ওলীউর রহমান।।
মসজিদ আল্লাহর ঘর, সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ও পবিত্র জায়গা হলো সমজিদ সমূহ। মসজিদ সমূহের সম্মান, মর্যাদা ও অবস্থান হচ্ছে মুসলমানদের হৃদয়ের গভীরে। প্রতিটি মুসলমান মনে প্রাণে মসজিদ সমূকে শ্রদ্ধা করে।
সেই সাথে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতীবগণ হচ্ছেন সম্মানের পাত্র। তারা হচ্ছেন নামাজের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জিম্মাদার। রাসূল (সা.) ইমাম মুয়াজ্জিনদের জন্য দোয়া করেছেন।
তিনি বলেন, “ইমাম হচ্ছেন জামিনদার আর মুয়াজ্জিন হচ্ছেন জিম্মাদার। হে আল্লাহ! ইমামদের সত্যপথে র্দৃঢ় রাখো এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা করে দাও।” দেশের আড়াই থেকে তিন লক্ষ মসজিদে আলেমদের বিশাল একটি অংশ ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতীবের মত সম্মাজনক পেশার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এই লেখায় মূলত দেশের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতীব ও মসজিদের খাদিমগণের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছু আলোকপাত করব।
প্রথমে সংক্ষেপে যে কথাটি বলতে চাই যে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নীতি নৈতিকতার অধঃপতনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের ইমাম মুয়াজ্জিন ও খাদিমগণ এক কঠিন সময় পার করছেন। নিতান্ত অল্প বেতনের পাশাপাশি কোনো কোনো সময় চরম দুর্ব্যবহারের শিকারও হচ্ছেন কোন কোন ইমাম মুয়াজ্জিন।
এর কারণ হলো আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ ইমাম মুয়াজ্জিনদের যেভাবে কোন বেতন স্কেল নেই তেমনিভাবে নেই ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে তাদের মান-সম্মানের নিরাপত্তার জন্য আলাদা কোন আইন, নেই মসজিদ পরিচালনার শক্তিশালী কোনো নীতিমালা।
মসজিদ সমূহ পরিচালিত হচ্ছে লাগামহীনভাবে, যার যার ইচ্ছা মত। বিগত তিন চার বছরে জিনিস পত্রের দাম অনেকগুণ বেড়ে গেলেও অধিকাংশ ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন আজ থেকে চার বছর আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। বেতন বৃদ্ধির কথা বললে অনেকের চাকরী ও চলে যায়।
ইমাম মুয়াজ্জিনগণের প্রতি কোনো কোনো মসজিদ কমিটির অবহেলা ও দুর্বব্যবহার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, অমানবিক নিয়ম কানুন চালিয়ে দিয়ে রীতিমত ইমাম মুয়াজ্জিনও খাদিমগণের উপর নীপিড়ন চালানো হচ্ছে, তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কোনো কোনো মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীল ও এলাকার মাতেব্বরদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্ব্যবহারের কারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন সম্মানিত ইমাম মুয়াজ্জিনগণ, সম্মানজনক এই পেশায় আসতে চাচ্ছেননা তরুণ প্রজন্মের অনেক আলেম।
কোনো কোনো এলাকায় মসজিদকে পরিণত করা হয়েছে নোংরা গ্রাম্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। এলাকার কোনো প্রভাবশালী বা টাকাওয়ালা হচ্ছেন মসজিদের কর্ণদার।
যুগের পর যুগ গ্রামের একাধিক বলয় ও গোষ্ঠীর মধ্যে চলে মসজিদের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। যে গোষ্ঠী বা বলয় মসজিদের কর্তৃত্ব পায় তারা মসজিদকে নিজেদের পৈতৃক সম্পদ মনে করে, নিজেদের ইচ্ছমত পরিচালনা করে। বহু মসজিদ এমন আছে যেখানে বছরের পর বছর ধরে আয় ব্যয়ের কোন হিসাব নেই, কর্ণদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনা।
এক কথায় ইমাম মুয়াজ্জিন নিয়োগ, তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিদা, তাদের সাথে আচরণ ও বিদায়ের প্রক্রিয়া সহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে রয়েছে নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কিছু ঘটনার প্রতি যদি দৃষ্টি দেওয়া যায় তাহলে অনুভব করা যাবে মসজিদসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে কত অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা হচ্ছে এবং ইমাম মুয়াজ্জিনগণের সাথে কত নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে।
