আইএফএ কনসালটেন্সি (ইসলামী অর্থনীতি শিক্ষা, গবেষণা ও পরামর্শ প্রদান প্রতিষ্ঠান) কর্তৃক আয়োজিত ‘আসন্ন বাজেট ২০২২-২৩ অর্থবছর: প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে কিনোট স্পিচ পেশ করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ও গবেষণা প্রধান মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম। এর উপর আলোচনা করেন-প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রধান, মুফতি ইউসূফ সুলতান। আরও আলোচক ছিলেন-গবেষক মুফতি ফাহিম ফয়সাল আল মাসউদ।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির আগামী এক বছরের আয়-ব্যয় নিরূপণ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতীয় বাজেট একটি বড় ভূমিকা রাখে।
আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী-প্রতি বছর জুন মাসে বাজেট পাশ হয়। ১লা জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত একটি অর্থবছর গণনা করা হয়। আসছে আগামী ৯ জুন, ২০২২, রোজ বৃহস্পতিবার সংসদে বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে।
এর আগেই আলোচনা, মতামত, পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রণালয় উক্ত বাজেটের একটি প্রাথমিক প্রাক্কলন প্রকাশ করেছে। এর উপর নানা ফোরাম , সংস্থা থেকে আলোচনা হয়েছে। মতামতও দেয়া হয়েছে । এখনও তা অব্যহত রয়েছে ।
এহেন মুহূর্তে প্রকৃত টেকসই অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতির আলোকে একটি জাতীয় বাজেটে প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা কেমন হতে পারে- তা আলোচনা হতে পারে।
ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিকতা প্রথমেই আসা যাক-ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিকতা কতটুকু? বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বিরাজমান। এহেন মুহূর্তে ইসলামী অর্থনীতি আসলে কতটুকু যৌক্তিক। শুরুতেই সংক্ষেপে এ আলোচনার দাবি রাখে । এ আলোচনা শেষে একটি জাতীয় বাজেট প্রণয়নে ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিকতা উঠে আসবে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মূলত ১৮শ শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে শুরু হয়েছে। ইসলামী ইতিহাসে তখন মোটামুটি দ্বাদশ হিজরীর মাঝামাঝি সময় চলমান । ইসলামী অর্থনীতি তখন শুধু সামাজিক ভাবেই নয়; বরং রাষ্ট্রীয়ভাবেও ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। মুসলিম বিশ্বে তখন যুলুম-অত্যাচারমুক্ত এক ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা চলমান। ইউরোপ এ থেকে ছিল তখন বহু দূরে ।
সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদ: অর্থনৈতিক যুলুমের শুধু খোলস পরিবর্তন
ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মৌলিক অর্থনৈতিক চিন্তা হিসাবে ‘সামন্তবাদ’ অর্থব্যবস্থা বিশেষভাবে পরিচিত। যা পুরোপুরি শোষণ ও যুলুমভিত্তিক ছিল। একটা সময় সামন্তপ্রভুদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও ভূমিদাসদের অভ্যুত্থানের ফলে শোষণ ও যুলুমের নতুন আরেকটি পথ উদ্ভব করতে হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তপ্রভুদের নেতৃত্বে (প্রাইভেট সামন্তবাদ) শাসন ও শোষণ বহাল না রেখে সবাই মিলে এ দায়িত্বভার একজনকে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় আগমন ঘটে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ও রাশিয়ার রানী ক্যাথেরিনার। এখান থেকে শুরু হয়-প্রাইভেট সামন্তবাদ থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন সুবৃহৎ সামন্তবাদ (State controlled feudalism) এর রাজত্ব। এই রাজত্ব পরিচালিত হতো পরিবারভিত্তিক। আধুনিক ভাষায় যা ‘রাজতন্ত্র’ নামে পরিচিত।
সামন্তবাদী এই নতুন শোষণ ও শাসন-ব্যবস্থা জিইয়ে রাখতে গঠন করা হয় বিশাল সেনাবাহিনী। তাদের পেছনে ব্যয় করা হয় মোটা অংকের রাজস্ব। এর সাথে রানীমাতাদের ভোগ ও অপচয় তো আছেই। এর জন্য দরকার হয় প্রচুর অর্থের। যার উৎস ছিল একমাত্র কৃষক-প্রজা ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর আরোপিত নানা কর।
এ প্রক্রিয়ায় মানুষকে নানা ধরনের খাজনা ও কর দিতে হতো। একটা সময় মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর বাকি থাকলো না। ধীরে ধীরে ফিউডাল সিস্টেম ভিতর থেকে দেউলিয়া হয়ে যায়।
এ সুযোগে সপ্তদশ শতকে ইংল্যাণ্ডে আর অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স ও আমেরিকায় বিপ্লব ঘটে যায়। যার ফলে সামন্তবাদ ভেঙ্গে যায়। তখন এর জায়গা দখল করে নেয় শোষণের আরেক নাম ‘পুঁজিবাদ’।
প্রথমে প্রাইভেট সামন্তবাদের মতো পুঁজিবাদেও এমন একটি সিস্টেম দাঁড় হয়, যেখানে থাকবে নিয়োগকর্তা ও নিয়োজিত ব্যক্তি। নিয়োগকর্তা ব্যক্তি নিয়োজিত ব্যক্তিকে ভাড়া দিবেন। নিয়োজিত ব্যক্তিটি সামন্তবাদের মতো ভূমিদাস নয় যে, ভূস্বামীর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা থাকবেন। বরং তিনি স্বাধীন। যেখানে ইচ্ছে, যার কাছে ইচ্ছে যেতে পারবেন। তবে এই স্বাধীনতাও একটি প্রতারণা মাত্র। কারণ তিনি যেখানেই নিয়োজিত হন সেখানেই শোষণের শিকার হতে হবে।
মালিক (নিয়োগকর্তা) তার উদ্বৃত্তশ্রম আত্মসাৎ করবে । এটিই পুঁজিবাদ । যা বাহ্যিকভাবে খুবই ভালো, তবে ভিতরটা একেবারেই ফাঁকা।
সামন্তবাদে ছিল রাজা, আর পুঁজিবাদে রাজার জায়গা দখল করে নিল কর্পোরেশন। সামন্তবাদ বিনষ্ট করল কৃষিজমি। আর পুঁজিবাদ ছারখার করে দিল প্রকৃতির সবকিছু। সামন্তবাদ জমিজমা পণ্যায়ন দিয়ে সমাজের পণ্যায়ন শুরু করেছিল, আর পুঁজিবাদ দুনিয়ার সবকিছুকেই বেচাকেনার পণ্যে রূপান্তর করে ছাড়ল। সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদ-আমূল পরিবর্তন নয় । কেবল মানুষকর্তৃক মানুষকে শোষণের খোলস পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। তাই সামন্তবাদ যেভাবে বাঁচেনি, একই কারণে পুঁজিবাদও বাঁচবেনা।
পুঁজিবাদের ভয়াবহ ফলাফল
যদিও এখন বিশ্বময় পুঁজিবাদের চর্চা হচ্ছে তবে তিক্ত সত্য হচ্ছে যে, মানুষ এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কারণ, পুঁজিবাদের কুফল ও অসারতা এখন মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিম্নে কিছু তথ্য দেখুন,
১. পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে
পুঁজিবাদীরা সবসময় চায় পুঁজি বাড়াতে। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন পুঁজিবাদীদের পুঁজি, ধনসম্পত্তি বেড়ে যেতে থাকে, অন্যদিকে সমাজে দরিদ্রের সংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে। যাদের পুঁজি অল্প, তারা বড় পুঁজিওয়ালাদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে সর্বস্বান্ত হয়ে মজদুরদের কাতারে শামিল হতে থাকে। এভাবে শ্রমিক দল বেড়ে যায়। যার ফলে সৃষ্টি হয় ব্যবসা-সঙ্কট। এমন মহা অর্থনৈতিক সঙ্কট গত শতাব্দিতে তিনবার এবং চলতি শতাব্দিতে ২০০৮ সনে একবার হয়েছে। ১৯৩০-৩৩ সালের ব্যবসা-সঙ্কটে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১ লক্ষ ৩০ হাজার শ্রমিক সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে তথ্য-উপাত্তে উল্লেখ হয়েছে।
বরং বাস্তবতা হল পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা একটি অনিবার্য বিষয়। অর্থনীতিবিদগণের মতে ৪০ বছর পরপর পুঁজিবাদে মহামন্দা (Great depression) ঘটতে বাধ্য।
কারণ, এতে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ চক্র (Long term debt cycle) হরহামেশাই তৈরি হয়। তবে সম্প্রতি এক মহামন্দা থেকে পরবর্তী মহামন্দার সময়কাল ছোট হয়ে আসছে বলে অনেকে মনে করছেন। শুধু তাই নয়; পূর্বের চেয়ে পরবর্তী মহামন্দার ক্ষতির মেয়াদও অধিক হচ্ছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত কোভিড-১৯-এ সৃষ্ট অর্থনৈতিক মহামন্দা।
এভাবে চলতে থাকলে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য, অসমতা, বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব ও সার্বিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। সুতরাং পুঁজিবাদের ভবিষ্যত একেবারেই অন্ধকার।
২. পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে
অতি ধনী ও অতি গরিবের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া’-পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অন্যতম ক্ষতিকর দিক। দিন যত যাচ্ছে, এ হার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত জানুয়ারী, ২০২০ ইং-এ সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত হল ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের’ (WEF) বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক দাতব্য ফেডারেশন ‘অক্সফাম’ ‘টাইম টু কেয়ার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের দরিদ্রতম ৪৬০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও অধিক সম্পদ রয়েছে মাত্র ২১৫৩ জন শীর্ষ ধনীর হাতে। অর্থচ দরিদ্রতম এ মানুষগুলো দুনিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ।
অর্থাৎ পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠির ৬০ ভাগ মানুষ দরিদ্রতম। তাদের সকলের সমপরিমাণ সম্পদের চেয়েও অধিক সম্পদ মাত্র ২১৫৩ জন মানুষের হাতে রয়েছে।
তাতে আরো বলা হয়েছে- বিশ্বের মাত্র ২৬ ব্যক্তির হাতে ৩৮০ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠির মোট সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৯)
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ জন শীর্ষ ধনীর কাছে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, দেশটির অর্ধেক নাগরিকের মোট সম্পদ যোগ করলে তাদের সম্পদের সমপরিমাণ হবে। (প্রাগুক্ত)
উন্নত দেশের রোল মডেল বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে The Heritage Foundation বলছে-Today, the U.S. spends 16 times as much on welfare as it spent in the 1960s yet the federal poverty rate remains nearly unchanged.
