আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি
আমার হযরত (ডা. আবদুল হাই আরেফী) রাহ. বলতেন- আল্লাহ তাআলা বড়ই দয়ালু ও মেহেরবান। মা-বাবার চেয়েও বহুগুণে বেশি। অতএব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট নিঃসঙ্কোচে চাইতে থাক।
এভাবে বল যে, আয় আল্লাহ! আপনি দুনিয়াতে আমাকে ভালো কাজ করার তাওফীক দিন অথবা আখেরাতের পাকড়াও থেকে রেহাই দিন। আমি আপনার দরবারে আমার সার্বিক বিষয় অর্পণ করছি। আপনি আমার হালত দুরস্ত করে দিন, আমাকে ইসলাহ করে দিন অথবা আখেরাতের আযাব থেকে মুক্তি দিন। এভাবে আল্লাহর কাছে চাইতে থাক।
মানুষ এগুলোকে মামুলি বিষয় মনে করে। এজন্য এর প্রতি এত গরজ করে না। কিন্তু বাস্তবতা হল, ইসলাহের জন্য এটা অনেক মুফীদ ও উপকারী একটি মাধ্যম। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার নিকট সবসময় নাছোড়বান্দা হয়ে চাইতে থাকা।
আর যে ব্যক্তি এভাবে নিয়মিত দুআ করে সে অবশ্য নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টাও অব্যাহত রাখে। এজন্য দুআর অর্থ কখনও এই নয় যে, শুধু দুআই করে যাব। চেষ্টা, মেহনত-মোজাহাদা কোনো কিছুই আর করা লাগবে না!
বরং আল্লাহ তাআলা সর্বক্ষেত্রে এ হুকুম দিয়েছেন যে, তুমি তোমার পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা মেহনত কর এবং আমার কাছে দুআ কর। চেষ্টাও অব্যাহত রাখ এবং দুআও করতে থাক। তো যে এভাবে চেষ্টা ও দুআ একসাথে জারি রাখবে, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার মোআমালা বা আচরণ হল- আল্লাহ তাআলা একে আযাব দিবেন না। আল্লাহ তাআলা তাকে গুনাহ ও নাফরমানী থেকে হেফাযত করবেন। নতুবা কম সে কম তাকে মাফ করে দিবেন।
একটি শিক্ষণীয় ঘটনা
আমি আপনাদেরকে একটি ঘটনা শোনাই। ঘটনাটি আমার নিজের সাথেই ঘটেছে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে জার্মান থেকে আমার কাছে এক ব্যক্তির একটি চিঠি আসে। সে মূলত পাকিস্তানী। পরবর্তীতে জার্মানের নাগরিক হয়ে গেছে। তার নামটা এখনও আমার মনে আছে- আবদুল লতীফ। সে চিঠিতে উল্লেখ করে- আমি রুটিরুজির তালাশে পাকিস্তান থেকে জার্মান চলে আসি।
তখন ধর্মকর্মের প্রতি আমার আগ্রহ-আকর্ষণ কিছুই ছিল না। নামায-রোযা বা অন্য কোনো দ্বীনী বিষয়ের প্রতি আমার কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। ব্যস ¯ পেটের দায়ে পাকিস্তান ছেড়ে জার্মানে পাড়ি জমাই এবং এখানেই স্থায়ী হয়ে যাই। এখানে থাকতে থাকতে জার্মানি এক মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। তখন দ্বীন-ঈমানের প্রতি আমার মোটেও তাওয়াজ্জুহ ছিল না। নামায-রোযা, যাকাত, কুরবানী কোনো বিষয়ে কোনো খবর নেই। একেবারে বে-লাগাম চলতে থাকি। আমাদের মাঝে সম্পর্ক আরো গভীর হতে থাকে। একপর্যায়ে আমরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হই এবং আমি ওরকমই উদাস জীবন যাপন করতে থাকি। আমাদের ঘর-সংসার যথারীতি চলতে থাকে। কিছুদিন পর আমি এক পুত্রসন্তানের পিতা হই।
