কওমি মাদরাসাগুলোতে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। শিক্ষা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নতুন পথ চলা মসৃণ করতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কি ধরনের ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারেন, এজাতীয় নানা দিক নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর মাদরাসা দারুর রাশাদের শিক্ষা সচিব মাওলানা লিয়াকত আলী। আলোচনায় উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতার বিষয়টিও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
এবার কোন ঝামেলা ছাড়াই শুরু হয়েছে কওমি মাদরাসাগুলোর নতুন শিক্ষাবর্ষ, শিক্ষার্থীদের কিছু বলতে চাইবেন কি?
আল্লাহ তায়ালার রহমতে যেহেতু এবার আমরা কোন ধরণের ঝামেলা ছাড়াই সঠিক সময়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে পেরেছি, তাই আমাদের উচিত হবে এখন থেকেই সময়ের মূল্যায়ন করা ও এর সঠিক ব্যবহার করা। গত দুই বছরে সিলেবাস শর্ট করে পরীক্ষা দিতে হয়ে এবার আর সে বিষয়টির প্রয়োজন হবে না।
গত বছর বোর্ড পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা নিয়ে একটি বিতর্ক সামনে এসেছিল, এ বিষয়ে বিশেষ কোন পরামর্শ দিতে চাইবেন কি?
‘পরীক্ষার জন্য পড়া নয়, পড়াশোনার মান যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা’- কওমি মাদরাসার মূল দর্শনই হলো এটা।
পড়াশোনার মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা। এটাই মূলত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দর্শন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু সাধারণ শিক্ষায় দুঃখজনকভাবে পড়াশোনার বিষয়টি পরীক্ষা কেন্দ্রীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কওমি মাদরাসায় এক সময় চিন্তাই করা যেত না যে, শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও নির্দিষ্ট বিষয় বেছে বেছে পড়বে আর তুলনামূলক কম গুরুত্বের বিষয়গুলো বাদ দিবে।
এতোদিন যেভাবে পরীক্ষা হয়ে আসছিল এতে করে বোর্ডের দায়িত্বশীলদের মনে হয়েছে, শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, তাই তারা প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন এনেছেন শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন ও বাচাই-বাছাইয়ের জন্য, এটাই স্বাভাবিক।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের কওমি মাদরাসায় পরীক্ষা খুব একটা কঠিন হয় না যেমনটা সাধারণ শিক্ষায় হয়।
শিক্ষার মূল দর্শন হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা হবে বই-পুস্তক নির্ভর। এরপর বিষয় নির্ভর, এরপর গবেষণা নির্ভর। সেই দিক বিবেচনায় দাওরা-মেশকাতের পরীক্ষা গবেষণা নির্ভর হওয়া কাম্য ছিল কিন্তু তারপরও অনেক সময় সহজ করা হয়।
দাওরা-মেশকাতের পরীক্ষার প্রশ্ন এমন হওয়াই উচিত ছিল যাতে করে যাচাই করা যায় যে একজন পরীক্ষার্থীর চিন্তা, গবেষণা ও অনুসন্ধানের যোগ্যতা কতটুকু হয়েছে। সুতরাং বিবেচনা করে দেখলে সহজেই বুঝা যাবে যে আমাদের প্রশ্নগুলো অনেক সহজ হয়।
এখন যে ঢালাওভাবে মুমতায, জায়্যিদ জিদ্দান, জায়্যিদ হচ্ছে, যাচাই করলে দেখা যাবে এমন অনেক ছাত্র আছে যাদের যোগ্যতা আসলেও অনেক কম।
প্রশ্নপত্রের ধরনে পরিবর্তন বিষয়ে কোন মতামত দিতে চাইবেন?
আমাদের ব্যবস্থাপনায় আরো পরিবর্তন আনা দরকার। প্রশ্নপত্রে এখন একটা ধরাবাধা নিয়ম হয়ে গেছে যে, পাঁচটা প্রশ্ন থাকবে এরমধ্যে তিনটার উত্তর দিতে হবে। এই নিয়মের পরিবর্তন দরকার।
সাধারণ শিক্ষায় একজন মাস্টার্স ও অনার্স পরীক্ষার্থীর পুরো ৪ ঘন্টা সময় পরীক্ষা দিতে হয়। অনার্স পর্যায়ে ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথমে যেই খাতাটা দেওয়া হয় সেটাই হয় ২৪ পৃষ্ঠার। মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রথমেই দেওয়া হয় ৩২ পৃষ্ঠার খাতা। অথচ আমাদের মাস্টার্স অর্থাৎ দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষার প্রথম খাতাটা দেওয়া হয় মাত্র ৮/১২ পৃষ্ঠার খাতা। এরপর ১ পাতা করে লুজ দেওয়া হয়। আর সাধারণ শিক্ষায় লুজ-ই দেওয়া হয় ১২ পৃষ্ঠা।
শুধু দাওরার পরীক্ষা বাদে বাকি পরীক্ষাগুলো বেফাকে রাখা হয়েছে, তাই বেফাকের উচিত পরীক্ষাগুলোর মান বজায় রাখা।
সার্টিফিকেট কাজে লাগাতে বোর্ড পরীক্ষার মান বিষয়ে আপনার পরামর্শ জানতে চাই
আমার মতে সরকারের স্বীকৃতি কাজে লাগানোর জন্য মেশকাতের পরীক্ষাটাও হাইয়াতুল উলইয়ার অধীনে হওয়া উচিত। কারণ পৃথিবীব্যাপী নিয়ম হল, গ্রাজুয়েশনের পরীক্ষাগুলো বোর্ড নয় বরং কোন ইউনিভার্সিটির অধীনে হতে হবে। আর যেহেতু হাইয়াতুল উলইয়া একটি প্রশাসনিক ইউনিভার্সিটি হওয়ার মর্যাদা রাখে তাই ফযীলত পর্যায়ের পরীক্ষাটা হাইয়াতুল উলইয়ার অধীনে করা যেতে পারে।
আরেকটি বিষয় হল, মেশকাত পর্যন্ত আমাদের মাদরাসাগুলোতে ৩ বছরের সিলেবাস পড়ানো হয়। অথচ বোর্ড পরীক্ষা হয় মাত্র ১ বছরের সিলেবাস নিয়ে, বাকি প্রথম ২ বছরের পরীক্ষা নেয় মাদরাসাগুলো। এতে করে ওই দুই বছরের পড়াশোনাগুলোর সