আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ইতিহাসবিদ, আরবি ভাষা বিজ্ঞানীর পাশপাশি সীরাত গবেষক হিসেবে আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর খ্যাতি উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আরব, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের হৃদয়ে বহুমাত্রিক প্রতিভার কারণে স্থায়ী আসন পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহুল প্রচলিত ভাষায় অনুদিত হয়ে ইসলামী সংস্কৃতি, দাওয়াত ও তাবলিগের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টিতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার বিজয়ী শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ জ্ঞানতাপসের রচনাশৈলী, অপূর্ব বাক্যবিন্যাস, বর্ণনার সৌকর্য, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপকতা ও বিষয়বস্তুর নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মুসলমানদের প্রাণে নতুন স্পন্দন সৃষ্টি করে। বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবনাদর্শের আলোকে মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আনতে তাঁর কলম ছিল সদা সোচ্চার।
তিনি ‘আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’ গ্রন্থটি নব প্রজন্মের মন মানসিকতা, যুগজিজ্ঞাসা, ও সমকালীন সমস্যার চাহিদা পূরণের উপযোগী করে তৈরি করেন। গ্রন্থনা, তত্ত্ব সমন্বয়, বর্ণনারীতি ও তথ্যসূত্র ব্যবহারে আধুনিক প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, ফলে এ গ্রন্থটি আরব বিশ্বের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স হিসাবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। এ গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রাচীন ও আধুনিক তথ্যের অপূর্ব সমন্বয় ও সমাহার।
লেখক যেমন পবিত্র কুরআন, হাদীস, ইবনে হিশামের ‘সীরাতুন নাবাবিয়্যা’ ও ইবনুল কায়্যিমের ‘যাদুল মাআদ’ ইবনে জারীর ‘তাবারীর তারিখুল উমম ওয়াল মুলুক’ ইবনে সাআদের ‘তাবাকাত’, ইবনে কাসীরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ সহ নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেন তেমনি আধুনিক ইতিহাস গবেষক John Development এর Apology for Muhammad and Quran, Lecky এর History of the European Morals. R.V.C. Bodly রচিত The Messenger- The life of Muhammad, প্রফেসর Gibbon এর Decline and Fall of the Roman Empire, Encyclopedia of Ethics and Religion, Encyclopedia Britannica,New Catholie Encyclopedia Ges james mackinon রচিত From Christ to Constantine সহ ইউরোপীয় খ্যাতিমান লেখকদের গ্রন্থাদি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পান।
এতে সীরাতে রাসূলের ব্যাপকতা, আন্তর্জাতিকতা ও সর্বজনীনতার এক অনুপম মহিমান্বিত রূপ স্পষ্টতই ফুটে উঠে। লেখক তাঁর অতুলনীয় ভাষা শৈলী, যথার্থ শব্দ চয়ন, শব্দের নিপুন গাঁথুনি ও উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব দেখিয়ে রাহমাতুল লিল আলামীনের কালোত্তীর্ণ জীবন-দর্শন, আচার আচরণ, আখলাক আদাত, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দাওয়াত-তাবলীগ, সমাজ পরিবর্তনের মৌলিক নীতিমালাকে পাঠকের সামনেউপস্থাপন করেন পরিশীলিত আঙ্গিকে; এখানে তাঁর সার্থকতা নিহিত। মহানবী (সা.)-এর সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে আল্লামা নদভী আবেগ ও যুক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন। আবেগের আতিশয্যে যুক্তি যেমন নিষ্প্রভ হয়নি তেমনি যুক্তির অতিশয়োক্তির কাছে হৃদয় উৎসারিত আবেগও হারিয়ে যায়নি। জীবনীমূলক এ সীরাত গ্রন্থটি কেবল ঘটনা পরম্পরার নীরস ও নিষ্প্রাণ বিবরণের ভারে আকীর্ণ না হয়ে বরং বিশ্লেষণের প্রবহমান ফল্গুধারার সহজ, সাবলীল ও সুখপাঠ্য হয়েছে। আল্লামা নদভী (রহ.) এ গ্রন্থে পাশ্চাত্যের বিকারগ্রস্থ জীবন দর্শনের বীভৎসতার বিবরণী তুলে ধরে নবী জীবনের মহিমান্বিত আদর্শকে নানা জাতিগোষ্ঠীর ও মানব সম্প্রদায়ের হিদায়তের অতিমূল্যবান উপাদান হিসেবে চিত্রায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