সম্প্রতি প্যারিস স্কুল অব ইকনোমিকস থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক বৈষম্য বিষয়ক প্রতিবেদন-২০২২ (World InequalityReport-2022) এ উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্বের ৭৬ শতাংশ সম্পদ হোল্ড করছে বিশ্বের মাত্র ১০ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনীব্যক্তি । মধ্যবিত্ত ৪০ শতাংশ মানুষ হোল্ড করছে মাত্র ২২ শতাংশ সম্পদ। আর নিম্নবিত্ত ৫০ শতাংশ মানুষ হোল্ড করছে মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ।
তদ্রপ বিশ্বের সামগ্রিক আয়ের ৫২ শতাংশ ধারণ করে আছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ । মধ্যম শ্রেণীর ৪০ শতাংশ মানুষ ধারণ করে আছে ৩৯.৫ শতাংশ আয়। আর নিম্নশ্রেণীর ৫০ শতাংশ মানুষ ধারণ করে আছে মাত্র ৮.৫ শতাংশ আয়।
এ দৃশ্য এখন প্রায় প্রতিটি দেশের। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশর চিত্রও অভিন্ন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন ‘প্রভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি’ বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮- এর তথ্যমতে-‘অতি ধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। আর সাধারণ ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। আর অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২ কোটি ৪১ লাখ মানুষ হতদরিদ্র ।
শুধু তাই নয়, ২০১৯ ইং এর জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দশ বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৪ গুণ। বর্তমান ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি রয়েছে পৌনে দুই লাখের অধিক। প্রতিবেদনে শুধু ব্যাংকিং খাতের কোটিপতির সংখ্যা স্থান পেয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের বাইরে হিসাব করলে মোট কোটিপতির সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা ।
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গরীব মানুষ রয়েছে, এমন দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৯)। একদিকে ধনী বৃদ্ধির হারে শীর্ষে। অপরদিকে দরিদ্রতাও উচ্চে!!
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ বছরে বাংলাদেশ অতিধনী বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
অপরদিকে দেশে দারিদ্রের হার ৪০ শতাংশের অধিক। সম্প্রতি পিপিআরসি জানিয়েছে-চলতি অর্থবছরের সর্বশেষ ৪ মাসে (ফেব্রুয়ারী-মে) দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে প্রায় ২১ লাখ মানুষ। এতে দেশে মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে- ৩ কোটি ৯ লাখ। নতুন দরিদ্র মোট জনসংখ্যার ১৮.৫৪ শতাংশ।
পিপিআরসি আরও জানিয়েছে, বিদ্যমান শুধু মূল্যস্ফীতির কারণে শহরের ২১ শতাংশ পরিবার এক বেলা খানা বাদ দিয়েছেন। দৈনিক মাথাপিছু আয় গ্রামীণ জীবনে ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানুষের সম্পদে কী পরিমাণ বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে!
৩. কৃত্রিম চাহিদা হু হু করে বাড়ছে
পুঁজিবাদীরা তাদের বাজার সৃষ্টির জন্যে মানুষের মাঝে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করছে। তাইতো সমাজে ফ্যাশন আর বিলাসী পণ্যের চাহিদা লাগামহীনভাবে বাড়ানো হচ্ছে এবং তা সহজলভ্য করা হচ্ছে। অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী হাহাকার করছে। এক বস্তা চালের চেয়ে একটি মোবাইল ফোন এখন সহজলভ্য। কারণ মোবাইল ফোন মানুষ সাধারণত ক্রয় করে ৪/৫ বছরে একবার। অপরদিকে চাল ক্রয় করতে হয় প্রতি মাসে। প্রতি সপ্তাহে।
৪. নৈতিকতাশূন্য নির্লজ্জ জাতি তৈরি করছে
মাদকদ্রব্য , নেশাদ্রব্য, জুয়া, ক্যাসিনো, পর্নো ব্যবসা ইত্যাদি -পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে পর্নো ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসাকে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা মনে করা হয়। সম্প্রতি IBISWorld এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর্নো ওয়েবসাইট ইন্ডাস্ট্রির মার্কেট ভলিয়ম ৮৫৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর এর গড় বৃদ্ধি হার ৬.৫ শতাংশ।
৫। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জরিপকারী প্রতিষ্ঠান দ্যা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে-
The global average economic freedom score is now 60—a loss of 1.6 points from the previous year’s 61.6.
তাতে বাংলাদেশের অবস্থান: ৫২.৭। এটি Mostly unfree ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ- দেশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাস্তবে অর্ধেকও নেই।
৬. সুদের মত ভয়াবহ অর্থনৈতিক অভিশাপকে বিস্তার করছে
রিবা ও সুদের মত ভয়াবহ অর্থনৈতিক অভিশাপকে জাতীয়ভাবে চর্চা করে শোষণ করা হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণী ও আপামর জনগণকে। সুদ অর্থনৈতিকভাবে একটি অনুৎপাদনশীল খাত। ইতিহাসে ১৯৩০ সনের ইকোনোমিক ক্রাইসিস খুবই বিখ্যাত। এ সময় উক্ত ক্রাইসিস কেন হল, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি তা গবেষণা করে গবেষণা টিম মন্তব্য করেছিল,
"In order to ensure that money performs its true function of operating as a means of exchange and distribution, it is desirable that it should cease to be traded as a commodity." (The Repot of Economic Crisis Committee, Southampton Chamber of Commerce, 1933, part 2)
সুতরাং সুদ থেকে আমাদের বের হতে হবে।
Effect of interest rate on economic performance: evidence from Islamic and non-Islamic economies- এই গবেষণায় সাবা মুশতাক ও দানিশ আহমদ ১৭টি নন-মুসলিম দেশ ও ১৭টি মুসলিম দেশে জরিপ করে এই ফলাফলে উপনীত হয়েছেন যে,
The results suggest that people in Islamic countries are not concerned about
the interest rate on saving, but in non-Islamic countries, the interest rate, per capita income and inflation have significant positive impacts, and national expenditure has a significant negative impact on saving. However, in Islamic countries, remittances received and national expenditure has significant negative impacts, and per capita income has a positive significant impact on saving. In the case of investment, interest rate and inflation show a negative effect on investment while trade affects investment positively in both Islamic and non-Islamic countries. Furthermore, domestic credit provided by banks has a negative significant effect on investment in non-Islamic countries, while in Islamic countries, remittances show a positive significant impact on investment.
পুঁজিবাদ: ফিরে আসার ব্যকুলতা
চলমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার এসব নানা মানবকল্যাণ পরিপন্থী ফলাফলের কারণে বিশ্বের মানুষ পুঁজিবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এর ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছে। গত জানুয়ারী, ২০২০ ইং-এ-‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম’-এ প্রকাশিত ‘এ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারো মিটার’-এর বার্ষিক জরিপে বলা হয়েছে- বিশ্বের মানুষ কীভাবে পুঁজিবাদকে দেখে সেটা জানতে বিশ্বের ২৮টি দেশের ৩৪ হাজার জনের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে। এতে পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স থেকে শুরু করে চীন, রাশিয়ার মতো দেশের জনগণও এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বলছেন-বর্তমান পুঁজিবাদ উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে ।
আরো বহু আগেই, ২০০৮ইং সনে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম’এর বার্ষিক সম্মেলনে এর চেয়ারম্যান তার ভাষণে চলমান পুঁজিবাদ বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বলেছেন- ""Today we have reached a tipping point, which leaves us with only one choice: change or face the continued decline and misery." (Causes and remedies of the present financial crisis from Islamic perspective, by Mufti Muhammad Taqi Usmani. P.32.)
