শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আ.লীগ নেতাকর্মীর প্রভাবে নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সংবর্ধনা বাতিল আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা ইসলামি লেখক ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত, আসছে নতুন কর্মসূচি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

বিশ্ব নবী সা. এর জন্ম তারিখ: একটি দালিলিক বিশ্লেষণ!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাফেজ মাওলানা আব্দুল মাজীদ মামুন রাহমানী।।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের কোন এক সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এ ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরাম ও ঐতিহাসিকগণ একমত। হাফেজ ইবনে কাসির রাহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন. وهذا مما لا خلاف فيه أنه ولد صلى الله عليه وسلم يوم الإثنين. অর্থাৎ এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,২/২৬৮।

হাদিস শরীফে এরশাদ হচ্ছেعَنْ أَبِي قَتَادَةَ الأَنْصَارِيِّ، رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاِثْنَيْنِ فَقَالَ ‏ "‏ فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَىَّ ‏"‏
অর্থাৎ আবূ ক্বাতাদাহ্ রা. থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ঐ দিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং ঐ দিন আমার উপর (কুরআন) নাযিল হয়েছে। মুসলিম, হাঃ নং- ২৮০৭ ; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাঃ নং- ২১১৮ ; আসসুনানুল কুবরা লিন্নাসাঈ, হাঃ নং- ২৭৭৭।

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছেوعن ابن عباس قال : ولد النبي صلى الله عليه و سلم يوم الإثنين الخ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। মুসনাদে আহমাদ হাঃ নং-২৫০৬ ; মাজমাউয-যাওয়ায়েদ, হাঃ নং- ৯৪৯।

আর রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করার ব্যাপারে বর্ণিত আছে...
عن محمد بن إسحاق قال : ولد رسول الله صلى الله عليه و سلم لإثنتي عشر ليلة مضت من شهر ربيع الأول.
অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাঃ নং- ৪১৮২ ; শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকী,হাঃ নং- ১৩৮৭ ; দালাইলুন নুবুওয়্যাহ লিলবাইহাকী,হাঃ নং- ১/৭৭।

এমনিভাবে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা ইবনে কাসির রাহমতুল্লাহি আলাইহি তার জগৎ বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ আল বেদায়া ওয়ান নেহায়ায় উল্লেখ করেন ثم الجمهور على أن ذلك كان في شهر ربيع الأول. অর্থাৎ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন এ ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম এবং ঐতিহাসিকগণ একমত। আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ২/২৬৮।

তবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন এ ব্যাপারে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মতামত নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

১. রবিউল আওয়াল মাসের দুই তারিখে।
قال محمد بن سعد : أخبرنا محمد بن عمر قال: كان أبو معشر نجيح المدني يقول : ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الإثنين لليلتين خلتا من شهر ربيع الأول.
অর্থাৎ আবু মা'শার নাজিহ আল মাদানী বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। তবাক্বাতুল কুবরা লিইবনে সাআদ,১/৬৯ ; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৬৮।

এই হাদিসের সনদের মধ্যে আবু মা'শার নাজীহ আল-মাদানী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। যার ব্যাপারে ইমাম নাসাঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন.. "ضعيف" অর্থাৎ সে দুর্বল বর্ণনাকারী।

ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন.."منكر الحديث" অর্থাৎ যার হাদিস পরিত্যাজ্য। মিজানুল ই'তিদাল লিযযাহাবী,৫/৪৫০।
কাজেই এই মতটি পরিত্যাজ্য।

২. রবিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখে।
عن إسحاق بن عبد الله بن أبي فروة، عن أبي جعفر محمد بن علي قال : ولد رسول الله عليه وسلم يوم الإثنين لعشر ليال خلون من شهر ربيع الأول،
অর্থাৎ ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবি ফারওয়া আবু জা'ফর মোহাম্মদ ইবনে আলীর সূত্রে বর্ণনা করেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন।তবাক্বাতুল কুবরা লিইবনে সাআদ,১/৬৯ ; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৬৮ ; আস্-সীরাতুন্ নাবাবিয়্যাহ,লিযযাহাবী রহ., পৃ. ৭।

