এফাজ মোবারক।।
সবকিছুর একটা মানদন্ড থাকে যেটার উপর ভিত্তি করে প্রত্যেক জিনিস যাচাই বাছাই করা হয়। তার মান বিচার করা হয়। যেমন প্রতিটি মুসলমানের মানদণ্ড হলো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা প্রত্যেকেই তার আমল আখলাক আচার আচরণে দিকে দৃষ্টিপাত করে নিজেকে মাপি—তার মতো হতে কতটুকু মেহনত করতে হবে, কত মোজাহাদা করতে সে অনুযায়ী চেষ্টা করি। তার থেকে নিজেকে তুলনা করলেই আমার কমতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নিজেকে শুধরে নেওয়ার আগ্রহ পয়দা হবে।
এখানে আমি সাহিত্যের মানদণ্ড নিয়ে কথা বলবো। ইসলাম পূর্ব যুগে আস-সাবয়ূল মুয়াল্লাকা বা ঝুলন্ত কবিতা নামে যে গ্রন্থটি ছিলো সেটাই ছিলো আরবি সাহিত্যের সর্বোচ্চ মানদণ্ড। যে কোন কবি সাহিত্যিক তার কোন কোন কবিতা লেখার পর ওটাকে আস-সাবয়ূল মুয়াল্লাকার কাছে এনে মান যাচাই করতো। কেউ যদি তার চেয়ে ভালো কবিতা লিখতে পারতো তার কবিতাটাও সেখানে স্থান দেওয়া হতো। কুরআন আসার পর সেটাই হয় সর্বোচ্চ মানদণ্ড। এবং তার পরের স্থান হয় আস-সাবয়ূল মুয়াল্লাকা। হজরত আলী রাযি. বলেন, তোমারা যদি আরবির কোন বিষয় না বুঝো প্রথমে কোরআন দেখো, তারপর দেখো আস-সাবয়ূল মুয়াল্লাকা।
এমন মানদণ্ড প্রত্যেক ভাষা সাহিত্যে বিরাজমান। ইংরেজি সাহিত্য শেক্সপিয়ার জন মিল্টন এদের রচনাবলি ইংরেজি সাহিত্যে ভিত্তি ও সর্বোচ্চ চিরায়ত সাহিত্য। এখন পর্যন্ত এই কবিতা নাটকগুলোই ইংরেজি সাহিত্যের মান বিবেচিত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে অনেকেই তার পরবর্তী স্থান দখল করে নিয়েছেন। এভাবে ভাষা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। বাংলা আর ইংরেজি ভাষার সাহিত্য ও বয়স একই। তবে ইংরেজি ভাষায় যে পরিমাণ সাধনা করা হয়েছে তা বাংলায় করা হয়নি। অন্যের দ্বারা শাসন হয়ে তারা তাদের ভাষায় ঐতিহ্য ও গুরুত্ব হারিয়েছে। বাংলা ভাষার যখন অন্ধকার যুগ তখন ইংরেজি সাহিত্যের উত্থান।
বিভিন্ন রাজার শাসন ভাষাকে পরিবর্তন করে দেয়। একেকজন রাজা এসে একেক ধরনের সভ্যতা সংস্কৃতি এনে হাজির হন সেগুলো জনগণের উপর চাপিয়ে দেন। কখনো বাংলা ভাষায় ফার্সির প্রভাব বেশ ছিলো। আফগান তুর্কীরা যখন এদেশ শাসন করে। একসময় উর্দুরও সংমিশ্রণ ঘটে প্রচুর। এরপর ইংরেজদের প্রভাব তারা বাংলা ভাষাকে নিজেদের মতো করে ব্যকরণ রচনা করে৷ নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করায়। ফার্সি উর্দু থেকে বাংলাকে প্রভাবমুক্ত করে। প্রচুর সংস্কৃত ভাষার প্রবেশ ঘটায়। কেননা তখন বাংলার হিন্দু মুসলিম সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি ছিলো। ইংরেজরা আসায় হিন্দুদের প্রভাব প্রতিপত্তি জোরদার হয়। বঙ্কিমের সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান হয় ঘৃণার পাত্র। সেইসব সাম্প্রদায়িক সাহিত্য নিয়ে অন্য একদিন বলবো।
বাংলা আধুনিক সাহিত্যে তখন উল্লেখ যোগ্য স্থান করে নেয় বঙ্কিম, শরৎ, রবিন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল এদের সাহিত্যগুলো মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। একেরপর এক যুক্ত হতে থাকেন, বুদ্ধদেব বসু, জসিমউদ্দীন, আবুল ফজল, মানিক বন্দোপাধ্যায়, আলী আহসান, আব্দুল মান্নান। এরপর আসেন জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ আবুল হাসান, শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, শামসুল হক, কাজী আলাউদ্দিন প্রমুখ আরো অনেকেই। এই ধারাবাহিকতা আমাদের একবিংশ দশক পর্যন্ত বিস্তৃত। এরাই হলেন মূল ধারার। যাদেরকে ভাষা সাহিত্যে মূল ধারার লেখক সাহিত্যিক বলা হয় এরাই তারা।
এখনো অনেকেই মূল ধারার সাহিত্য রচনা করে চলছেন। অনেকে বিপরীতেও আছেন। একেকজন একেক ধারার। আমাদের অবস্থান যেহেতু বর্তমানে এজন্য অনেক বিষয়ই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে। আমাদের বর্তমান যুগকে কেউ সাহিত্যে স্বর্নযুগও বলেন আবার খান সাহেবের মতে অন্ধকার যুগও বলেন কেউ কেউ। দুই ধারারই লোকজন বেশ। এখন আমাদের সাহিত্যে তো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বই যুক্ত হচ্ছে। তো আমারা এসব বইয়ের মান কিভাবে বিবেচনা করবো; অবশ্যই আমাদের পূর্ববর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ রচনাবলীর সাথে তাকে তুলনা করে। কিংবা সমকালীন যারা আছেন প্রথম সারির তাদেরকে দিয়ে।
সমকালীনদের মধ্যে দুইভাগ দৃশ্যমান। একভাগ যারা জনপ্রিয় আর বহু বিক্রিত বইয়ের উপর তাদের মান ধরে নেন। আরেকভাগ নিরবে সাধনা করে যান কোন সময় কাল যুগের ধার ধারেন না। তাদের বই বিক্রির সংখ্যা নগন্য এবং বইও অল্প। তাদের পরিচিতিও স্বল্প। এখানে কোন ধারারই নাম উচ্চারণ করে বিভেদ তৈরি করতে চাই না। সমস্যার বিষয় হলো—আমাদের নবীন লেখকদের লেখাগুলো আমারা কিভাবে মান বিচার করে থাকি? তাদের সাহিত্যকর্মগুলো বর্তমান কোন ধারার লেখকদের সাথে তুলনা করবো! এইসব প্রশ্ন এখন প্রধান আলোচনার বিষয়।