‘আজ আমরা এমন এক বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি, যার পরে আমাদের জন্য অর্থব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। নচেৎ ক্রমাগত অধ্বঃপতনকে মেনে নেওয়াই হবে আমাদের নিয়তি।’
পুঁজিবাদ কেন ব্যর্থ হল?
ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা জেনেছি, ইউরোপীয় মধ্যযুগে জমিদার (সামন্তপ্রভু) শ্রেণী কর্তৃক কৃষক শ্রেণীর প্রতি সীমাহীন যুলুম প্রতিরোধে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের জন্ম। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান। একচ্ছত্রভাবে জমিদাররা ভূ-স্বামী হয়ে আছে। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নেই। এসব রোগ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবীদগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে এর জন্য যে ঔষধ ও ব্যবস্থাপত্র তারা নির্দেশ করেছেন, সেটা ছিল মারাত্মক পর্যায়ের ভুল। একটি ভুল ব্যবস্থাপত্র রোগকে আরো কঠিন করে তোলে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপত্র ঠিক এমনি একটি ভুল ব্যবস্থাপত্র মাত্র।
ব্যবস্থাপত্রটি ভুল হওয়ার মৌলিক কারণ হল- মানব জীবন থেকে ধর্মকে চির বিদায় দেয়া, সামন্তবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অবাধ ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা, লাগামহীন মুনাফা অর্জনকে উৎসাহিত করা, সবকিছুতেই মুনাফার ঘ্রাণ খুঁজে ফিরা, প্রকৃতির সকল কিছুকে পণ্য হিসাবে দেখা প্রভৃতি। সময় হয়েছে- একটি সঠিক ব্যবস্থাপত্র পেশ করার। পিপাসার্ত চোখে রুগ্ন দেহে মানবজাতি আজ তাকিয়ে আছে - একটি সুস্থ, সঠিক ও ভারাসম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপত্রের পানে।
পুঁজিবাদ কি মেরামতযোগ্য?
কেউ কেউ মনে করেন, পুঁজিবাদ সংস্কার হতে পারে। সংস্কার করে নেয়া হলে এটি মানব কল্যাণে আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ মতের প্রবক্তাদেরকে বলা হয়- লিবারেটেরিয়েন (মুক্তিবাদী), লিবারেল (উদারবাদী), লিবারেল লেফট (বাম দিকে ঝোঁকওয়ালা উদারবাদী)। তাদের মতে, মূল পুঁজিবাদে সমস্যা নেই। সমস্যা হল পুঁজিবাদ ব্যবস্থাপনায়)। ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার করা হলে ভালো পুঁজিবাদ তৈরি হবে। এর জন্য যা করতে হবে- ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষ্টিবাদী ব্যবস্থাকে হ্রাস করতে হবে। কিছু মানুষের হাতে সম্পদ ও আয়ের যে পুঞ্জীভবন ঘটেছে তা কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সরকারকর্তৃক অনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও হ্রাস করতে হবে। বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। সম্প্রতি কোভিড-১৯ এর সময়কালে আকার-ইঙ্গিতে নানাভাবে এ মতবাদ আলোচনায় উঠে এসেছে। এ মতবাদের আলোকে মানুষকে সামাজিক পুঁজির প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে-শুধু মুনাফার জন্য ব্যবসা না করে, সমাজের উপকার ও কল্যাণের জন্যও ব্যবসা করতে।
বাস্তবতা হল-পুঁজিবাদ এমন একটি পদ্ধতি, যার মূলে একচ্ছত্র মুনাফা, ভোগ, লালসা, প্রতারণা, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, ধর্মহীনতা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। এগুলোর আমূল সংশোধন সম্ভব নয়। সীমিত সময়ে হয়তো কেউ ব্যক্তিগতভাবে এর নেতিবাচক গুণ থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে এর নেতিবাচক ধারণা থেকে বের হওয়া মোটেও সম্ভব নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদ মানবতা, নৈতিকতা, সামাজিকতা, পরোপকারিতার কথা বলবে ততক্ষণ, যতক্ষণ এর সাথে মুনাফার সম্পর্ক থাকবে। যদিও তা দূরতম হয় না কেন। এর বাহিরে মূলগতভাবে এর ভিন্ন অবস্থান তৈরি অসম্ভব। সুতরাং মেরামতঅযোগ্য মেশিনে সময় ব্যয় না করে, নতুন কার্যকরী মেশিন প্রতিস্থাপন করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সারকথা, সমাজতন্ত্র বহু আগেই বিদায় নিয়েছে। চলমান পুঁজিবাদও বিদায় নিতে যাচ্ছে। এহেন মুহূর্তে বিশ্ব ও দেশের অর্থনীতি নিয়ে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে আলোকপাত করার যৌক্তিকতা স্পষ্ট।
কি আছে প্রাক্কলনে?
বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এটি আমাদের ব্যায়ের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে-আগামী অর্থবছরে আমাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটের আকার বৃদ্ধি হল-১২.২৮ শতাংশ।
বাজেটে মূলত তিনটি বিষয় অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যথা-আয়, ব্যায় ও ঘাটতি।
আগামী অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর অর্থ-ঘাটতি থাকবে-২ লক্ষ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল- ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশের অধিক ছিল। আগামী অর্থবছরে মোট বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি হল। শতাংশে তা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশের ও অধিক ।
এতো বিশাল ঘাটতি নিয়ে বাজেট প্রণয়ন রীতি চলতি অর্থ বছর থেকে শুরু! এর আগে এতো বিশাল ঘাটতি দিয়ে বাজেট প্রণয়ন হয়নি।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক যে পরিস্থিতি, সে বিবেচনায়ও নিঃসন্দেহে এ বাজেট উচ্চাভিলাষী।
বাজেটের পরিমাণ আয় লক্ষ্যমাত্রা ঘাটতি
চলতি অর্থবছর আগামী অর্থবছর চলতি অর্থবছর আগামী অর্থবছর চলতি অর্থবছর আগামী অর্থবছর
৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা। ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। টোটাল বাজেটের ৩৩ শতাংশ।
জিডিপির ৬.০২শতাংশ। টোটাল বাজেটের ৩৬ শতাংশ। জিডিপির ৬.৫ শতাংশ।
রেখা চিত্র: নিজস্ব চিত্রায়িত
দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা
সংক্ষেপে আমাদের দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক চিত্র হল-
-আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। গত ৮ মাসের ব্যবধানে এ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে এখন ৪৪ এ নেমেছে। আমদানী যে গতিতে বাড়ছে, রপ্তানী সে তুলনায় কম।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের নয় মাসে বাংলাদেশের আমদানি বিল গত বছরের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেড়েছে, যেটাকে ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এ গতিতে আমদানি এলসি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এ অর্থ বছরের রপ্তানী আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের আমদানী ঘাটতি দাঁড়াতে পারে- আগামী অর্থবছরে এটি মাথায় রাখতে হবে। আমদানীরীতি সংকোচন করতে হবে। নেপাল এরই মধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে।
ড. মইনুল ইসলাম সাহেবের মতো আমরাও বলতে চাই- ১৫০০ সিসির অতিরিক্ত ইঞ্জিন ক্ষমতার গাড়ি, বড় ফ্রিজ, এসি, বড় স্ক্রিনের টেলিভিশনসহ মহার্ঘ ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস, বিদেশী স্যানিটারি ফিটিংস ও বেকারি প্রডাক্টস, এনার্জি ড্রিংকস, কোমল পানীয়, বিদেশী মহার্ঘ ফল ইত্যাদির আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি এলসিতে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সেল গঠন করতে পারে, যেখান থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ ব্যতিরেকে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক এলসিগুলো চূড়ান্তভাবে অর্থায়ন করতে পারবে না।
মনে রাখতে হবে- শ্রীলঙ্কা, নেপাল এর দূরাবস্থার মাঝে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি একটি সতর্কীকরণ পয়েন্ট।
- রেমিট্যান্সের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে)। সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা। যা টাকার হিসাবে (এক ডলার সমান ৯০ টাকা) ১৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার বেশি।
শুধু মে মাসে আসা রেমিট্যান্সই আগের মাস এপ্রিল অপেক্ষা প্রায় ১২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার কম। আর গত বছরের একই মাসের (২০২১ সালের মে মাস) তুলনায় ২৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলার কম এসেছে। তবে আশা করা যায় তা অতিদ্রুত বৃদ্ধি হবে। ইতোমধ্যে সরকার তা বৃদ্ধির জন্য নানা উপায় গ্রহণ করেছে।
-বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা করছে। এ মুহূর্তটি বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময় । উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক নানা সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। বিশেষত আমাদের রপ্তানী বহুমুখী করতে হবে। শিক্ষায় বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে। বলতে চাই, কিছুটা কৃচ্ছতা সাধনের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে টেস্টিং সময়টি পার করা উচিত। যেনো দীর্ঘ মেয়াদী টেকসই অর্থনীতি অর্জনে আমরা নিজেদেরকে প্রমাণ করতে পারি। অপ্রয়োজনীয় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