ছেলে আমার ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। যখন তার কিছুটা পড়ার বয়স হয়, দেখি তার মা তাকে ঈসায়ী ধর্মমতের দীক্ষায় বড় করছে। এ দেখে আচানক আমার ভেতর থেকে একটি মুসলিম সত্তা জেগে ওঠে। গায়রত যেন আমার পুরো দেহটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তোলে- আরে! এ তোর সন্তান হয়ে এখন কি না ঈসায়ী দীক্ষা গ্রহণ করছে! ঐদিন থেকে আমি আমাকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করছি। আমি সংকল্প করলাম, আমি ওকে এ থেকে অবশ্যই বিরত রাখব। আমি ওর মাকে বললাম, এ আমার ছেলে। তুমি একে তোমার মনমত খ্রিস্টধর্ম অনুসারে শিক্ষা দিতে পার না।
সে আমাকে পাল্টা জবাবে বলে, কেন আমি তাকে শেখাব না? সে আমারও সন্তান। আমি আমার নিকট যা সত্য ও সঠিক মনে করি আমার ছেলেকে তা অবশ্যই শেখাব। তুমি আমাকে এতে কোনোভাবেই বাধা দিতে পার না। আমি তাকে বললাম- না, তোমার ধর্ম সঠিক নয়; আমার ধর্মই সঠিক। সে আমাকে বলে, তোমার ধর্ম কেন সঠিক? আমাকে বুঝিয়ে বল। এখন যখন ধর্ম নিয়ে তার সাথে আলোচনা শুরু হল, দেখি যে, খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তো তার যথেষ্ট ধারণা রয়েছে; কিন্তু আমি তো আমার ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। ফল এই দাঁড়াল যে, ধর্ম বিষয়ে যখনই বিতর্ক হয় সে জিতে যায় আর আমি কোনো কিছুই বলতে পারি না। এভাবেই এখন সংসার চলছে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আমি নামায-রোযার প্রতি কিছুটা মনোযোগী হই। কিছুটা ধর্ম পালন শুরু করি। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি তার সাথে আর পেরে উঠি না। হযরত! সে আমার সন্তানের জীবন ধ্বংস করছে। তাকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে। আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন।
এ চিঠি আমার নিকট পৌঁছে। আমি আল্লাহর কাছে দুআ করি- আল্লাহ, বেচারা কঠিন মসিবতে ফেঁসে আছে। আপনি আমার মনে এরকম কোনো মশওয়ারা ঢেলে দিন, যাতে এর একটি সুরাহা হয়।
(এভাবে দুআ-দরূদ পড়ে) আমি তার কাছে জবাবী পত্র লিখি- খ্রিস্টবাদ বিষয়ে আমার একটা কিতাব রয়েছে। উর্দুতে ‘ঈসাইয়্যত কেয়া হ্যায়’ নামে আর ইংরেজিতে ডযধঃ ওং ঈযৎরংঃরধহরঃু নামে (এবং বাংলায় ‘খৃস্টধর্মের স্বরূপ’ নামে) প্রকাশিত হয়েছে। আপনি নিজ থেকে তার সাথে এ বিষয়ে কোনো বিতর্কে জড়াবেন না। কারণ বিতর্কে তেমন ফল হয় না। বিশেষ করে যখন ধর্ম সম্পর্কে আপনি তেমন কিছুই জানেন না।
এজন্য আমার পরামর্শ হল- আপনি তাকে যেভাবে পারেন দুটি কাজ করতে প্রস্তুত করুন। এক. আমি এ কিতাবটি পাঠাচ্ছি। আপনি তাকে এটা পড়ার অনুরোধ করুন। দুই. তাকে বলুন যে, তুমিও আল্লাহকে বিশ্বাস কর আমিও আল্লাহকে বিশ্বাস করি। তুমি প্রতি রাতে উঠে আল্লাহর কাছে এভাবে দুআ কর যে, আয় আল্লাহ! যদি ঈসায়ী ধর্ম সত্য হয়, তাহলে আমি যেন তাতে অবিচল থাকি। আর যদি ইসলাম ধর্ম সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এর সত্যতা আমার অন্তরে গেঁথে দিন এবং তা মেনে নেওয়া আমার জন্য সহজ করে দিন। এভাবে তাকে দুআ করার জন্য প্রস্তুত করুন।
কয়েকদিন পর তার দ্বিতীয় পত্র আসে, হযরত! সে কাজ দুটি করতে রাজি হয়েছে। আপনার কিতাব পড়া শুরু করে দিয়েছে এবং রাতে উঠে উঠে দুআও করছে। কিন্তু এখনও কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। আগে যেমন ছিল তেমনি আছে। ইসলামের প্রতি সে কোনো আকর্ষণ বোধ করছে না।
