মাওলানা মাহমুদুল হাসান: পুঁজিবাদের লক্ষ্য মুনাফা আর সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব। যেমন ধরা যাক একজন শ্রমিক কারখানায় একমাস কাজ করে ৩০ হাজার টাকার মূল্য উৎপাদন করল।
মালিক তাকে ১০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে বাকি ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করল। এই বিশ হাজার টাকা পুঁজিবাদের পরিভাষায় মুনাফা আর সমাজতন্ত্রের পরিভাষায় উদ্বৃত্ত মূল্য। পৃথিবীতে যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা যুদ্ধ-বিগ্রহ সব এ বস্তুটিকে কেন্দ্র করেই।
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র যত থিউরি দিয়েছে সব মুনাফা বা উদ্বৃত্ত মূল্য কেন্দ্রিক। এর বাইরে বৃহত্তর মানবাধিকার সম্পর্কে এদুটি মতবাদ কোন কথা বলেনি। যেমন দরিদ্র নিঃস্ব সর্বহারার কি হবে, নারী শিশু বৃদ্ধ পঙ্গু প্রতিবন্দীরা কি খাবে, পতিতা হিজড়াসহ সমাজের দুর্বলদের কি হবে, মজলুম ও অসহায়দের কে বাঁচাবে? এসব মৌলিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র একটি কথাও বলেনি। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রীয় উয্যোগে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করেছে। আর এসব তারা করেছে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন থেকে বেরিয়ে এসে।
পক্ষান্তরে ইসলাম যে মানবাধিকার দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোন মতবাদ এর ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। বস্তুত খেলাফত ব্যবস্থা বা ইসলামী রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্র নিঃস্ব সর্বহারাদের পুনর্বাসন করবে, সক্ষমদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে, অক্ষমদের ভাতা দিবে। নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য (দিয়ত) দিবে, ধর্ষিতা মেয়েদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে, নারী শিশু শ্রমিক ও সংখ্যালঘুদের ইসলাম যে ইনসাফপূর্ণ অধিকার দিয়েছে- সেসব বাস্তবায়ন করবে।
এখন প্রশ্ন হল, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো দুটি নিষ্ঠুর মতবাদ বিশ্ব শাসন করছে অথচ ইসলাম শ্রেষ্ঠ মতবাদ হয়েও অকেজো পড়ে আছে- এর কারণ কি? এর কারণ হলো শিক্ষা। পশ্চিমা ধারার সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী ইসলাম সম্পর্কে জানেন না, তারা মনে করেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে তাদের সামনে বুর্জোয়া গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। কারণ সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এ দুটি মতবাদের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।
পক্ষান্তরে ইসলাম ও মুসলিম জাতি পতনের কারনও শিক্ষা। কারণ ইসলামি শিক্ষা থেকে মানবাধিকার অংশটা বাদ পড়ে গেছে। বস্তুত ইসলাম হল হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদের সমষ্টি। হক্কুলাহ অর্থ আল্লাহর অধিকার তথা নামাজ রোজা তসবিহ তাহলিল ইত্যাদি। আর হক্কুল ইবাদ হলো মানবাধিকার। তার মধ্যে অক্ষম অসহায়দের আর্থিক অধিকার, মজলুমের বিচারিক অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি। এখন এ দুটি বিষয় প্রতিষ্ঠার জন্য হুকুমত বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তার জন্য জিহাদ করতে হবে, আর জিহাদকে বিজয়ী করার জন্য বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তোমরা বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর' (৪২: ১৩)। এই হল ইসলামের পরিচয়।
এখানে তিনটি বিষয় হলো- হক্কুল্লাহ হক্কুল ইবাদ ও হুকুমত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমান ইসলামে শুধু হক্কুল্লাহ অংশটা আছে আর হক্কুল ইবাদ ও হুকুমত উভয় অংশ বাদ পড়ে গেছে। কোন ফিরকার সিলেবাসে এসব বিষয় নাই। এজন্যই মাদ্রাসা শিক্ষিতরা হুকুমত তথা রাষ্ট্র রাজনীতি অর্থনীতি সমাজবিদ্যা ও মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু জানেন না, কিছু বলতে পারেন না। এই সুযোগে পশ্চিমা নিষ্ঠুর মতবাদ বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র খালি মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে।
কাজেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হল সর্বাগ্রে আলেম সমাজের উয্যোগি হতে হবে। ইসলাম থেকে বাদ পড়া হুকুমত ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলি সিলেবাসভুক্ত করতে হবে। এসব বিষয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাদের বুঝাতে হবে। তারা যখন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারবেন তখন ঐক্য হবে, ইসলামী রেনেসাঁও শুরু হয়ে যাবে। আর তখনই মুসলিম জাতি বর্তমান দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। এ সম্পর্কে আমি মুসলিম ঐক্যের ডাক গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
-এটি