এই হাদিসের সনদে "ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবি ফারওয়া"নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন যার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন.."تركوه" অর্থাৎ মুহাদ্দিসিনে কেরাম তাকে পরিত্যাগ করেছেন।

আর ইমাম আবু যুরআ রাজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন.." متروك" অর্থাৎ পরিত্যাজ্য। মিজানুল ই'তিদাল লিযযাহাবী,১/২৫৮।
অতএব এই মতটিও গ্রহণ করার মত নয়।

৩. রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখ জুমার দিন । এই মতটি উল্লেখ করে আল্লামা ইবনে কাসির রাহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন...
ولد يوم الجمعة لسبع عشرة خلت من ربيع الأول. نقله الحافظ ابن دحية فيما قرأه في كتاب "إعلام الورى بأعلام الهدى" لبعض الشيعة ثم شرع ابن دحية في تضعيفه، و هو جدير بالتضعيف إذ هو خلاف النص.
অর্থাৎ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখ জুমার দিন জন্ম গ্ৰহণ করেছেন। হাফেজ ইবনে দাহিয়্যাহ রহ. কোন এক শিয়ার লিখিত কিতাব "ই'লামুল ওয়ারা বিআ'লামিল হুদা" থেকে বর্ণনাটি নকল করে সেই শিয়া ব্যক্তির বক্তব্যকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন এবং ইহাকে দুর্বল সাব্যস্ত করাটাই অধিক উপযুক্ত।

কেননা তা সুস্পষ্ট দলিলের বিপরীত। এ বর্ণনার ব্যপারে আল্লামা ইবনে কাসির রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন "أبعد بل أخطأ من قال هذا القول"
অর্থাৎ এ বক্তব্যটি সঠিকতা থেকে অনেক দূরে বরং ভুল।আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৬৮।

৪. রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে।
أخبرنا أبو الحسين بن الفضل قال : حدثنا عبد الله بن جعفر قال : حدثنا يعقوب بن سفيان قال : حدثني عمار بن الحسن النسائي قال: حدثني سلمة بن الفضل قال : قال محمد بن إسحاق : ولد رسول الله ﷺ يوم الإثنين عام الفيل لإثنتي عشرة ليلة مضت من شهر ربيع الأول
অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রহ. বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাঃ নং- ৪১৮২ ; শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকী,হাঃ নং- ১৩৮৭; দালাইলুন নুবুওয়্যাহ লিলবাইহাকী,হাঃ নং- ১/৭৭।
এই বক্তব্যটি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের যিনি একজন প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ। তার ব্যাপারে ইবনে হিব্বান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন...
قال ابن حبان : وإنما أتى محمد بن إسحاق ما أتي لأنه كان يدلس عن الضعفاء فوقع المناكير في روايته من قبل أولئك ، فأما إذا بين السماع فيما يرويه فهو ثبت يحتج بروايته. অর্থাৎ যা বর্ণনা করা হয়েছে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক তাই বর্ণনা করেছেন। কেননা তিনি দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে তাদলীস ( সনদের মাঝখান থেকে কোন বর্ণনাকারীকে বাদ দেওয়া) করতেন।

ফলে তার বর্ণনার মধ্যে ঐ সকল দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে মুনকার বা পরিত্যাজ্য বর্ণনা এসেছে । হ্যাঁ, যখন তিনি সুস্পষ্টভাবে শ্রবণ করার কথা উল্লেখ করেন তখন তার বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা যাবে। মু'জামুল মুদাল্লিসীন, পৃ. ৩৮৩।