-মুদ্রাস্ফীতি চরমে। এখনও প্রকাশ্য তথ্য মতে আমাদের মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ৭ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব সাপ্লাই চেইন ব্যহত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে। তবে আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টির পেছনে অভ্যন্তরীণ কিছু প্রভাবশালী বাজার খেলোয়ারও দায়ী।
-বিশ্ব বাণিজ্যে একাধিপত্য লেনদেন মুদ্রা অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্যও বেড়ে গেছে।
বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি কেমন হওয়া চাই
বর্তমানে বাজেট প্রণয়ন হয়ে থাকে সিংহ ভাগ মন্ত্রনালয় কেন্দ্রিক। একে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না। সরকারের আয় ও ব্যয় অনুমোদনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
এটি যতো বেশি করা যাবে তত বাজেট বাস্তবায়ন সহজ হবে। বাজেটের একটি প্রধান বিষয়- বরাদ্দ বা ব্যয়। কোন খাতে কত বরাদ্দ দিতে হবে, কত ব্যয় করতে হবে, সেটি জনগণ থেকে ব্যাপকভাবে শোনা উচিত। এর জন্য জেলাভিত্তিক ছোট ছোট বাজেট সেসন হতে পারে। সেখানে গণ মানুষ কথা বলবে। সেই কথাগুলো প্রধান সরকারের কাছে পৌঁছুবে।
এতে বাস্তব খাত ও প্রয়োজন উঠে আসবে। এরপর দ্বিতীয় প্রধান বিষয়-আয় খাত নির্ধারণ। সেটিও আলোচনা সাপেক্ষে করা সহজ। এতে সামাজিক পুঁজি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। অনেক ব্যয় খাত জনগণ নিজেরাই পূরণে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে দেখা যাবে ঘাটতি অনেকাংশে কমে যাবে।
ধরা যাক, একটি এলাকায় ১০টি স্কুল করতে হবে। ৫টি রাস্তা মেরামত করতে হবে। ২০টি নলকুপ বসাতে হবে। এসব প্রয়োজন নিয়ে এলাকাভিত্তিক আলোচনা হবে। সেখান থেকে প্রয়োজনগুলো বাস্তব হয়ে উঠে আসবে।
এ প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য প্রথমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এক্ষেত্রে ইসলামের ওয়াকফ ধারণা বেশ যুৎসই একটি ধারণা। যারা ওয়াকফে অংশগ্রহণ করবে সরকার তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। এতে সরকারের ক্ষতি নেই। বরং সরকারের বৃহৎ ব্যয় কমে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্য রীতির মতো বাজেট প্রণয়নে এসব চিন্তা নেই। অর্থাৎ এভাবেও চিন্তা করা যেতে পারে। এতে অর্থনৈতিক কল্যাণের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক যাকাত সংগ্রহ হবে। ঐ সংগ্রহ দিয়েই ঐ এলাকার প্রয়োজন মেটানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এভাবে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট বাজেট সামনে রেখে মূল বাজেট প্রণয়ণ হবে। সুতরাং আমরা Participatory budget concept এর উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের প্রস্তাব করছি।
সরকারের ব্যয় খাত: বাস্তবমুখী চিন্তা সময়ের দাবি
বাজেট আলোচনা সবচেয়ে আলোচিত অংশ সরকারের ব্যায় খাত। মূলত একে সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়। ব্যয়ের খাত হিসাবে সাধারণত ৫টি খাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়। যথা-
খাত
ভৌত অবকাঠামো
সামাজিক অবকাঠামো
সাধারণ সেবা খাত
সুদ আদায়
ভৌত অবকাঠামো
সাধারণত এ খাতেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকে। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল বাজেটের ২৯.৭৬ শতাংশ।
এর অধীনে আছে-ক. কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন। খ.বিদ্যুৎ ও জ্বালানী। গ. যোগাযোগ অবকাঠামো। ঘ.সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেক্টর।
উক্ত চারটি উপখাতে মধ্যে সাধারণত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ- ১১.৫১ শতাংশ।
যোগাযোগ অবকাঠামোর অধীনে আছে- সড়ক, রেলপথ, সেতু ও অন্যান্য। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ সড়ক বিভাগে। এ খাতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৫.৪৬ শতাংশ ।
এক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাবনা হল-
যোগাযোগ অবকাঠামোর একটি বৃহৎ অংশ আমরা ওয়াকফ এর মাধ্যমে সমাধান করতে পারি। প্রয়োজনে সুকুক এর মাধ্যমেও ফাান্ডিং করা যেতে পারে। নানা দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে-জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা গেলে এটি বেশি টেকসই হয় । ব্রিজ দিয়ে চলার সময় ‘এ ব্রিজ আমার টাকায় নির্মিত’ এ উপলব্ধি দেশের অগ্রযাত্রায় অনেক অবদান রাখবে নিঃসন্দেহে।
আমরা বলতে চাই, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের অধিকাংশই দুটি মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। এক. ওয়াকফ রীতি প্রতিষ্ঠা। দুই. মুশারাকা বা সুকুক প্রতিষ্ঠা। ইতোমধ্যে সরকার সুকুক চালু করেছে। তবে এর শরীয়াহ্ স্বচ্ছতা এখনও গড়ে উঠেনি। সঠিকভাবে শরীয়াহ্ অনুসরণ করে সুকুক বাস্তবায়ন করত এসব উন্নয়ণমূলক খাত বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
আমরা দেখেছি, এ খাতে সড়ক বিভাগের বরাদ্দ সর্বোচ্চ। গণ মানুষের সম্পৃক্ততায় সড়ক উন্নয়ন করা যেতে পারে। এরপর এ থেকে প্রাপ্ত টুল অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বণ্টন হবে।
এতে একদিকে সড়ক উন্নয়ন আরও সুদৃঢ় হবে। পাশাপাশি অর্থেরও সহজ সংস্থান হয়ে যাবে। সব কাজ সরকার-ই করতে হবে এমন চিন্তার পুনঃগঠন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। প্রকল্প বাস্তবায়ন যতো বেশি জনবান্ধব হবে তত বেশি সেটি দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। টেকসই হবে।
সামাজিক অবকাঠামো
সমগ্র বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ সামাজিক অবকাঠামো খাতে। এর অধীনে প্রধান শাখা খাত দুটি। যথা-
ক.মানব সম্পদ। এর অধীনে রয়েছে আরও তিনটি উপখাত। যথা-শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য।
খ. খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা। এর অধীনে রয়েছে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাত। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় থাকে শিক্ষা খাতের জন্য। শিক্ষা খাতের মাঝে মাদ্রাসা ও দ্বীনী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।
বর্তমান সরকার কর্তৃক কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়া একটি ভালো উদাহরণ। তবে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। দেশের কওমী মাদ্রাসার বিশাল ছাত্র সমাজকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিলে দেশের জন্যই তা কাজে আসবে।
যেকোনও বাজেটে তিনটি বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। যথা-
ক. দক্ষতা।
খ.স্বাস্থ্যখাত।
গ. সামাজিক সুরক্ষা।
দক্ষতার মাঝে শিক্ষাগত দক্ষতা উল্লেখযোগ্য। সুতরাং আমাদের প্রস্তাব থাকবে-কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস সমাপনকারীদেরকে প্রয়োজনে আরও এক বছর ‘ব্রীজিং সেসন’ করিয়ে সরাসরি তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারী-বেসরকারী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ দেয়া হোক।
পাশাপাশি আরব বিশ্বের সাথে মতবিনিময় করে সেখানকার ভার্সিটিগুলোতেও তাদের ভর্তির সুযোগ সৃষ্টির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা কামনা করছি।
আমরা আরও মনে করি, শিক্ষা খাতের ব্যয় হ্রাসের একটি একটি বড় উপায় যাকাত ব্যবস্থা। আমাদের দেশে বহু দরিদ্র ছাত্র/ছাত্রী রয়েছে। তাদের পেছনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। এখান থেকে তাদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে বাজেটের শীর্ষ ব্যয় অনেকাংশেই কমে যাবে বলে আশা করি। আমাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী এর ব্যয় দুই তৃতীয়াংশ হ্রাস পাবে। আর শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন হতে পারে ক্যাশ ওয়াকফ দিয়ে।
সামাজিক নিরাপত্তা
সামাজিক অবকাঠামোর দ্বিতীয় প্রধান খাত ‘সামাজিক নিরাপত্তা’। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এ খাতে। ফলে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। সুবিধাভোগী বাড়ছে প্রায় ১৫ লাখ।
জানা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের (পিআরএসপি) ১৪টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
এসব কর্মসূচিতে বর্তমান সরকার দরিদ্র জনগণের অবস্থা উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
এর অধীনে দরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিদেরকে শতভাগ বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১১২টি উপজেলায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী দরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিকে শতভাগ ‘বয়স্ক ভাতার’ আওতায় আনা হয়েছে। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ‘বয়স্ক ভাতা’ কার্যক্রমে উপকারভোগীর কাভারেজ বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী প্রাপ্য শতভাগ বয়স্ক মানুষকে অতি উচ্চ ও উচ্চ দারিদ্র্যভুক্ত গ্রুপের আরো ১৫০টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এতে করে আট লাখ নতুন উপকারভোগী যোগ হবে এবং এ খাতে ৪৮১ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হবে।