১. গত ২২ আগষ্ট ২২ইং নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা ইউনিয়নে একটি মসজিদের ইমামকে একটি নোটিশের মাধ্যমে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নোটিশে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সে কারণগুলোর অন্যতম দুটি কারণ হলো- ১. তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে থেকে নিজ নামাজের স্থানে অবস্থান করেননা। ২. তিনি মাঝে মধ্যে কমিটির অনুমতি ছাড়া এক দুই ওয়াক্ত মসজিদে অনুপস্থিত থাকেন। তাছাড়া এই নোটিশে বলা হয়েছে- মাসিক ছুটি দুই দিন এবং দুই মাসের এক সাথে ছুটি নিতে হবে। এক দুই ওয়াক্তের কোন ছুটি নেই, এক দুই ওয়াক্ত অনুপস্থিত থাকলে সে পরিমাণ বেতন কর্তন হবে।
উপরে বর্ণিত ঘটনায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে এটা হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মসজিদের অবস্থা। ইমাম মুয়াজ্জিনগণের জন্য মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে অবশ্য কিছু নিয়ম কানুন থাকবে, তাই বলে তাদের উপর এতো কঠোর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া কি কোনোভাবে যুক্তি সঙ্গত? একজন ইমাম নিজের ঘরে সুন্নত আদায় করে জামাতের দু’ এক মিনিট আগে মসজিদে উপস্থিত হলেই চলে, ইমাম মুয়াজ্জিনগণ চব্বিশ ঘন্টা মসজিদে অবস্থান করা জরুরী নয়, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে কোথাও যেতে পারেন, রাস্তায় জ্যামে পড়েও সময়মত জামাতে উপস্থিত নাও হতে পারেন।
মাঝে মধ্যে এরকম হতেই পারে। এই সুযোগ অবশ্য ইমাম মুয়াজ্জিনগণকে দিতে হবে। কারণ তারা তো আর সাধারণ কোনো কর্মচারী নয়, বরং তারা হচ্ছেন ধর্মীয় নেতা। এসব তুচ্ছ কারণে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনগণের বেতন কাটা বা তাদেরকে বিদায় করে দেওয়া হলো ইমাম মুয়াজ্জিনগণের উপর চরম অমানুষিক এবং অমানবিক আচরণ।
উপরে বর্ণিত নোটিশে ইমামের ছুটি বলা হয়েছে মাসে দুই দিন, তাও আবার দুই মাসে ছুটি নিতে হবে। আমাদের দেশের সরকারী বেসরকারী যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শুক্রবার ছুটি থাকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শুক্রবার ছাড়াও মাসে ২/৩ দিন ছুটি পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে যেকোন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা মাসে ৫/৬ দিন ছুটি ভোগ করে থাকেন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম মুয়াজ্জিনগণও মাসে ৪/৫ দিন ছুটি পাওয়া তাদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার। কারণ তারা তো মানুষ এবং মসজিদগুলো তো এই সমাজেরই অংশ। গোটা সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি শুক্রবার সহ জাতীয় ও ধর্মীয় দিবসগুলোতে ছুটি ভোগ করে তাহলে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনগণকে এই সুযোগ দিতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্য ইমাম মুয়াজ্জিনগণ শুক্রবারের পরির্বতে সপ্তাহের অন্য দিনে এই ছুটি ভোগ করবে।
তাছাড়া অধিকাংশ ইমাম মুয়াজ্জিনগণ মসজিদের হুজরা বা কোয়াটারে থাকেন, স্ত্রী সন্তান নিয়ে মসজিদের আশে পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারেননা। কারণ তাদেরকে যে বেতন দেওয়া হয় এই বেতন দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা কোনো ভাবেই সম্ভব হয়না। একারণে পরিবারের সদস্যদের অসুখ বিসুখে বিশেষ ছুটির সুযোগ দেওয়াও হচ্ছে তাদের মানবিক অধিকার। কিন্তু অধিকাংশ ইমাম মুয়াজ্জিন এই অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। যার প্রমাণ হলো উপরের এই ঘটনা।
২. গত সেপ্টেম্বর (২০২২ইং) মাসে ঢাকা মিরপুর ২নং কাঠালবাগ বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদে এক লজ্জাজনক ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। মসজিদের এসি বন্ধ করতে দেরি হওয়ার কারণে মসজিদের মোতাওয়াল্লী মসজিদের মুয়াজ্জিনকে মারপিট করেছেন। সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত এই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় সারা দেশে ইমাম মুয়াজ্জিনগণ সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং অভিযুক্ত মোতাওয়াল্লীর অপসারণ দাবী করেন। এক পর্যায়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত মোতাওয়াল্লীকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হয়।
