রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৫ কার্তিক ১৪৩১ ।। ৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী ||

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৮ দিনের মাথায় ১৮ জানুয়ারি তার সঙ্গে গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আলহাজ্ব মাওলানা আবদুস সালাম ও কাপাসিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ওয়ারেছ আলীর সাক্ষাৎ ঘটে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে বঙ্গভবনে এ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো ভাবছে, বঙ্গবন্ধুর সরকার মাদরাসা শিক্ষার পক্ষে নয়। কিন্তু আমি তো মুসলমানের ছেলে। মাদরাসা শিক্ষা কি বলছেন, আমি স্কুল কলেজেও কোরআন-হাদিসের শিক্ষাক্রম চালু করবো। তবে ইসলাম নিয়ে যারা বণিজ্য করেছে তাদেরকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেবো না।’ তিনি বলেন, ‘আপনাদের ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মদ, জুয়া, রেসের মতো অবৈধ ও ইসলামবিরোধী কাজকেও আইন করে হালাল করে দিয়েছিলো। দেখবেন, সহসাই আমি এসব বাতিল করে দেবো। আমার ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও কী করে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বসে বসে শুধু দেখবেন।’ অতঃপর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে অবিলম্বে মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার এবং পাকিস্তান আমলে শিক্ষকগণ যেভাবে যা পেতো (সরকারি অনুদানসমূহ) সেভাবেই তাদের সকল পাওনা পরিশোধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি অন্যায়ভাবে কোনো আলেমের প্রতি যাতে কোনো অবিচার না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখার কথাও বলেন।

গুলশান মসজিদের খতিব ও পরবর্তীতে ‘মসজিদে গাউসুল আজম’ মসজিদের খতিব এবং বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহ-সভাপতি (মরহুম) আলহাজ্ব মাওলানা আবদুস সালাম তার স্মৃতি থেকে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃত বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মুখে শুধু ইসলাম ইসলাম করেই গেলো- আর আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে আইন করে আমি মদ, জুয়া ও রেস খেলা বন্ধ করে দিলাম। এই রেস খেলে হাজার হাজার গরিব নিঃশেষ হয়ে গেছে। বলেন, কাজটা কি ভালো করলাম না খারাপ করলাম।’

আরেকবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ‘শুনেছেন তো বোধহয়, আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আমি অর্ডিন্যান্স করে অটোনোমাস করে দিয়েছি।’ তারপর মাদরাসার খোঁজ-খবর নিতেন, ‘মাদরাসা চলছে তো ঠিক মতো?’ ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে গৃহীত এ সাক্ষাৎকারটি বঙ্গবন্ধুর ইসলাম প্রীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতা শিরোনামে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’ গ্রন্থের ২৫২ ও ২৫৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।

একটি অনুষ্ঠানে মোনাজাত করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাশে শেখ রাসেল, ছবি: সংগৃহীত

প্রবন্ধকার সেলিম রেজা তার এ রচনায় বঙ্গবন্ধুর ইসলাম প্রীতির বিবরণ নানা আঙ্গিকে প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে প্রবীণ জননেতা (মরহুম) মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের ভূমিকাও তুলে ধরা হয়েছে। রচনার এক পর্যায়ে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ পরিষদের মুখপত্র ‘মহানাগরিক’-এর ৪র্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় একটি নিবন্ধ থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার লেখক বর্তমান লেখক।

ওই লেখায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু তাতে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোনো কথা না থাকায় বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ মাদরাসা শিক্ষা পুনর্জীবিত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসেন। তার প্রচেষ্টায় এবং সরকারের সহযোগিতায় শিক্ষা কমিশনের একটি ইসলামি শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠিত হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ইসলামি শিক্ষা সংস্কার সংস্থা। এই কমিটির চেয়ারম্যান হন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় আলাউদ্দীন আল আজহারীকে। এই কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. মুহাম্মদ ইসহাক, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, আহমদ হোসাইন, আকবার আলী, শামসুল আলম, মাওলানা বেলায়েত হোসাইন, মাওলানা এম জালাল উদ্দীন ও চট্টগ্রামের মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এই কমিটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশমালা গৃহীত হয়। এভাবে মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অভিন্ন অঙ্গ রূপে পরিগণিত হয়।’

বর্ণিত দীর্ঘ উদ্ধৃতাংশের আলোকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইসলামি চিন্তা-চেতনা ও ধর্মীয় ভাবধারা বিশ্লেষণযোগ্য। বিষয়টি নিম্নরূপে বিশ্লেষণ করা যায়।