ইবনে রজব হাম্বলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার ব্যাপারে বলেন
قال ابن رجب : وكان محمد بن إسحاق بن يسار يدلس عن غير الثقات ، وربما دلس عن أهل الكتاب ما يأخذه عنهم من الأخبار بروايته .
অর্থাৎ মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার গাইরে সিকা বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের থেকে তাদলীস করতেন। এমনকি কখনো কখনো তিনি আহলে কিতাবদের থেকে যে বর্ণনা গ্রহণ করেছেন তা তাদলীসান বর্ণনা করে দিতেন। মু'জামুল মুদাল্লিসীন, পৃ. ৩৮৩।

তার ব্যাপারে আরো বর্ণিত রয়েছে
وذكره العلائي وابن حجر في المرتبة الرابعة من المدلسين ، وزاد ابن حجر : صاحب المغازي ، صدوق ، لكنه مشهور بالتدليس عن الضعفاء والمجهولين ، وعن شر منهم ، وصفه بذلك أحمد والدارقطني وغيرهما. অর্থাৎ ইমাম আলাঈ এবং হাফেজ ইবনে হাজার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে মুদাল্লিসিনদের চতুর্থ ত্ববকায় উল্লেখ করেছেন। ইবনে হাজার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার ব্যাপারে আরো বলেছেন যে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ বিষয়ে পারদর্শী।

সদূকুন (গ্রহণযোগ্য) তবে তিনি (ضعيف) দুর্বল ও ( مجهول ) অপরিচিত বরং তাদের থেকে নিচু পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের থেকে তাদলীসান বর্ণনা করায় প্রসিদ্ধ। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম দারকুতনি রহ. এমনটি বলেছেন। মু'জামুল মুদাল্লিসীন, পৃ. ৩৮৫।

দালাইলুননুবুওয়্যাহ এর মুহাক্কিক সায়্যিদ ইব্রাহিম রাহমতুল্লাহি আলাইহি এই হাদিসের সনদের ব্যাপারে বলেন... "هذا إسناد منقطع مع تدليس محمد بن إسحاق" অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক মুদাল্লিস হওয়ার পাশাপাশি হাদিসটির সনদও মুনকতি।(অর্থাৎ সনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।)
তাছাড়া এই সনদের মধ্যে সালামাতুবনুল ফাদল আল- ক্বুরাশী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। যার ব্যাপারে ইমাম আবু যুরআ রাজি রহ.বলেন..."لا أعرفه" অর্থাৎ আমি তাকে চিনিনা।

আর ইমাম আবু হাতেম রাজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার ব্যাপারে বলেন..." منكر الحديث" অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদিস পরিত্যাজ্য। লিসানুল মিজান, ৪/১২১।

অতএব এই মতটিও গ্রহণযোগ্য নয়। হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. ১২ তারিখের আরেকটি দলিল উল্লেখ করেছেন ...
ورواه ابن أبى شيبة فى مصنفه عن عفان بن مسلم عن سعيد بن مينا عن جابر وابن عباس رضى الله عنهما أنهما قالا: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الإثنين الثانى عشر من شهر ربيع الأول وفيه بعث وفيه عرج به إلى السماء وفيه هاجر وفيه مات, وهذا هوالمشهور عند الجمهور و الله أعلم.

‘অর্থাৎ ইবনে আবী শাইবা তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান ইবনে মুসলিম এর সূত্রে সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেন যে, জাবের রা. ও ইবনে আব্বাস রা.বলেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তি বাহিনীর মক্কায় আক্রমণের বছর রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন। আর রবিউল আউয়াল মাসে তাকে নবুওয়াত দেওয়া হয় এবং এ মাসে তাঁর মে‘রাজ হয় এবং এ মাসেই তিনি হিজরত করেন আর এ মাসেই তিনি ইন্তিকাল করেন। হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. বলেন, জুমহুরের নিকট এ মতটিই প্রসিদ্ধ। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৬৮।

এখানে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়! ১. এই হাদীসের বর্ণনাকারী আফফান বিন মুসলিম ও সাঈদ বিন মীনা উভয়ে নির্ভরযোগ্য। তবে আফফান বিন মুসলিম সাঈদ বিন মীনা থেকে সরাসরি হাদীস শুনতে পাননি। কারণ সাঈদ বিন মীনার ইন্তেকাল হয় ১১০ হিজরীর দিকে। আর আফফান বিন মুসলিমের জন্মই হয় ১৩৪ হিজরীর দিকে। সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২৫।