৩. দেশের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় গত ২১ অক্টোবর (২০২২ইং) একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই সাথে একটি ভিডিও ও ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিও এবং প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে সাতক্ষিরা জেলার কালারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস তাকে সালাম না দেওয়ার অপরাধে কালারোয়া উপজেলা মসজিদের ইমাম ও খতীব মাওলানা মুতিউর রহমানকে জনসম্মুখে অপস্থ ও নাজেহাল করছেন।
এই হিন্দু এবং মহিলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা মসজিদের খতীবকে হল ভর্তি মানুষের সামনে বেয়াদব, ছাগল বলে গালি দিয়ে তাকে হল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। হিন্দু এবং মহিলার বিষয়টি উল্লেখ করলাম একারণে যে, ইসলামে কোনো অমুসলিম এবং কোনো যুবতী মহিলাকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। এ ব্যাপারে খতীব মাওলানা মুতিউর রহমান জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন বলে সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে।
এদেশের মুসলমানগণ এখনো ইমাম মুয়াজ্জিনগণকে সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র মনে করে এবং মসজিদ সমূহকে সমাজের শ্রেষ্ঠ জায়গা ও আল্লাহর পবিত্র ঘর হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান, মসজিদের মর্যাদা এবং ইমাম মুয়াজ্জিনগণের ধর্মীয়-সামাজিক অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট উদাসিনতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।
পাশাপাশি রয়েছে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মানসিকতার দৈন্যতা। এই অনিবার্য বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অধিকাংশ মসজিদসমূহের কর্তৃত্ব চলে গেছে কিছু অযোগ্য মানুষের হাতে। যার কারণে যুগের পর যুগ ইমাম মুয়াজ্জিনগণকে সহ্য করতে হচ্ছে নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি এবং আর্থিক ও মানসিক নীপিড়ন।
একজন শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে যদি এক জন ইমাম ও খতীব এই আচরণ পান তাহলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিরূপ ব্যবহার আশা করতে পারেন? ইমাম ও খতীবগণ মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেন, দ্বীনের পথে আহবান করেন। সমাজের সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি ও পাপাচারের বিরুদ্ধে ইমাম খতীবগণের যে শক্ত অবস্থান তা সর্বমহলে স্বীকৃত।
কিন্তু আর্থিকভাবে তাদেরকে স্বাবলম্বি করার যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা নেই তেমনিভাবে তাদের সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠিত করারও কোনো পদক্ষেপ এবং নীতিমালা নেই।
২০০৬ সালে “মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” নামে ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এই নীতিমালায় যদিও ইমাম মুয়াজ্জিন ও খতীবগণের বেতন ভাতা সহ আরো বিভিন্ন বিষয় মোটামোটি সুন্দরভাবেই আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু এই নীতিমালায় একজন ইমাম বা খতীবকে একজন বেতনভোগী কর্মচারী হিসেবেই দেখানো হয়েছে, ধর্মীয় নেতা হিসেবে তাদেরকে আলাদা কোনো মর্যাদা দেওয়া হয় নাই।
অথচ ইমাম ও খতীবগণ হচ্ছেন ধর্মীয় নেতা, তারা তাদের নির্ধারিত দায়িত্বের পাশাপাশি সমাজে শান্তি ও ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ বহু দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইমাম খতীবদেরকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। সুতরাং আমাদের দেশেও প্রয়োজন একটি জোরালো নীতিমালা, যে নীতিমালার আলোকে মসজিদ সমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে, মসজিদে কর্মরত জনশক্তির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে এবং ইমাম খতীবগণকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হবে।
যাতে ইমাম খতীবগণ সমাজে অপরাধ নির্মূলে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন এবং তাদের সাথে কোনো প্রকার অসদাচরণকে মারাত্বক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
কলাম লেখক, ইমাম ও খতীব, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জালালাবাদ ইমাম সমিতি
-এটি