্তের বিনিময়েই এদেশে মায়ের ভাষা বাংলা হয়েছে। মানুষ পেয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। এ দিবসটি আমাদের জাতীয় অঙ্গনে বিশেষ মর্যাদা হিসেবে স্বীকৃত পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা দিবস।
মাতৃভাষা আল্লাহর দান
মাতৃভাষা আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা নিজেই মানুষ সৃষ্টি করে তাদের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিখিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'করুণাময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা।' (সুরা রহমান: ১-৪) আয়াতে 'বর্ণনা' বা 'বয়ান' দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ভাষা। আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতের মধ্য থেকে ভাষা বড় নেয়ামত- যা আল্লাহ আমাদের দান করেছেন।
ভাষার গুরুত্ব
আল্লাহ প্রত্যেক নবী-রাসুলকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁরা নিজ জাতির ভাষায় মানুষকে আল্লাহর একাত্ববাদের দিকে আহ্বান করতেন। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি আসমানি কিতাবও ওই জাতির ভাষায় নাজিল করেছেন, যাদের কাছে তিনি কিতাব পাঠিয়েছেন। কোরআনুল কারিম পাঠিয়েছেন আরব জাতির ওপর। আর আরবরা ছিলেন আরবি ভাষী। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (তাদের উম্মতদের) পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে।' (সুরা ইবরাহিম)
ভাষার বৈচিত্র আল্লাহর নিদর্শন
এই পৃথিবীতে যেই ভাষার বৈচিত্র্য, তা আল্লাহ তাআলার কুদরতের মধ্য হতে একটি কুদরত। পৃথিবীর সাড়ে সাত কোটি বেশি মানুষের ভাষা আছে সাত হাজারের বেশি। এই মানুষেরা সাত হাজারের বেশি ভাষায় কথা বলে।
এই ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর নির্দশন। আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এসব ভাষা। আল্লাহ তাআলা বলেন, দাঁতার নিদর্শনের মধ্যে হলো আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা। জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই এতে আছে বহু নিদর্শন।' (সুরা রুম : ২২) আয়াত থেকে বোঝা যায়, এক. মাতৃভাষা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা; এটা মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। দুই. মাতৃভাষা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত। তিন. এটা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন।
আমরা দেখি যে ভাষা শহিদদের অধিকাংশই মুসলিম। তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, একজন মুসলমান হিসেবে অপর মৃত মুসলমান ভাইয়ের জন্য আমাদের কর্তব্য কী! যারা ভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন, তারা আমাদের গর্বের ধন। আমাদের গৌরবের প্রতীক। তাদের স্মরণে আমরা কী করব আর কী বর্জন করব সেটা ভাবার বিষয়। আমরা মুসলমান হিসেবে তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করব। তাদের কল্যাণ কামনা করব। আমরা মোটদাগে তাদের জন্য যা কিছু করব-
ভাষা শহিদদের জন্য আমাদের করণীয়
এক. তাদের জন্য বেশি বেশি মাগফেরাত কামনা করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, 'যখন মানুষ মারা যায় তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমলের ফায়দা ভোগ করে— এক. সদকায়ে জারিয়া। দুই. এমন জ্ঞান – যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। তিন. ওই সুসন্তান— যে তার জন্য দোয়া করে।' (মুসলিম: ১৬৩১)
দুই. তাদের জন্য বেশি বেশি ইসালে সওয়াবের (নেক আমল পাঠানো) ব্যবস্থা করা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, 'সাদ ইবনে উবাদা (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার কোনো উপকারে আসবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। সাদ (রা.) বলেন, 'আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার 'মিখরাফ' নামক বাগানটি আমার মায়ের জন্য সদকা করে দিলাম। ' (বুখারি: ২৭৫৬)
তিন. সাধ্যমতো শহিদদের কবর জিয়ারত করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, 'আমি এর আগে তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন থেকে অনুমতি দিলাম, তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা তা তোমাদের দুনিয়া বিমুখ করে এবং পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়।' (ইবনে মাজাহ: ১৫৭১)
একজন মৃত মুসলমান জীবিত মুসলমানদের কাছে ইসালে সওয়াবের অধিকার রাখেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা মুসলমান হিসেবে আমাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছি না। তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করছি না। রাসুল (সা.)-ও মৃত ও শহিদ সাহাবিদের স্মরণে দোয়া করেছেন। তাদের মাগফেরাত কামনা করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, 'তোমরা তোমাদের ঘরকে কবর বানিয়ো না। আমার কবরকে তোমরা উৎসবের কেন্দ্র বানিয়ো না।' (আবু দাউদ: ২০৪২)
মুসলমানরা এখন এমনসব আমল করছেন, যেগুলো আল্লাহর রাসুল (সা.) করেননি। সাহাবি ও পূরবর্তী ঈমানদাররা করেনি। সুতরাং আমাদেরও ইসলাম অসমর্থিত কোনো কাজ করা উচিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'কোনো ব্যক্তি সংস্কৃতিতে যে সম্প্রদায়ের অনুসরণ করে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।' (আবু দাউদ: ৫৪৪৪) আরেক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'কেউ যদি আমাদের এ দ্বীনে এমন কিছু সংযোজন করে, যা দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত।' (বুখারি: ২৬৯৭)
আমরা আমাদের শহিদ ভাইদের জন্য কোরআন খতম করব। বেশি বেশি ইস্তেগফার করব। মসজিদে মসজিদে বা ব্যক্তিগতভাবে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করব এবং সামর্থ্য থাকলে তাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া করব।
-এটি