এছাড়া সর্বশেষ প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার জন বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বাবদ ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হবে।
আমাদের পর্যবেক্ষণ হল, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অধিকাংশ বরাদ্দ ব্যয় হয় সরাসরি দরিদ্র মানুষের পেছনে। আমরা চাইলে এক্ষেত্রে সহজেই যাকাত ব্যবস্থা কাজে লাগাতে পারি। এতে সরকারের একটি বড় ধরনের ব্যয় হ্রাস হবে বলে মনে করি।
সাধারণ সেবা খাত
সমগ্র বাজেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ সাধারণ সেবা খাতে। এর অধীনে প্রধান শাখা খাত দুটি। যথা-
ক.জনশৃংখলা ও নিরাপত্তা।
খ. অন্যান্য।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ সাধারণত ‘অন্যান্য’ খাতে থাকে। এর মধ্যে সরকারের পরিবহন সেবা, টেলি]কমিনিকেশন সেবা, স্বাস্থ্য সেবা প্রভৃতি রয়েছে।
এসব সেবার বেশ কিছু অংশ ওয়াকফ এর মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে। তাছাড়া সরকার তার সেবার মান বৃদ্ধি ঘটিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্বও উত্তোলন করতে পারে। পাশাপাশি জনগণের সম্পৃক্ততায়ও এসব সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। যেখান থেকে মুনাফার একটি অংশ জনগণও পাবে। এভাবে এ খাতকে আরও টেকসই করা যায়।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে আরও বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি ভবনে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিশ্চিত করা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদেরকে আরও উন্নত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। যন্ত্রপাতি আরও উন্নত করা। কপ্টার দিয়ে পানি সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ খাতে আমাদের উন্নয়ণ মোটেও প্রত্যাশিত নয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার ৮৯৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে গড়ে ক্ষয়ক্ষতি ২২১ কোটি ৬০ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ছোট-বড় ১০ হাজার ৯৯৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২১ কোটি ৯৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
আমার জনগণ-ই যদি সুরক্ষিত না থাকে, তাহলে মেগাপ্রকল্প দিয়ে কি করা হবে! একেকটি অগ্নিকাণ্ডে দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনীতি থেমে যায়।
সুদ আদায়
চলতি বছরের বাজেটে সুদ বাবদ ব্যয় ছিল চতুর্থ শীর্ষ ব্যয় খাত। এ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট প্রস্তাবিত ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ খরচ হবে সুদ পরিশোধে। (বাজেট বক্তব্য, পৃ.৩৭)
আগামী অর্থবছরে দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ ব্যয়ও বেড়েছে। পরিমাণে তা ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা ছিল ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এই সুদ কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে সেই ঘাটতি + ঋণ থেকে।
গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে (২০২১-২২) সুদ বাবদ পরিশোধের ব্যয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রায় দ্বিগুণ। ওই বছরে সুদ বাবদ ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ।
মোটকথা, এভাবে সুদ বাবদ ব্যয় প্রতি বছর বৃদ্ধি হচ্ছে! অথচ সুদ একটি ঝুঁকিপূর্ণ খাত। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এতো বিশাল অংকের সুদের উৎস সরকারের ঘাটতি বাজেট। যা পূরণ করতে দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে মোটা অংকের সুদ ভিত্তিক ঋণ করতে হয়।
তাহলে মূল সমস্যা ঘাটতি বাজেট। এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। এর জন্য জনবান্ধব রাজস্ব রীতি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পাশাপাশি ব্যয় খাতকে ‘হাজাহ’ ও ‘জরুরাহ’ নীতিতে সাজাতে হবে। তাহলে ঘাটতি হ্রাস হবে। ঘাটতি হ্রাস হলে সুদ ভিত্তিক ঋণও হ্রাস হবে আশা করি।
একটি মুসলিম দেশে সুদ বাবদ এতো বিশাল ব্যয় কি করে সম্ভব? এই সুদ তো মানুষের করের টাকায় আদায় করা হয়। ২০-২২ লক্ষ মানুষ যে কর দিচ্ছে, সেটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সুদ আদায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বলা হয়, গণতান্ত্রিক সরকার। জনগণের মতামত-ই-অগ্রগণ্য। অথচ জনগণের মতামত না নিয়েই তাদের টাকা দিয়ে সুদ আদায় করা হচ্ছে। সুদ ভিত্তিক ঋণ নেয়া হচ্ছে। ‘আপনি কর দিবেন, তা দিয়ে সুদ আদায় করা হবে। আপনি কি এতে রাজি আছেন’ এ ব্যাপারে মতামত জরিপ করা হোক। এরপর দেখা যাক, কতজন মানুষ সুদ দিতে রাজি হবে!!
মোটকথা, অর্থনীতি ও শরীয়াহ উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে সুদ ভিত্তিক ঋণ ও সুদ আদায় থেকে বিরত থাকা জরুরি।
এখন প্রশ্ন আসবে-সুদ ভিত্তিক ঋণ পরিত্যাগ করতে হলে ঘাটতি বাজেট পূরণ হবে কিভাবে, অথবা বলুন-সরকারের আয়-উৎস কিভাবে বের হবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর সামনে দেখবো ইনশাআল্লাহ।
প্রসঙ্গত, প্রাক্কলিত বাজেটে ব্যয়ে শীর্ষে আছে-পরিচালন ব্যয়। এবার আরও এক দফা সরকারী বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হবে। অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে যেখানে অন্যান্য দেশ সরকারী ব্যয় হ্রাস করছে, সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত তা বাড়িয়েই যাচ্ছি!
চলতি বাজেটে এ বাবদ ব্যয় আছে- ৬৯ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আগামীতে তা বেড়ে দাঁড়াবে- ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। এ ব্যয় চলতি অর্থবছর থেকে ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।
সামগ্রিকভাবে আগামী বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় বাড়বে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
আমরা যেভাবে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করছি-তা করাও উচিত, সেই তুলনায় দুর্নীতি বন্ধে, সরকারী কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি, জনগণেরে ভোগান্তি হ্রাস করতে-কতটুকু উদ্যোগ নিচ্ছি-তা কি খতিয়ে দেখা হচ্ছে? একেকটি সরকারী হাসপাতালের সেবার মান কি এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় আছে?
আরেক শীর্ষ ব্যয়:ভতুর্কি
আমাদের আগামী বাজেটে প্রণোদনা, নগদ ঋণ ও অন্যান্য ভতুর্কি বাবদ ব্যয় আছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, শুধু ভতুর্কি বাবদ ব্যয় চলতিতে ছিল ৫২ হাজার কোটি টাকা। আগামীতে তা হবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
এই ভতুর্কির বৃহৎ অংশ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, সার ইত্যাদিতে ব্যয় হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে যেখানে পুরো বিশ্বে সাতটি অনুসন্ধানে একটি গ্যাস কূপ পাওয়া যায় সেখানে বাংলাদেশ প্রতি ৩টি অনুসন্ধানে একটি গ্যাস পাওয়া যায় । তারপরেও আমরা গ্যাস আমদানি করে থাকি । গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতি, অদক্ষতা ও মজুদ গ্যাস যথাযথ সরবরাহ না করাই এর বড় কারণ।
খবরে প্রকাশ, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাসের মজুদ রয়েছে সাড়ে ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে স্থানীয় কোম্পানি তিনটি। দুটি কোম্পানি বিদেশী। দেশের মোট মজুদকৃত গ্যাসের ৮২ শতাংশেরও বেশি রয়েছে স্থানীয় কোম্পানি তিনটির আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয়। যদিও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের দৈনিক স্থানীয় সরবরাহের মাত্র ৩৭ শতাংশ দিতে পারছে কোম্পানি তিনটি। অপরদিকে গত মাস পর্যন্ত বিদেশী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৪৫২ দশমিক ৪ এমসিএফ, যা মোট স্থানীয় গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৬৩ শতাংশ।
গ্যাস পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও গ্যাস সরবরাহে আমাদের দেশীয় কোম্পানীগুলো পিছিয়ে। অনুসন্ধান তো পরের বিষয়। যা আছে তারই সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।
সার্বিকভাবে এসব ভতুর্কির পেছনে সাধারণত তিনটি প্রধান কারণ দায়ী। যথা-
১। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি, অদক্ষতা।
২।সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে দুর্বলতা, ম্যানেজম্যান্ট দুর্বলতা, পরিকল্পনায় দুর্বলতা।
৩। জনগণের দুর্নীতি। বহু মানুষ গ্যাস বিল আদায় করে না। বিদ্যূৎ বিল আদায় করে না বহু শিল্পপতি। নানা দুর্নীতির আশ্রয়ে এসব বিল ফাঁকি দেয়া হয়।
দৈনিক বণিক বার্তায় এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে-শুধু বেসরকারী গ্রাহকদের গ্যাস বিল বকেয়া আছে ৭৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প-কারখানার কাছে পাওনা ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। (বণিক বার্তা, অক্টোবর ৯, ২০২১)
এভাবে আমরা নিজেরাও অপ্রয়োজনীয় ভতুর্কি, ঋণ ও সুদের জন্য দায়ি। আমরা কি তা কখনও ভেবে দেখেছি?