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আফফান বিন মুসলিম এবং সাঈদ বিন মীনা উভয়ের মাঝে একজন রাবী আছে যার নাম এই সনদে উল্লেখ করা হয়নি। তাই এই সনদটি মুনকাতে ( বিচ্ছিন্ন) প্রমাণিত হলো। আর মুনকাতে সনদে বর্ণিত হাদীস দলিলযোগ্য নয়।

২. হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. এই মতটি বর্ণনা করার পর বলেছেন... "وهذا هو المشهور عند الجمهور" অর্থাৎ এই মতটি জমহুরের নিকট প্রসিদ্ধ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মতটিকে তিনি প্রসিদ্ধ বলেছেন বটে কিন্তু বিশুদ্ধ বলেননি; বরং আট তারিখের মতকেই তিনি প্রকারান্তরে বিশুদ্ধ বলেছেন। জেনে রাখা উচিত যে, সব প্রসিদ্ধ বিষয়ই বিশুদ্ধ হয় না; বরং সমাজে অনেক এমন প্রসিদ্ধ বিষয় রয়েছে যা বিশুদ্ধ নয়। আমাদের মনে হয় এখানেও তেমনটিই ঘটেছে।

মোটকথা হচ্ছে বার তারিখের অভিমত প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিশুদ্ধ নয়।

৫. রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখে। সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এর মধ্যে আট তারিখের মতকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন তার দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে যে, তিনিও আট তারিখের প্রবক্তা। তিনি বলেন-

وقيل لثمان خلون منه, حكاه الحميدى عن ابن حزم ورواه مالك وعقيل ويونس بن يزيد عن الزهري عن محمد بن جبيربن مطعم, ونقل ابن عبد البر عن أصحاب التاريخ أنهم صححوه, وقطع به الحافظ الكبير محمد بن موسى الخوارزمي, ورجحه الحافظ ابو الخطاب بن دحية فى كتابه التنوير فى مولد البشير النذير.

‘* অর্থাৎ কেউ কেউ বলেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন রবিউল আউল মাসের আট তারিখ। এ মতটি হুমাইদী রহ. ইবনে হাযাম রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মালেক রহ., উকাইল (ইবনে খালেদ) ও ইউনুস বিন ইয়াযীদ ইমাম যুহরী এর সূত্রে, আর ইমাম যুহরী মুহাম্মদ বিন জুবাইর বিন মুতইম এর সূত্রে আট তারিখের কথা বর্ণনা করেছেন। সুপ্রসিদ্ধ স্প্যানিশ আলেম ইবনে আব্দুল বার বলেছেন, ইতিহাসবেত্তাগণ আট তারিখের অভিমতকেই বিশুদ্ধ বলেছেন।

* তাছাড়া হাফেজে হাদীস মুহাম্মদ বিন মূসা আল খাওয়ারেযমী নিশ্চিতভাবে আট তারিখকে সঠিক বলেছেন।
* আরেক হাফেজে হাদীস আবুল খাত্তাব উমর ইবনে হাসান ইবনে দিহইয়া স্বীয় গ্রন্থ ‘আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীরিন নাযীর’ এর মধ্যে আট তারিখের অভিমতকেই প্রধান্য দিয়েছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৮২)
* আল্লামা যারকাশী রহ.ও ‘শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব’ এর মধ্যে আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (শরহে যারকাশী আলাল মাওয়াহেব ১/২৪৬)
* আল্লামা আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল কসতালানী আট তারিখের মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলেন-

وقيل لثمان خلت منه, قال الشيخ قطب الدين: هو اختيار أكثر أهل الحديث, ونقل عن ابن عباس و جبير بن مطعم وهو اختيار من له معرفة بهذا الشان, واختاره الحميدى و شيخه ابن حزم , وحكى القضاعى فى عيون المعارف إجماع أهل الزيج(أي الميقات) عليه, ورواه الزهري عن محمد بن جبير بن مطعم وكان عارفا بالنسب وأيام العرب أخذ ذالك عن أبيه.