‘আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’ গ্রন্থটির বৈচিত্র ও স্বাতন্ত্র্য হলো শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর রচনারীতির সাথে সমন্বিত করে এমন যৌক্তিক আঙ্গিকে পেশ করা হয়েছে যে, যা অধ্যয়ন করে যে কোন পক্ষপাতহীন ব্যক্তির অন্তরে মুহূর্তের মধ্যে মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি ধাবিত হয় আপনা আপনিই। আরবী ভাষায় রচিত এ সীরাত গ্রন্থটি ইতোমধ্যে উর্দূ, ইংরাজী, বাংলা, তুর্কী ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি ‘নবীয়ে রহমত’ নামে বাংলায় ভাষান্তর করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালনাধীন ইসলামী বিশ্বকোষের সাবেক পরিচালক মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী (রহ.)।
আল্লামা নদবী তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল’ (মা যা খাসিরাল আলাম বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন)ও সীরাতে রাসূলের আলোকে লিখিত। ৮টি অধ্যায়ের মধ্যে ৩টি সরাসরি সীরাত বিষয়ক; (ক) বিশ্বনবী (সা.)-এর আগমন পূর্বাবস্থা, (খ) বিশ্বনবী (সা.)-এর আবির্ভাবের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও (গ) মুসলমানদের নেতৃত্বের ও গৌরবের যুগ। এ গ্রন্থটি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসভূক্ত এবং এ পর্যন্ত ১৪টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
সীরাতে রাসূল, ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাস রচনায় আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) এক নতুন দৃষ্ঠিভঙ্গির জন্ম দেন, যা তাঁর একান্ত নিজস্ব হওয়ার কারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রথাগত ইতিহাস গ্রন্থনার বিপরীতে এক নবতর আঙ্গিকে ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতে, ইসলামের পথে ও ময়দানে কোন শূন্যতা নেই; ইসলামের ইতিহাস রচনা, সংকলন ও শ্রেণী বিন্যাসে শূন্যতা রয়েছে। এ শূন্যতা পূরণ হচ্ছে সময়ের জরুরী দাবী, গুরুত্বপূর্ণ দীনি ও বৃদ্ধিবৃত্তিক খিদমত। এ কাজের পূর্ণতার মাধ্যমে কেবল ইসলাহ ও দাওয়াতের ইতিহাস সংকলিত হবে না বরং প্রাসঙ্গিকভাবে মুসলমানদের যুক্তিচিন্তন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অধঃপতন ও বিবর্তনের ইতিহাস অস্থিত্বে এসে যাবে। মুসলমানদের প্রথম বিপ্লব ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ও ইসলামী দাওয়াতের ফল; আর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল উম্মতে মুহাম্মদীর অধঃপতন ও ইসলামের দাওয়াতী কর্মকান্ডে শৈথিল্য প্রদর্শনের পরিণতি। মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের চেতনা ও ইসলামের পথে প্রত্যাবর্তনের উদ্দীপনা ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে স্বীয় মর্যাদার কথা স্মরণ করে দিতে হবে; এ কথা তাদেরকে বলে দিতে হবে পৃথিবীকে নতুনভাবে বিনির্মাণ ও পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে মহানবী (সা.)-এর অনুসারীগণ একটি কার্যকর ও গতিশীল ফ্যাক্টর, মুসলমানরা চলমান কোন মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ নয়; কোন নাট্যমঞ্চের ভোজবাজিকরও নয়।’
পরিশেষে বলা যায়, যেসব গবেষক ও পন্ডিতদের প্রাণান্তকর মেহনত ও সাধনার ফলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গৌরবোজ্জ্বল জীবন, শিক্ষা ও আদর্শ অমরত্ব লাভ করেছে, আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ইতিহাসের ধারা বর্ণনাকে উচ্চাঙ্গের সাহিত্যের বাহনে তুলে তিনি নতুনত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
-এটি