মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাজী।।
মানুষ ইমাম আজম আবু হানীফা রহ.কে চেনে, কিন্তু তাঁর উসতায হাম্মাদ রহ.কে তেমন চেনে না। ইমাম বুখারী রহ.কে সবাই চেনে, কিন্তু তার উস্তাযদের সেভাবে চেনে না। হাকীমুল উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী রহ.কে সবাই চেনে, কিন্তু তাঁর শাইখ হাজী সাহেবকে সেভাবে ক'জনে চেনে? এভাবে পৃথিবীর সকল মহৎ সৃষ্টি ও মহান মানুষদের গড়ে ওঠার পেছনের মূল কারিগরদের লোকেরা খুব কমই চেনে ও জানে। কিন্তু তাদের সৃষ্টির সুমিষ্ট ফল সবাই আস্বাদন করে। তাদের কুরবানীর সুফল সবাই ভোগ করে। এটাই সম্ভবত সৃষ্টির নিয়ম ও নেজাম। সৃষ্টির মহান কারিগরেরা সাধারনত তাদের মহৎ সৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। যেমনটি আড়াল হয়ে আছেন কুলকায়িনাতের মহান খালিক ও মালিক আমাদের রব মহান আল্লাহ তাআলা।
উপমহাদেশে দুইজন মহান ব্যক্তিত্ব এমন আছেন, যাদের গড়ে ওঠার পেছনে তাদের আপন সহোদরদের অবদান ও ত্যাগ অনেক অনেক বেশি। একজন হলেন সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর বড় ভাই হাকীম মাওলানা সাইয়েদ আবদুল আলী রহ.। হযরত আলী মিয়া নদভী রহ. তাঁর ভাইয়ের কুরবানী, প্রেরণা, উৎসাহ, অনুশাসন ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠেছেন, বড় হয়েছেন। তাঁর মহান বড় ভাইয়ের অবদান উল্লেখ করা ছাড়া তাঁর জীবনী রচনা অসম্ভব। হযরত আলী মিয়াও তাঁর ভাইয়ের অবদানের কথা সসম্মানে অকপটে উল্লেখ করেছেন।
অপরজন হলেন শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহু তাআলা-এর বড় ভাই মাওলানা রফী উসমানী রহ.। শাইখুল ইসলাম তাঁর পিতা মুফতী শফী রহ. এর তত্ত্বাবধানেই তালীম তারবিয়াত, ফিকহ তাফাক্কুহ ও ইফতা-যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। পিতার ইন্তেকালের পর যিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষ্টকতা করেছেন এবং তাঁর পাশে পাহাড় হয়ে এবং তার ওপর মহিরুহ হয়ে আমৃত্যু দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি হলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মুফতী রফী উসমানী।
তিনি একাধারে একজন বিজ্ঞ ফকীহ ও মুফতী, প্রাজ্ঞ শাইখুল হাদীস, বিজ্ঞ পরিচালক ও সংগঠক, উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক সাধক, লেখক গবেষক ও আলোচক ছিলেন। যোগ্যতায় কোনো অংশেই তিনি শাইখুল ইসলাম থেকে কম ছিলেন না। শাইখুল ইসলাম নিজেই বলেছেন : وہ مجھ سے ہر حیثیت سے بڑے تھے ۔۔۔
"তিনি সর্বদিক থেকেই আমার থেকে বড় ছিলেন..."
কিন্তু তিনি সর্বদিক থেকেই প্রিয় ছোট ভাইকে এগিয়ে দিয়েছেন। এগিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। লোকজনকে প্রিয় সহোদরের দিকে রুজু করতে বলতেন। যেখানে সংসারজীবনের নানা ক্যাচাল ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা ভাই থেকে ভাইকে যোজন যোজন মাইল দূরে ঠেলে দেয়, সেখানে দুই সহোদর একসঙ্গে জোড়কবুতরের মত ৭৫বছর কাটানো তাদের জীবন্ত কারামতই বলতে হয়। এতে যেমন বড়ভাইয়ের পিতৃসুলভ স্নেহ মমতা, উদারতা, ইসার ও ইখলাসের বড় ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ছোটভাই কর্তৃক বড়ভাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ, আদব, সম্মান ও সমীহবোধের দখল। আর এভাবেই তাঁরা দুজনই বড় হয়ে ওঠেন।
বস্তুত ভ্রাতৃত্বের গীত গাওয়া সহজ, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন। সেই কঠিন কাজটিই তারা করে দেখিয়েছেন এবং আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
.
এ দুই ভাইয়ের ইলম ও ফিকর, কর্মতৎপরতা, চলন-বলনের প্রতি মুগ্ধতা সেই ছোটবেলা থেকেই, যখন থেকে তাঁদের নাম শুনেছি। জীবন্ত যাদের ঘটনা ও গল্প শুনে শুনে বড় হওয়ার প্রেরণা লাভ করতাম, এই সহোদর যুগল তাঁদের অন্যতম।
এই মহান ব্যক্তিদ্বয়কে কাছে থেকে দেখার একবারই সুযোগ লাভ হয়েছে। সেটা ২০০৯সালে বসুন্ধরা সম্মেলনে। সে সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন এই দুই ভ্রাতা। শাইখুল ইসলাম রহ.-থেকে হাদীসের সনদ লাভের সৌভাগ্য হলেও শাইখ রফী উসমানীকে দেখা ও দু'চার কথা শোনা ছাড়া বেশি কিছু লাভ করতে পারিনি।
তবে তাঁর তাসনীফ ও তাযকীর থেকে উপকৃত হওয়ার ধারা অব্যহত রয়েছে। মুসলিম শরীফের লেকচার সংকলন 'দরসে মুসলিম' আমার মতে উর্দূভাষায় এক অনন্য ইলমী সংজোযন। সহীহ মুসলিমের শরহে নববী, তাকমিলা ফতহুল মুসলিমের পর এখন হযরত রফী উসমানী 'দরস মুসলিম' থেকে ইস্তিফাদা করে চলেছি। খুব গোছালো মুরাত্তাব ও মুখতাসার। বড় সুন্দর ও সুবিন্যস্ত।
তাঁর মধ্যপ্রচ্যের সফরনামা "নবীগণের পুণ্যভূমিতে" থেকেও উপকৃত হয়েছি। এভাবে কতভাবে তিনি উম্মাহর খেদমত করেছেন, কতভাবে উম্মাহর এই মহীরুহ থেকে আমরা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছি; তার হিসাব কেবল খাইরুল হাসিবীনের কাছেই আছে। গত ১৮ নভেম্বর '২২ রাত এগারটার দিকে মহান ভ্রাতৃযুগলের একজন আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে আখিরাতের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। কর্মক্লান্ত এ মুসাফির আপন ঠিকানার পথে রওনা করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল ইবাদত আমল ও খেদমতকে কবুল করুন। সমস্ত লগযশ ও ভুলত্রুটিকে ক্ষমা করুন। তাঁকে আপন রহমতের ছায়ায় জান্নাতের আলা ইল্লিঈনে অধিষ্ঠিত করুন, আমীন।
সেসাথে আমাদের মহান মুরুব্বী ও উম্মাহর জন্য আল্লাহর খাস রহমত শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানীকে সিহহাত ও আফিয়াতের সাথে বাঁচিয়ে রাখুন। তাঁকে সবরে জামীল ইখতিয়ার করার তাওফীক দান করুন। তাঁর ইলম, ফিকহ ও ফিকর থেকে আরও বেশি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। তাঁকে সমস্ত যিল্লাত ও যাল্লাত থেকে হেফাযত করুন, আমীন, সুম্মা আমীন।
-এএ