* অর্থাৎ ‘কারো কারো মতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। শায়েখ কুতুবউদ্দিন (আবূ বকর মুহাম্মদ বিন আহমাদ) বলেছেন, এ মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন এবং এ মতটিই হযরত ইবনে আব্বাস এবং জুবাইর বিন মুতইম রা. থেকে বর্ণিত আছে।
* তাছাড়া ইতিহাস সম্পর্কে যার নূন্যতম ধারণা আছে সেও এমতটিই গ্রহণ করবে। হুমাইদি ও তার উস্তাদ ইবনে হাযম রহ.ও এ মতটি গ্রহণ করেছেন ।
* এমনিভাবে কুযায়ী (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সালাম) ‘উয়ূনুল মাআরেফ’ নামক গ্রন্থে আট তারিখে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে মীকাতবাসীদের ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন। এমতটিকেই হাফেজ যুহরী রহ. মুহাম্মাদ বিন জুবাইর বিন মুতইম থেকে বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মাদ বিন জুবাইর নসবনামা ও আরবের ইতিহাস সম্পর্কে পণ্ডিত ছিলেন। মুহাম্মাদ তার পিতা জুবাইর বিন মুতইম থেকে এ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন।’ আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ ১/৮৫।
* ইবনুল-জাওযী রহ. রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্ম ৮ রবীউল আওয়াল উল্লেখ করেছেন । আল্-ওয়াফা বি-আহ্ওয়ালিল্‌-মুসতাফা,লিইবনিল-জাওযী রহ., ১/৯১।
৬. রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখে।
ক. সীরাতুল্ মুস্তাফা-তে উল্লিখিত হইয়াছে যে, “মূলত ৮ তারিখ বা ৯ তারিখ-এর পার্থক্যটাই মূল পার্থক্য নয় বরং এই পার্থক্যের মূল ভিত্তি হচ্ছে আরবী মাস ২৯ অথবা ৩০ দিনে হওয়া বা না হওয়া। অতএব ইহা যখন প্রমাণিত হলো যে, ঐ তারিখটি ২১ এপ্রিল ছিল, সুতরাং ৮ তারিখের বর্ণনাগুলো মূলত ৯ তারিখের পক্ষেই প্রমাণিত হয় । সীরাতুল্ মুস্তাফা লিমুহাম্মাদ ইদ্রীস কান্ধালাবী রহ.। ১খ., পৃ. ২৫৪, পাদটীকা ১)।
খ. শিবলী নু'মানী মিসরের খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা ফালাকীর মতামতের আলোকে ৯ রাবীউল আওয়াল /২০ এপ্রিল, ৫৭১ খৃ.-কে প্রাধান্য দিয়াছেন । সীরাতুন্-নবী লিশিবলী নু'মানী,১/১০৮-১০৯ ; নূরুল-ইয়াকীন ফী সীরাতি সায়্যিদিল মুরসালীন লিমুহাম্মাদ আল-খিদরী বেগ, , পৃ. ১০।
গ. কাজী সুলায়মান মানসূরপূরী রহ., “রাহমাতুল্লিল আলামীন” নামক গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, ৯ রারীউল আওয়াল, 'আমুল্‌-ফীল' মুতাবিক ২২ এপ্রিল, ৫৭১ খৃ., ১ জ্যৈষ্ঠ/৬২৮ বিক্ৰমিতে মক্কা মু'আজ্জামাতে রাসূলুল্লাহ সা. জন্মগ্রহণ করেন। রাহমাতুল্লিল আলামীন,লিকাজী সুলায়মান মানসূরপূরী,, ১/৪২-৪৩।