সরকারের আয় খাত: বাস্তবমুখী চিন্তা সময়ের দাবি
বরাবরের মতো আগামী প্রাক্কলিত বাজেটেও আয়-উৎসে শীর্ষে আছে-কর। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বের ৮৫ শতাংশই কর রাজস্ব। প্রাক্কলিত আয়ের ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকার মাঝে এক এনবিআরকেই ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি অর্থ বছর থেকে তা ৪০ হাজার কোটি টাকা অধিক লক্ষ্যমাত্রা। অর্থাৎ ১২ শতাংশ বেড়েছে। সহজে বললে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা আরও এক দফা বাড়ল!
এই কর ভিত্তিক রাজস্বের মধ্যে শীর্ষ কর খাত-পরোক্ষ কর ‘ভ্যাট’। চলতি অর্থবছরে টোটাল কর খাতে এর অংশ ছিল ৩৯.২৯ শতাংশ।
এভাবে প্রতিনিয়ত আমরা কর বাড়িয়ে যাচ্ছি। গড়ে আড়াই-তিন লক্ষ টাকা বার্ষিক আয় থাকলেই আপনাকে আয়কর দিতে হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি যেখানে ৬ শতাংশ বা এরও বেশি। সেখানে এভাবে গড়পড়তা টাকার হিসাবে কর ধার্য করা অনুচিত। কর সবাই দিবে কেন?
নিম্নবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্ত কেন কর দিবে? কর দিবে শুধু ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তগণ। এর সাথে যদি Tax evasion হ্রাস করা যায়, কর ব্যবস্থাপনা সুসংগঠিত হয়, সাথে আমাদের প্রস্তাবিত সরকারী আয়-উৎসসমূহ যুক্ত হয়, (সামনে তা উল্লেখ হবে) তাহলে সামগ্রিকভাবে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আমাদের নীতি হয়ে গিয়েছে এরকম, এনবিআর কর উসূল করছে কম, ব্যস পরের বাজেটে কর আহরণ মাত্রা বৃদ্ধি করো, কর ও ভ্যাটের নতুন নতুন স্কোপ খুঁজে বের কর। কর কেন উসূল হলো না, ফাঁকি দেয়া কেন বন্ধ হলো না, তা দেখার সময় নেই। কর বাড়াও, গরিব শোষণ করো। ইদানীং কর বৃদ্ধি মানে ভ্যাট বৃদ্ধি হয়ে গেছে। যুলুমের আরেক নাম ভ্যাট।
চলতি অর্থবছরেও কর খাতের মাঝে ভ্যাট ছিল সর্বোচ্চ শীর্ষ খাত। আগামীতেও তা বহাল থাকবে বোঝাই যাচ্ছে। নানাভাবে ভ্যাট আরোপ করে মূলত দরিদ্র জনগোষ্টিকেই ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে।
ধরুন, আপনার আয় মাসে ২০ হাজার টাকা। আমার আয় এক লক্ষ টাকা। এখন আমরা দু’জনেই একটি পণ্য ক্রয় করলাম। ভ্যাট দিলাম ১ হাজার টাকা। তাহলে এটি হবে আপনার আয়ের ৯%। আর আমার আয়ের মাত্র ১%। অর্থাৎ আপনি আমার চেয়ে ৫ গুণ কম আয় করলেও ভ্যাট দিচ্ছেন আমার সমান। এর মানে হল-আমার আপনার মাঝে আয় বৈষম্য ছিল ৫ গুণ। এ অবস্থায় ভ্যাট সমান সমান দেয়ায় বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়ে গেল।
এই ভ্যাট সংস্কৃতি যে বা যারাই প্রচলনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা ভালো কোনও কাজ যে করেননি তা স্পষ্ট। এটি অত্যন্ত দু:খজনক।
মনে রাখতে হবে-শাসকগোষ্ঠী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-এই তিন প্রতিষ্ঠানদের কাছে ভ্যাট বেশ প্রিয়। কারণ এতে করের ভিত্তি প্রশস্থ হয়। এতে তারা আরও ঋণ দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে। কিন্তু শেষতক বৈষম্য বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে দরিদ্র জনগণ। আর উপকৃত হবে কেবল গুটিকতক পুঁজিপতি। অর্থনীতির ভাষায় যা ‘ট্রিকল ডাউন থিউরী’ নামে খ্যাত।
দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ -এ ধরনের ব্যাপক করকে বর্জনীয় বলে মন্তব্য করেছেন।
এর অর্থ এ নয়-কোনো কিছুর উপর ভ্যাট থাকবে না। ভ্যাট থাকবে। করও থাকবে। তবে সেটি নির্বিচারে বা গণহারে নয়। ভারসাম্য পথে হবে। হাঁ, সেটি কিভাবে হবে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে সে বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।
দ্বৈত কর: অন্যায়
বর্তমান দেশে নানা ভাবে দ্বৈত কর ব্যবস্থা রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অনায্য। যেমন- -এক পণ্যে তিন রকম কর। যথা- ক. ভোক্তা কর (ট্রেড ভ্যাট)। খ. ভিডিএস-ভ্যাট ডিডাকশন এ্যাট সোর্স বা উৎসে মূল্য সংযোজন কর। এটি ব্যবসায়ী পণ্য ক্রয়ের সময় দিতে হয়। গ. টিডিএস-ট্যাক্স ডিডাকটেড এ্যাট সোর্স। ব্যবসায়ীকে এটি পণ্যভেদে ১২-১৪শতাংশ দিতে হয়।
-ক্রেডিড কার্ডে বিল শোধ করার সময় একবার কর দিতে হয়। পরিমাণে তা ৪ শতাংশ। মার্চেন্ট যখন ব্যাংকে কমিশন প্রদান করে এর উপর আবার ১০শতাংশ কর কাটা হয়।
এছাড়া কর্পোরেট কর প্রায় ৪০ শতাংশ। যা একেবারেই উচিত নয়। এছাড়া নানা কর পদ্ধতি ন্যায্য নয়। যেমন, ব্যাংক থেকে কেউ টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করলে, সেটি এক বছরের জন্য নিলে যে কর, এক সপ্তাহের জন্য নিলেও সেই কর দিতে হয়।
মোটকথা, কর ব্যবস্থা প্রায়ই অনায্য, ইনসাফ বহির্ভূত হয়ে আছে। এর সুশৃংখল ইনসাফপূর্ণ অবকাঠামো তৈরি করা সময়ের দাবি।
এর জন্য আমাদের প্রস্তাব হল-অতি সত্ত্বর একটি জাতিয় কমিশন গঠন করা। এতে সাধারণ অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ থাকবেন। টেকসই অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতির আলোকে তারা একটি জাতীয় কর নীতি প্রণয়ন করে দিবেন। এতে আমরা আশা করি দেশ আর এগিয়ে যাবে।
ঘাটতি বাজেট: যা থেকে বের হওয়া উচিত
কোন নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে সরকারের রাজস্ব আয় অপেক্ষা ব্যয় অধিক হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। সাধারণত সরকার নতুন অর্থ সৃষ্টি, অতিরিক্ত কর আরোপ, অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করার জন্য উদ্যোগী হয়।
দুঃখের বিষয় হল, আমাদের দেশে এই ধরনের বাজেটই বেশি হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে একবারের জন্যও ঘাটতি বাজেট সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি প্রিয় বাংলাদেশ| ঘাটতি বাজেট আমাদের জাতীয় বাজেটের অন্যতম অংশ হয়ে আছে।
প্রতিবছরই ঘাটতি বাজেট করতে হয়। সাধারণত ঘাটতি থাকা দোষণীয় নয়। তবে ঘাটতি যদি অতি ঘাটতিতে রূপ নেয় তাহলে তা মুদ্রানীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। সরকারকে অতি মাত্রায় ঋণী করে তোলে। যা কোনও দেশের অর্থনীতির জন্যই ভালো নয়।
আমরা দেখেছি আসন্ন বাজেটের প্রায় ৩৬ শতাংশ-ই ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে সরকার সাধারণত ঋণের আশ্রয় নিয়ে থাকে। দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়।
অতীত তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসগুলোর মাঝে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। উদাহরণস্বরূপ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় বাজেটে ঘাটতি মোকাবেলায় সঞ্চয়পত্র ও ঋণপত্রের মাধ্যমে অর্থ সংস্থান করেছে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ব্যাংক খাত থেকে একই সময়ে একই উদ্দেশ্যে সরকারের ধার ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। উল্লিখিত ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যাংকঋণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৬০০ কোটি এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।
এভাবে দেশ থেকে সরকারের অতি ঋণ গ্রহণ নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। ঘাটতি বাজেটে যে সমস্যাগুলো তৈরি হতে পারে
ক. এর মাধ্যমে ‘আন্তঃপ্রজন্ম দায়’ বা ‘ইন্টার জেনারেশন ডেট বার্ডেন’ তৈরি হয়। ধরা যাক ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা তার সঞ্চিত অর্থ এবং কিছু ঋণ নিয়ে একটি বাড়ি তৈরি করলেন।
৬০ বছর বয়সী এমন বাবার তৈরি করা শখের বাড়ি তার সন্তানাদির মাঝে আনন্দের চেয়ে শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কারণ, সন্তানাদি ভাবতে পারে, বৃদ্ধ বাবার মৃত্যুর পরে বাড়ি তৈরির জন্য বাবার নেয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ তাদেরকেই পরিশোধ করতে হবে। সরকারের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
অর্থনৈতিক তথ্যমতে, আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকের উপর ঋণের দায়ের পরিমাণ ৯৮ হাজার টাকার অধিক। নিঃসন্দেহে তা প্রাক্কলিত বাজেট অনুযায়ী আগামীতে আরও বেড়ে যাবে।
