আবদুল্লাহ তামিম ♦
একজন হিন্দু রাজমিস্ত্রী তৈরি করেছে এ ঐতিহাসিক মসজিদ। আমরা কথা বলছিলাম যে মসজিদ প্রায় দেড়শ বছর আগের পুরানো স্থাপত্যশৈলীর মুসলিম নিদর্শন বহন করে আছে। সৈয়দপুরের বিখ্যাত ‘চিনি মসজিদ’ বা ‘চীনা মসজিদের’।
নাম শুনে সবার মত আমার মনেও প্রথম এ প্রশ্নটাই এসেছিল। আসলে কি এই মসজিদ চীনাদের করা? নাহ, আসলে মসজিদের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য মসজিদের দেয়ালে চিনামাটির থালার ভগ্নাংশ বা কাচের ভগ্নাংশ বসানো হয় যেন দেয়াল স্পর্শ করলে আপনি চিনির মত দানাদার একটা কিছু স্পর্শ করার অনুভূতি পাবেন।এধরনের স্থাপত্য-লোকে স্থানীয় ভাবে বলা হয়ে থাকে “চিনি করা” বা “চিনি দানার কাজ করা”। আর এ কারণেই এ মসজিদের নাম হয়ে গেছে চিনি মসজিদ প্রকারান্তরে চীনা মসজিদ।
ইতিহাস এর পরীক্ষায় অংশ নেয়া অনেক কঠিন হলেও কোন ঐতিহাসিক স্থান চোখের সামনে দেখা এবং সে বিষয়ে জানা কিন্তু ঠিক তার উলটো বরং সেই ঐতিহাসিক স্থান দেখার পর নিজ থেকেই যেন আগ্রহ জাগে এর পেছনের কথা জানার।
আজ থেকে দেড়শ বছর আগে ১৮৮৩ সালে হাজী বাকের আলী এবং হাজী মুকছুন নামে দুই ব্যক্তি সৈয়দপুর এর ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথম মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরে এলাকার লোকেরা মসজিদটি স্থায়ীভাবে নির্মাণের জন্য তহবিল গঠন করে। জনশ্রুতি আছে মসজিদের উন্নয়নের জন্য এলাকাবাসীরা স্বেচ্ছায় তাদের পুরো এক মাসের উপার্জন বা বেতন দান করেছিল।
১৯২০ সালে হাজী হাজি আব্দুল করিমের উদ্যোগে মসজিদটিকে প্রথম পাকা করা হয়। শংকু নামক একজন হিন্দু রাজমিস্ত্রি দৈনিক ১০ আনা মজুরীতে মসজিদটির স্থাপত্যশিল্পে কাজ করেছিলেন।
একজন হিন্দু’র ঘাম দিয়ে তৈরি আজকের এই ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ। মসজিদটির স্থপতি হিসেবে মোঃ মখতুল এবং নবী বক্সের নাম প্রচলিত আছে। এই দুইজনের তত্ত্বাবধানে নিজের সবটুকু মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে এ অসাধারণ ডিজাইনকে বাস্তবে রুপ দেন শংকু।
হাল আমলের মসজিদগুলোতে স্থাপত্যশৈলী তেমন একটা প্রাধান্য না পেলেও কেন আগের আমলের মসজিদ গুলােতে সেটার একটা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ সহজ ভাবে বললে আগের দিনের মসজিদ গুলাে কেন এত সুন্দর? সেক্ষেত্রে বাঙ্গালীর কমন থিওরি “ওল্ড ইজ গোল্ড” এর হিসেব বাদ দিলেও আরও কিছু বিষয় চলে আসে যেমন সে সময়টায় ইসলাম উপমহাদেশে কেবল প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে।
ফলে সুন্দর উপাসনালয় স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করার একটা বিষয় যেমন ছিল তেমনি ভাবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে তখনকার মানুষ গুলো মনের দিক থেকেও ছিল অনেক উদার। তা না হলে মসজিদ নির্মাণের জন্য নিজের পুরো উপার্জন দিয়ে দেওয়ার মত মানুষ মনে হয় না এ যুগে তেমন একটা পাওয়া যাবে।
আর তাই তো তখনকার স্থাপত্যশৈলী গুলো যে শুধু দেখতেই সুন্দর তা নয় এর মাঝে কেমন যেন একটা মায়ার উপস্থিতি ও লক্ষ্য করা যায় কেন না এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের আবেগ, ভালবাসা।
চিনি মসজিদ নির্মাণে মুঘল স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। মসজিদে ঢোকার শুরুতেই সুন্দর কারুকার্য মণ্ডিত মূল ফটকে চোখে পড়বে ফারসি বা উর্দুতে লেখা “চিনি মসজিদ”। মসজিদের আশেপাশে প্রচুর বিহারী থাকার সুবাদে লেখাটি উর্দু হবার সম্ভাবনাই বেশী আবার কাছেই একটি প্রাচীন ইমামবাড়া থাকায় ফারসি হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মসজিদটির প্রথম অংশটির কাজ শুরু হয় ১৯২০ সালে এবং দক্ষিণ দিকের দ্বিতীয় অংশের কাজ করা হয় ১৯৬৫ সালে অর্থাৎ দেশভাগের পর। মুসল্লিদের প্রবেশের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি দরজা আর দোতলায় রয়েছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা যদিও সেটা মূলত মসজিদের খাদেমদের থাকার জন্যই এখন ববহৃত হচ্ছে।
চিনি মসজিদের মূল সৌন্দর্য মসজিদের দেয়াল জুড়ে। ফুলদানি, ফুলের-ঝাড়, গােলাপফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ-তারা সহ অসংখ্য কারুকাজ মসজিদের পুরাে দেয়ালজুড়ে খচিত। এছাড়াও রয়েছে তৎকালীন আরবীয় ক্যালিপট্রা।
১৯৬৫ সালে মসজিদের এই চীনামাটির কাজের জন্য বগুড়ার একটি ফ্যাক্টরি ২৫ চীনামাটির পাথর দান করেছিল। এছাড়া কলকাতা থেকে আনা হয় ২৪৩ টি সুবিশাল মর্মর পাথর যা দিয়েই মোড়ানো হয় মসজিদটির ৩২ টি মিনার সহ ৩ টি বড় গম্বুজ। মসজিদটির প্রাচীন অংশের বারান্দায় খিলানের ৮ টি কলামে মােজাইকের চমৎকার ফিনিশিং লক্ষ্য করা যায়।
২য় ও ৩য় ধাপে নির্মিত অংশের বারান্দার ফ্লোর সাদা সিমেন্ট দিয়ে নেট ফিনিশিং করা। আদি মসজিদ ও বর্ধিত অংশকে অতি সচেতন ভাবে একই রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হলেও একটু খেয়াল করলেই দুটোর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য ধরা পড়বে। আদি আংশটিতে একটু লালচে ভাব রয়েছে যা পুরানো হবার কারণেও হতে পারে।
আগেই বলেছি মসজিদটি দোতলা,উপরের তলায় থাকার ব্যবস্থা আর নিচের তলার প্রবেশ পথেই আযান দেবার মিম্বর। দোতলায় ওঠবার জন্য রয়েছে সরু শৈল্পিক সিঁড়ি। মসজিদটির ডানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বামে একটি ইমামবাড়া রয়েছে আর পশ্চিমে রয়েছে একটি খ্রিষ্টান কবরস্থান। মসজিদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে রয়েছে মসজিদের গাঁ ঘেঁষে ১২ টি দোকান ঘর যা দিয়ে মসজিদের সকল ব্যয় ও উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড চলে।
-এটি