* ইমাম যাহাবী রহ. উপরোক্ত মতকে সহীহ বলেছেন । আস্-সীরাতুন-নাবাবিয়্যাহ লিযযাহাবী, পৃ.৭)।
ঘ. হিজুর রহমান সিওহারভী রহ. উল্লেখ করেছেন যে, “মাহমূদ পাশা ফালাকী কনস্টান্টিনোপল-এর একজন প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি তাঁর গবেষণার আলোকে এই কথা প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ সা. এর সময় হতে তার সময় পর্যন্ত সংঘটিত সবগুলি সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের নিখুঁত হিসাব করলে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল সা.এর শুভ জন্মতারিখ ১২ রাবীউল আওয়াল হতেই পারে না, বরং ইহা ৯ই রাবীউল আওয়ালই হবে। কাসাসুল কুরআন, লিহিফজির রহমান সিওহারভী রহ., ৪/২৫৪ ।

কাসাসুল কুরআনে ৯ই রবিউল আউয়ালের মতটিকে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য বলে ব্যক্ত করা হয়েছে । প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ এবং ঐতিহাসিকগণ তাঁদের সীরাত গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত তারিখের প্রামাণ্য বুঝাতে 'صحيح' এবং 'أثبت' শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ 'বিশুদ্ধ এবং 'নির্ভরযোগ্য'। এছাড়া হুমায়দী, 'আকীল, ইবনে 'আবদুল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবনে মূসা, আবুল-খাত্তাব, খাওয়ারিযমী, ইব্‌ন দাহিয়্যা, ইব্‌ন তায়মিয়া, ইবনুল কায়্যিম, ইবনে হাজার 'আসকালানী, শায়খ বদরুদ্দীন 'আয়নী প্রমুখ উলামার অভিমত এটাই। কাসাসুল্-কুরআন,লিহিফজির রহমান সিওহারভী,৪ / ২৫৩।
ঙ. হিজরী ১৩৯৬ সনে রাবেতায়ে আ’লামে ইসলামী সীরাতুন্নবী সা. সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিশ্বব্যাপী এ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের বহু লেখক সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেন। ১১৮২টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থটিকে প্রথম পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে এক বিরল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। এ গ্রন্থের লেখক আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ শুধুমাত্র ৯ই রবিউল আউয়ালের কথাই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন...
ولد سيد المرسلین ﷺ شعب بني هاشم بمكة في صبيحة يوم الإثنين التاسع من شهر ربيع الأول ، لأول عام من حادثة الفيل ، ولأربعين سنة خلت من ملك كسرى أنوشروان ، ويوافق ذلك العشرين أو الثاني وعشرين من شهر أبريل سنة 571م حسبما حققه العالم الكبير محمد سلمان المنصور فوري والمحقق الفلكي محمود باشا .

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় বনি হাশেম বংশে ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। সেই বছরেই হাতী যুদ্ধের ঘটনাটি ঘটেছিলো। সে সময় সম্রাট নওশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহণের চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো। জন্ম তারিখ ছিলো ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। ৫৭১ ঈসায়ী সাল। সাইয়েদ সোলায়মান নদভী, সালমান মনসুরপুী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকি গবেষণা করে এ তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন। আররহীকুল মাখতুম,পৃ. ৫৪ ; তারিখে খাযরাম, ১/৬২ ; রাহমাতুললিল আলামিন, ১/৩৮-৩৯।
মোটকথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম ও ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী বিশ্বনবী সা. এর জন্মতারিখ ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার। রাহমাতাললিল আলামীন, লিকাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান সালমান মানসুরপুরী ১ /৩৫ ; আসাহহুস সিয়ার পৃ.৫৫০-৫৫২ ; মাকালাতুল কাউছারী পৃ. ৩৬২-৩৭০ ; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,২/২৬৮।

লেখক- ফাযেল, জামিয়া রাহমানিয়া আযিযিয়া, মোহাম্মদ পুর,ঢাকা। মুতাখাচ্ছিছ ফি উলূমিল হাদিস,মারকাযুদ দিরাসা আল-ইসলামিয়া, কাজিপাড়া, মিরপুর, ঢাকা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