খ. ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট’ তৈরি হওয়া। ধরা যাক সামগ্রিকভাবে এ দেশে ব্যাংকিং খাতের ঋণ সরবরাহের সক্ষমতার পরিমাণ ১০০ টাকা। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ব্যাংক থেকে এ অর্থ যে কেউ ঋণ নিতে পারে।
সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতাদের দুই ভাগে ভাগ করলে দাঁড়ায় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগ। এখন সরকার যদি অগ্রাধিকার বিবেচনায় ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে ঋণ নিয়ে নেয়, তখন বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ কমে যাবে। সুদের হার বৃদ্ধি তখন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এরূপ পরিস্থিতিকে অর্থনীতিতে ‘ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট’ বলা হয়।
গ. ঘাটতি করতে যেয়ে সরকারের ঋণ বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদগণের মতে, একটি দেশের জাতীয় ঋণ ঐ দেশের জিডিপির ৪০ শতাংশের নিচে থাকলে সেটি সহনীয় ধরা হয়। দেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন-ঘাটতি বাজেটের নামে আমাদের ঋণের হার গত কয়েক বছর ধরেই আশঙ্কাজনক স্তরে চলে গেছে।
ড. মুইনুল ইসলাম জানিয়েছেন- ‘২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপির ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল ৬২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় গত নয়-দশ মাসে বৈদেশিক ঋণ ৭২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে (কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রকৃতপক্ষে ৯১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে)’
ঘ. জিডিপির সাথে সমন্বয় না থাকা। অর্থনীতিবিদগণের মতে বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতির হার জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা সহনীয়। কিন্তু এটি চলতি অর্থবছরেও ৬.২ শতাংশে ছিল। আগামী অর্থবছরে নিশ্চিত তা বেড়ে যাবে।
ঙ. ঘাটতি বাজেটের আরেকটি মন্দ দিক হল-সুদ আদায়। প্রতিটি নাগরিক নিরবে তা করে যাচ্ছে। প্রাপ্ত কর ও ভ্যাট থেকে তা আদায় করতে হয়। দেশের অর্থনীতিতে এখনও জাতীয় সর্বোচ্চ শীর্ষ ৪ নং ব্যয়ের খাত ‘ সুদ আদায়’।
দেশের বাজেট বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাত জনাব আকবর আলী খানের মতে-‘ঘাটতি বাজেট কখন ইতিবাচক হয়? সাধারণত কোনো দেশ যখন মন্দায় আক্রান্ত হয়, তখন অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে তা ভূমিকা রাখে। তবে একে স্বাভাবিক রীতিতে রূপান্তর করে নেয়া হলে- সরকারকে তা দুর্নীতি করতে প্রলুব্ধ করে। বিলাসী ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। তখন জনগণের দায় বাড়তে থাকে’।
অন্যভাবে বলতে পারেন-ঘাটতি বাজেটের এই কেনইসীয় নীতি সরকারপক্ষকে অর্থনীতি নিয়ে খেল-তামাশা করতে অনেকটা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে সুবিধা দিয়ে থাকে।
প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ আরও মনে করেন-‘প্রয়োজনীয় কর আদায়ে ব্যর্থতা এবং রাষ্ট্রের ব্যয় হ্রাস করার অক্ষমতার ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছরই ঘাটতি বাজেট করতে হচ্ছে। এভাবে বছরের পর বছর ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে’।
করণীয়
অতএব ঘাটতি বাজেটের সংস্কৃতি ও তা পূরণের রীতি থেকে বের হয়ে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। বস্তুত ঘাটতি হয় আয়-উৎস ব্যয়ের সাথে সমন্বয় না হওয়ায় ও ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ায়।
অতএব প্রথমে ঘাটতি হ্রাস করতে হলে-আমাদেরকে আয়-উৎস নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমরা পশ্চিমা ধারায় কেবল কর ও ভ্যাটে আটকে আছি। বিদ্যমান কর রীতিকে আমাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সংস্কার করার পাশাপাশি প্রকৃত টেকসই অর্থব্যবস্থার আলোকে আমাদের আয়-উৎস বাড়ানো যায় কি না-তা খতিয়ে দেখতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে-সরকার কোনও প্রকার সম্পদ সৃষ্টি করে না। বরং সৃষ্ট সম্পদ থেকেই দেশ পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এর প্রধান উৎস ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ’।
‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ’: চিন্তার নতুন দিগন্ত
‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ’এর অধীনে পশ্চীমা ধারায় আমরা কেবল কর ও ভ্যাটে আটকে আছি। অথচ বর্তমান প্রকৃত টেকসই ও অগ্রসরমান অর্থনীতি তথা ইসলামী অর্থনীতির দুনিয়ায় এর অধীনে আরও নানা আয়-খাত রয়েছে। এ বিষয়ে আইএফএ কনসালটেন্সি-এর গবেষণা বিভাগ সম্প্রতি ‘জনবান্ধব বাজেট কৌশল: ইসলামী অর্থনীতির আলোকে’ শিরোনামে একটি বৃহৎ গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেছে। প্রায় ২৫০ পৃষ্টা ব্যাপী এই গবেষণায় বাংলাদেশের সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় আয়-খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ
খানে সেখান থেকে সারাংশ তুলে ধরা হল-
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আয়-খাত: ইসলামী অর্থনীতির আলোকে রূপরেখা
বাজেটের মূল বিষয় রাষ্ট্রীয় আয়-উৎস ও ব্যয় খাত। সুতরাং সঙ্গত কারণেই প্রথমে ইসলামী অর্থব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্রের আয়-খাত নিয়ে আলোচন করতে হয়।
ইসলামী খেলাফতকালে রাষ্ট্রীয় যেসব আয়-উৎস ছিল, সেগুলোর কিছু বর্তমানে অনুপস্থিত। যেমন, গনিমত, ফাই। আবার কিছু যুগের পরিবর্তনে হুবহু এখন প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। যেমন, জিযিয়া। তবে এর পরিবর্তে এখন যাকাত হারই কর হিসাবে অমুসলিমদের উপর প্রযোজ্য করা যাবে।
তদ্রুপ উশূর শুধু অমুসলিমদের উপর এখন প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। সকলের উপরই ভারসাম্য পন্থায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে খারাজ বহাল রাখা যায়। পাশাপাশি ইনসাফপূর্ণ কিছু অতিরিক্ত করও বহাল রাখা যায়। সব মিলিয়ে আমাদের দৃষ্টিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আয়-খাত যা হতে পারে-
১) যাকাত খাত। (বর্তমান ভাষায় একে ওয়েলথ ট্যাক্স বলা যায়। এর মধে উশর, খারাজও আছে)
২) শরীয়াহ অনুমোদিত কর।
৩) নিয়ন্ত্রিত ইনসাফপূর্ণ কর।
৪) সামাজিক পুঁজি।
৫) বিনিয়োগ।
৬) বিবিধ।
প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ:
উপরোক্ত আয়-উৎসমূহ বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে মোট ০৫টি টুল বা সেটাপের আশ্রয় নিতে হবে। যথা-
১) জাতীয়ভাবে সুদ বর্জন করতে হবে। যে দেশের অর্থনীতিতে সুদ স্বীকৃত, সে দেশে ইসলামী অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ৮০ সনে পাকিস্তানের ‘দ্যা কাউন্সিল অব ইসলামিক আইডলজি’ তাদের বিখ্যাত সুদমুক্ত ব্যাংকিং বিষয়ক জাতীয় প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছিল-‘এটি একটি স্বীকৃত বাস্তব বিষয় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও দেশের অর্থব্যবস্থায় সুদ বহাল থাকবে, ততদিন সেখানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না’। (সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন, পৃ.৯)
২) জাতীয়ভাবে যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আয়কর ও যাকাত এক সাথে চলতে পারে না। সুতরাং আয়কর নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। যাকাতকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৩) জাতীয় শরীয়াহ সুপারভাইজরী বোর্ড গঠন করা। ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তারা শরীয়াহ দিক-নির্দেশনা প্রদান করবেন। সরকারকে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে পথ দেখাবেন।