এক. মুসলিম সাধক প্রচারকের অধঃস্তন বংশের কৃতি সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। এ পর্যায়ে প্রথমেই বলা দরকার, ইসলামের অন্যতম ভিত্তি (রোকন) হজের প্রতি তার ভক্তি বিশ্বাস থাকায় এ দেশের মুসলমানদের হজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকে তিনি মেনে নিতে পারেনি। ঘটনাটি ছিল এই যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ স্বাধীন দেশের মুসলমানগণ স্বাধীনসত্তা নিয়ে কূটনৈতিক ও আইনগত সংকটে পতিত হয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত সৌদি সরকার এদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় এ দেশের হজ গমনেচ্ছুগণ আইনগত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত প্রভাবে সৌদি সরকারের বিশেষ অনুমোদন পাওয়া যায় এবং হজ প্রতিনিধি দল মক্কায় গমন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হজ প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ।

দুই. মক্কা ও মদিনায় এ হজ প্রতিনিধি দল অনুকূল সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। নতুন স্বাধীন দেশের হজযাত্রী হিসেবে সারা মুসলিম বিশ্বের হজ যাত্রীগণের সাধুবাদ ও মর্যাদা লাভ করেন এবং পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মহল কর্তৃক অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির ফলে বাংলাদেশ এবং এ এদেশের মুসলমানদের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির অনেকটা অবসান ঘটে এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও অনেকের ধারণার পরিবর্তন ঘটে।

তিন. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হজ প্রতিনিধিদলের নেতা মাওলানা তর্কবাগীশ এই ধারণা নিয়ে আসেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব শ্রোতার জন্য আরবিতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হলে সেখানে তার অনুকূল প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। হজ হতে প্রত্যাবর্তন করে মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুকে এ পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু তা বাস্তবায়নের জরুরি নির্দেশ দান করেন। রেডিও বাংলাদেশের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু চালু করেন এবং আরবি অনুষ্ঠানটি তারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ১৯৭৩ সালের অক্টোবর হতে এখন পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চালু রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব শ্রোতাদের কাছে বাংলাদেশের পরিচিতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে এর ভূমিকা অনন্য।

ধানমণ্ডি ক্লাব মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৭ জানুয়ারি ১৯৭২, ছবি: সংগৃহীত

চার. বঙ্গবন্ধু ওআইসির (ইসলামি সম্মেলন সংস্থা) শীর্ষ সম্মেলন যোগদান করেন এবং বাংলাদেশকে এই সংস্থার সদস্যভুক্ত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার পরিচায়ক। ফলে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার-প্রচারণার সকল চক্রান্ত বানচাল হয়ে যায় এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মুসলিম দুনিয়াসহ বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় বহু মুসলিম রাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপতি হয়।

পাঁচ. ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু জাতীয়ভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার, প্রকাশনা ও গবেষণা চর্চার এক নব দিগন্তের সূচনা করেন। এটি বর্তমানে মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম ইসলামি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপই সক্রিয় ছিল। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা সমগ্র দেশের সকল জেলায় চালু হয়েছে। মৌলিক রচনা, অনুবাদ, প্রকাশনা, গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। পবিত্র কোরআনের তরজমা, অসংখ্য তাফসির, হাদিসের অনুবাদ ছাড়াও ইসলামের নানা দিকের ওপর অসংখ্য গ্রন্থ-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত এনসাইক্লোপেডিয়ার মতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে বিরাট বিরাট খন্ডের বহু ভলিউমে ‘ইসলামি বিশ্বকোষ।’ আরও নানাভাবে এ প্রতিষ্ঠান গবেষণাধারা অব্যাহত রেখেছে। এ সব বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার সুফল।

ছয়. এদেশে হাজার বছরের ইসলামি ঐতিহ্য মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক ছাঁচে ঢেলে সাজান ও পুনর্জীবিত করেন এবং তা ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করেছে।

সাত. বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে কোরআন তেলাওয়াত ও তাফসির প্রচার শুরু হয়। তাবলিগ জামাতকে একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু তাদের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমার জন্য টঈীতে একটি সুবিশাল প্রাঙ্গণ বরাদ্দ দেন। কাকরাইল মসজিদের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অতিরিক্ত স্থান বরাদ্দ করা হয়। দেশের ভেতরে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতার সুনির্দিষ্ট ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সমান্তরালে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা, সংকটকালে তাদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানকে পরিষেবা দিয়েছেন। ১৯৭৩-এ আরব-ইসরাইল যুদ্ধে অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধরত আরব দেশগুলোর সৈনিকদের জন্য ১ লাখ পাউন্ড চা ও ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। অন্যান্য দেশ থেকে পাঠানো মেডিকেল টিমের মধ্যে বাংলাদেশেরটি ছিল সবচেয়ে বড়।

পরিশেষে বলে রাখা দরকার যে, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের আমলে মাদরাসা ছাত্রদের সর্বোচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ দীর্ঘ প্রত্যাশিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান প্রদান করে তার পিতার ইসলামি শিক্ষাপ্রীতিই অনুসরণ করেছেন।

লেখক: প্রবীণ আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