মুফতি এনায়েতুল্লাহ
(২০১৫ সালের ১১ নভেম্বরে প্রকাশিত লেখা)
শহুরে জীবনে বাংলার চিরায়ত রূপবৈচিত্র্য ও আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেকেই অনভিজ্ঞ। নাড়ির টান গ্রামে হলেও নাগরিক জীবনের এটাই বাস্তবতা। তাই তো দেখা যায়, সামান্য হাঁটাহাঁটি বা রোদের তেজে ক্লান্ত হয়ে উঠে শহুরেরা। একটু ছায়া খুঁজে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারে। তবে এই শহরে তেমন ছায়াদার গাছ আর কই?
কার্তিকের শেষ সময়ের সকাল। রোদ খুব একটা তেজোদীপ্ত নয়। তবুও দীর্ঘক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। কিন্তু এখানে তারা দাঁড়িয়ে আছেন সারিবদ্ধভাবে। উদাস দৃষ্টি ঝাপসা করে দেওয়া চোখের পানিসমেত। মাইকের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ইনশাআল্লাহ! সকাল দশটায়ই জানাজা শুরু হবে। ঘোষণা শুনে আরও নীরব হয়ে যায় বিশাল জনসমুদ্র।
ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের জানাজার পরিবেশ ছিলো এমনই। সংখ্যার বিচারে উপস্থিতির চেয়ে বরং রাস্তার চিত্রটা বলি। সকাল সোয়া সাতটা। ঢাকার প্রবেশদ্বার টঙ্গীবাজার বাসস্টেশন। টঙ্গি থেকে ক্ষিলক্ষেত-বসুন্ধরা হয়ে যে গাড়িগুলো নিয়মিত চলাচল করে তার কোনোটাতেই ওঠার উপায় নেই। অফিসগামী মানুষের সঙ্গে টুপি-পাঞ্জাবি পরা যাত্রীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। না বললেও বোঝা যায়, তাদের গন্তব্য বসুন্ধরা।
টঙ্গী হয়ে আবদুল্লাহপুর, হাউজ বিল্ডিং, আজমপুর, রাজলক্ষ্মী, জসিমউদ্দিন, বিমানবন্দর, খিলখেত, কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত প্রতিটি বাস স্টেশন হয়ে উঠেছিলো লোকে লোকারণ্য। ঠিক একই চিত্র মিরপুর থেকে কুড়িল উড়াল সড়ক হয়ে ও রামপুরা দিয়ে বসুন্ধরা আসার রাস্তায়। সাতসকালে রাস্তায় বের হওয়া এই বিপুল জনতার গন্তব্যও যে মুফতি আবদুর রহমানকে বিদায় জানানো, সেটা ততক্ষণে নগরবাসী বুঝে গেছে।
আজ রাজধানীর সব পথ গিয়ে যেন মিলে গিয়েছিলো বসুন্ধরা এলাকায়। কফিনবাহী গাড়িটি আসার আগেই জানাজাস্থল আলেম-উলামা ছাড়াও নানা পেশার লাখো মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে। অশীতিপর প্রবীণ থেকে শুরু করে বাবার হাত ধরে আসা স্কুলপড়ুয়া শিশুটি- কে ছিলো না! সবার বেদনামাখা মুখ। শোকে বিহ্বল সবাই। প্রিয় এই আলেমের জানাজায় অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন তারা।
সঙ্গত কারণে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রবেশের সব রাস্তা লোকে লোকারণ্য। অতো সকালে বসুন্ধরার আশপাশের অফিসগুলো ব্যস্ত হয়নি। দোকানিরা তাদের পসরা তখনো সাজায়নি। সাধারণত বসুন্ধরা এলাকার লোকজন মানুষের ভিড়ভাট্টা দেখতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। তারাও এই সকালে আগত মানুষের অজুর ব্যবস্থা, অপরিচিতকে রাস্তা বলে দেওয়ার কাজ করেছেন নিজ উদ্যোগে।
বসুন্ধরা বড় মাদরাসা বা বসুন্ধরা কেন্দ্রীয় মসজিদ বলে খ্যাত ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমানের জানাজার কথা থাকলেও লোক সমাগমের ঢল দেখে কর্তৃপক্ষ বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার-৫ এর সামনের রাস্তায় জানাজার ব্যবস্থা করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকও প্রস্তুত করা হয়। জানাজার আগে মুফতি আবদুর রহমানের মরদেহ হিমায়িত গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে।
দেশবরেণ্য এ শীর্ষ আলেমেদ্বীনের সম্মানে বুধবার (১১ নভেম্বর ২০১৫) ঢাকার সব মাদরাসার ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়। মাদরাসাগুলোতে তার জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় পবিত্র কোরআন খতমেরও।