৪) ফিকহুল আওলাউয়্যিাহ (অগ্রাধিকার নীতি বিষয়ক ফিকহ) প্রতিষ্ঠা করা। এর অর্থ হল-অর্থনীতিতে শরীয়াহর আলোকে প্রথমে জরুরাহ খাত প্রাধান্য পাবে। জরুরাহ হল এমন খাত যা সমাধান না হলে মানুষের মৃত্যু বা চরম সংকট প্রবল হয়ে উঠে। এর মধ্যে আছে স্বাস্থ্য খাত উন্নয়ন করা। যা বর্তমানে অবহেলিত। এরপর হাজাহ খাত প্রাধান্য পাবে। হাজাহ হল এমন খাত, যা সমাধান না করা হলে মৃত্যু বা চরম সংকট হবে না। তবে কষ্ট হবে।
এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেট বন্ধ করা। ইত্যাদি। এরপর তাহসিনাত বা উন্নয়নমূলক ভালো কাজ। এতে জীবন মান উন্নয়ণ সংক্রান্ত কাজ অন্তর্ভুক্ত হবে। এভাবে অর্থব্যবস্থায় ফিকহুল আওলাউয়্যিাহ প্রতিষ্ঠা করা ও সে আলোকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
৫) দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা করা। স্বতন্ত্র ইসলামী অর্থনীতি ও ফিন্যান্স বিষয়ে বিভাগ ও ভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে দেশে ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান, চর্চা ও গবেষণা অগ্রসর হবে। যা রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে।
৬) জাতীয় অর্থ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে কালো টাকা উদ্ধার, পাচারকৃত অর্থ, বিদেশী নাগরিকদের উপর কর, অতিরিক্ত মুনাফায় কর, সরকারী সেবার মান বৃদ্ধি করত যৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি থেকেও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
একটি তুলনামূলক চিত্র
উপরোক্ত টুলসমূহ বাস্তবায়নের পর ইসলামের অর্থব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্রীয় আয়-খাত গড়ে তুলতে হবে। এতে দেশের সমূহ কল্যাণ নিশ্চিত হবে বলে আশা করি। ইসলামের রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যবস্থা নিয়ে পূর্বে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
বর্তমান সময়ে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে রাষ্ট্রীয় আয়-উৎস থেকে সম্ভাব্য রাজস্ব আয় ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এর অবদান নিম্নে তুলে ধরা হল-(পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের ২০২১-২২ বাজেটের সাথে একটি তুলনাও দেয়া হল। আগামী অর্থবছরের বিস্তারিত আর্থিক বিবরণ প্রকাশ হওয়ার পর এর আলোকে তারও তুলনা করা যাবে। )
উক্ত রেখা চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, টোটাল মোট বাজেটের ৯৬.৮৫ শতাংশ উঠে আসে আমাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী। ইসলামী অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে আমাদের অর্থনৈতিক চিত্র কেমন হতে পারে এর একটি ধারণা এখান থেকে পেতে পারি। আমাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২১-২২ বাজেটের মধ্যে বাকি থাকে শুধু ৩.১৫ ঘাটতি। যা সহজেই করজে হাসানা থেকে পূরণ করা সম্ভব। বরং আরও উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। করজে হাসানায় আমাদের প্রাক্কলন ছিল মোট বাজেটের ৮.২৮ শতাংশ।
এখানে লক্ষ্য করুন, আমাদের চলতি বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ উঠে আসে যাকাত ও ওয়াকফ খাত থেকে। বাকি মাত্র ৩০ শতাংশের জন্য আমাদেরকে অন্যান্য খাত ব্যবহার করতে হয়। ঘাটতি একেবারেই গৌণ। অপরদিকে আমাদের বাজেটে ঘাটতি এক তৃতীয়াংশের অধিক। এরপর যা আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, তাও পুরোপুরি উঠে আসেনা। যতুটুকু উঠে আসার প্রাক্কলন করা হয়েছে সেখানে কর-ই প্রধান। পরিমাণে তা ৮৩.৫৭ শতাংশ। এর মধ্যে ভ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ। টোটাল রাজস্বের ৩২.৮৪ শতাংশ। সর্বোচ্চ শতাংশ।
আরও দেখুন-আমাদের চলতি বাজেটের ৫৩.৮৮ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে কর থেকে। অথচ আমরা দেখেছি ওয়াকফ খাত থেকে ৪৯ শতাংশ উঠে আসে। যাকাত থেকে উঠে আসে ১৮ শতাংশ। বিনিয়োগ খাত থেকে উঠে আসে ১৬ শতাংশ। শুধু এই তিন খাত-যাকাত, ওয়াকফ ও বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করলেই আমরা আমাদের বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ পেয়ে যাই।
এবার তাহলে প্রশ্ন হয়, আমরা কেন কর নির্ভর রাজস্ব ধরে রাখবো? কেন আমরা যাকাত ও ওয়াকফ বাস্তবায়ন করবো না?
যাকাত ও কর: তুলনামূলক হিসাব
যাকাত অবশ্যই একটি ইবাদত। এটি কোনো কর নয়। আমাদের দেশে করদাতা মাত্র ২০-২২ লক্ষ মানুষ। (পৃ.১২)। এর মধ্যে ফাঁকিবাজ তো আছেই। এরপর সেই কর সীমাহীন।
অপরদিকে সংখ্যায় যাকাতা দাতা ১০ কোটির বেশি হবে। আদায়ের হারও মাত্র ২.৫%। এর উপর ফসলের যাকাত তো আছেই। ১ লক্ষ টাকায় যাকাত আসে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। ১০ কোটি মানুষ মাত্র ১ লক্ষ টাকার যাকাত দিলে ২৫ হাজার কোটি টাকা উঠে আসে। বাকি হিসাব নিজেরাই করে নিতে পারবো আমরা।
সালাফের যুগে যাকাত ব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রীয় আয়ের অন্যতম উৎস। যে এলাকা থেকে যাকাত আদায় করা হতো, সেই যাকাত ঐ এলাকার দরিদ্রদের মাঝেই বিতরণ করা হতো। সুতরাং কর বর্জন করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যাকাত উত্তোলন করা সময়ের দাবি। তবে এর জন্য মযবুত শরীয়াহ্ বডি ও বিতরণ কমিটি লাগবে। যেনো যথাযথ খাতে যাকাত বিতরণ হয়।
অভিজ্ঞজন মনে করেন, শুধু ফসলের যাকাত দিয়েই সংশ্লিষ্ট এলাকার খাদ্য সংকট দূর করা সম্ভব। দরিদ্রতা দূর করা সম্ভব। কেনো সালাফের যুগে কর ব্যবস্থা চালু না করেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেটা এখান থেকেই বোধগম্য।
জনগণের যা করা উচিত
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতিতে ভর্তুকি ও সুদ বাবদ ব্যয় দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। শুধু এ দুটি খাতেই আমাদের বাজেটে ব্যয়ের ৫৭ শতাংশ ব্যয় হবে।
নানা ধরনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ভর্তুকি যেনো না দিতে হয়, ঘাটতি যেনো অতি মাত্রায় রূপ না নেয়-সে দিকে সরকারের যেমন লক্ষ্য রাখা উচিত, তেমনি জনগণ হিসাবে আমাদেরও দায়িত্ব ভুলে গেলে চলবে না।
মনে রাখতে হবে, শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে বা নসিহত করে ফায়দা নেই। আমাদের সবাইকে আগে ঠিক হয়ে যেতে হবে। দেশটি আমাদের সবার। আমাদের প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে নিজ দায়িত্ব আদায়ে যত্মবান হওয়া, নীতি ও নৈতিকতাকে ধারণা করা, সর্বোপরি এক আল্লাহর দাসত্বে নিজেকে সোপর্দ করে দেয়া একান্ত জরুরী।
এভাবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের দেশ ইনশাআল্লাহ এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যা করতে হবে-
-সরকারের নানা বিল যথাসময়ে আদায়ে যত্নবান হওয়া উচিত। যেনো বিল অনাদায়ী থেকে ভর্তুকী সৃষ্টি না হয়।
-প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
-সরকারের ন্যায্য কর যথা সময়ে আদায় করতে হবে।
-সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম সরকারের উপর না চাপিয়ে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সেটি করার চেষ্টা করতে হবে। ধরা যাক, একটি এলাকার রাস্তা নির্মাণ করা দরকার। এগুলো নিজেরাও উদ্যোগ নিয়ে করা যায়। এক্ষেত্রে ‘সাদাকায়ে জারিয়ার’ কনসেপ্ট ছড়িয়ে দিতে হবে।
প্রিয় মাতৃভূমি, তোমার জন্য এতগুলো কথা। আমাদের সাধ্য সীমিত। সীমিত সাধ্যে তোমার কল্যাণের কথাগুলো তুলে ধরলাম। তোমার কোনও হিতাকাঙ্খি এসব বিষয়ে প্রকৃত টেকসই অর্থনীতির আলোকে আরও বিশদ আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা, মতবিনিময় করতে চাইলে আমরা প্রস্তুত।
ইতোমধ্যে-‘জনবান্ধব বাজেট কৌশল: ইসলামী অর্থনীতির আলোকে’ নামে আড়াইশ পৃষ্টার একটি দীর্ঘ গবেষণা আমরা সম্পন্ন করেছি। যদি তোমার কাজে আসে এই আশায়। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক। আমীন। আল্লাহ সুবহানাহু একে কবুল করুন। উপকারী বানিয়ে দিন। নাজাতের ওসিলা করুন।
-এটি