আমি এর জবাবে লিখি, ‘ঘাবড়াবেন না। তাকে বলবেন, সে যেন দুআ অব্যাহত রাখে। বাদ না দেয়।’ আমিও আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকি যে, আয় আল্লাহ! তুমি তার মনে সত্য ঢেলে দাও।
কয়েকদিন পর তার তৃতীয় চিঠি আসে। সে লেখে, মাওলানা! আপনি আল্লাহকে হয়ত দলীল-প্রমাণের আলোকে চিনেছেন। কিন্তু আমি আল্লাহকে চোখে দেখে ফেলেছি। গতকালের ঘটনা; আমার স্ত্রী তার ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল। আমিও তার সাথে ছিলাম।
ইউনিভার্সিটির কাজ শেষ করে আমরা যখন ফিরছিলাম, সে গাড়ী ড্রাইভ করছিল। চালাতে চালাতে সে গাড়ী হঠাৎ সাইডে নিয়ে ব্রেক করল। স্টিয়ারিংয়ের উপর মুখ রেখে কাঁদতে আরম্ভ করল। আমি ভাবতে লাগলাম, খোদা না খাস্তা আবার হার্টে সমস্যা হল কি না। হার্টবিট বেড়ে যাওয়ায় হয়ত গাড়ী থামিয়ে দিয়েছে এবং এভাবে কাঁদছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- কী সমস্যা? কী হল? এতে যেন তার কান্না আরো বেড়ে গেল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল সে। আমি ভড়কে গেলাম। বললাম, আরে বল তো কী হয়েছে?
সে কাঁদতে কাঁদতে বহু কষ্টে শুধু এতটুকু বলল- না, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাকে কোথাও নিয়ে তাড়াতাড়ি মুসলমান বানিয়ে নাও। আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না- এ কি সেই মেয়ে, যে আমার সাথে ইসলাম নিয়ে বিতর্ক করত! আর আজ কিনা সেই মেয়েই বলছে- ‘আমাকে মুসলমান বানিয়ে নাও’! আমি তড়িৎ গাড়ী ড্রাইভ করে নিকটতম ইসলামিক সেন্টারে তাকে নিয়ে গেলাম। আলহামদু লিল্লাহ, সেখানে সে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়েছে।
ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। গত রাত পয়লা রমযানের রাত ছিল। আমরা উভয়ে আজ সাহরী খেয়েছি এবং আজ এই প্রথম দিন, যেদিন আমরা উভয়ে একসাথে রোযা রাখছি।
এ তো ছিল আবদুল লতীফের চিঠি। দ্বিতীয় আরেকটি চিঠি ছিল তার স্ত্রীর। সে তাতে লিখেছে, আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি। আপনি আমাকে এমন পথের সন্ধান দিয়েছেন, যা আমার সামনে সত্য উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। এখন আপনি বলে দিন- আগামীতে আমি কীভাবে চলব?
তো যা বলছিলাম, আল্লাহ তাআলার কাছে যদি কিছু চাওয়া হয়, বিশেষ করে যদি হেদায়েত চাওয়া হয় এবং দ্বীনের উপর চলার তাওফীক চাওয়া হয়, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি মোতাবেক যিন্দেগী তলব করা হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তা দান করবেন।
খোলাসা কথা হল, ব্যস, রাস্তা একটাই। নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করতে থাকুন এবং চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার নিকট নেক কাজের এবং ইসলাহের তাওফীক ও মদদ চাইতে থাকুন। তারপর দেখুন, আল্লাহ তাআলা কীভাবে আপনাকে সাহায্য করেন! কীভাবে তাওফীকে এলাহী আপনার শামিলে হাল হয়! আল্লাহ তাআলা আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন। (দ্র. ইসলাহী খুতুবাত, ১৮/৭৮-৮৪)
-এটি