সকাল ১০টা ১০ মিনিটে জানাজার নামাজ শুরু হয়। জানাজার নামাজ পরিচালনা করেন মুফতি আরশাদ রাহমানি। তিনি মুফতি আবদুর রহমানের বড় ছেলে ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক।
জানাজার আগে দেশের বিশিষ্ট আলেমরা বক্তব্য রাখেন। মুফতি আবদুর রহমানের কর্মবহুল জীবন নিয়ে কথা বলেন তারা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মওলানা মোস্তফা আজাদ, যাত্রাবাড়ী মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মজলিশে দাওয়াতুল হকের আমির মওলানা মাহমুদুল হাসান, সাবেক এমপি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক ও খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুফতি রুহুল আমিন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নতুন মহাসচিব মওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, খেলাফতে ইসলামের নেতা মওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়ত নেতা মওলানা জুনাইদ আল হাবিব, শায়খ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ ও মওলানা শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ।
জানাজাপূর্ব সময়ে আরও বক্তব্য রাখেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান ও বসুন্ধরা গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফওয়ান সোবহান উপস্থিত ছিলেন।
জানাজাপূর্ব বক্তব্যের সময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। তার কান্নার আওয়াজে উপস্থিত জনতাও কেঁদে উঠেন। ইট-পাথরের এ পাষাণ নগরে কান্নার রব বিরল হলেও আজ সাক্ষী হয়ে থাকল বসুন্ধরা। একেই বোধহয় বলে স্বজন হারানোর ব্যথা!
মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ইন্তেকাল করেন মুফতি আবদুর রহমান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯১ বছর। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের আলেমসমাজ থেকে শুরু করে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষীরাও এই শোকের মিছিলে শামিল হয়েছিল।
কবি বলেছেন, ‘জম্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে?’ তবে সব নদী এক নয়, নদী-নদীতে পার্থক্য আছে, রয়েছে বৈচিত্রও। এই বৈচিত্রময়তার সাক্ষী হয়ে থাকল আজকের সকালটি।
মৃত্যু চিরন্তন। এটা নিয়ে অভিযোগ করার উপায় নেই। ইসলামও এটা সমর্থন করে না। তারপরও বলি, যারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষ-মাটি ও প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, যারা সর্বদা মানবিক-মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলেন, যারা সত্য-সৎ ও সুন্দরের অনুসারী, যারা সৃষ্টিশীল কাজে সদা ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে- কেন যেন এমন শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো বড্ড অসময়ে চলে যান আমাদের মাঝ থেকে। নিকট অতীতকালে আমরা এমন অনেক দিকপালতুল্য আলেমেদ্বীনকে হারিয়েছি। এ শুন্যতা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।
মুফতি আবদুর রহমানের জানাজায় বিশাল উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে, নানা কর্মযজ্ঞ ও জ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের বিশ্বাসী মুসলমান ও উলামায়ে কেরামের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আমরা মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে কামনা করি, তিনি যেন পরকালেও এমন ভালোবাসা লাভ করেন।
-এটি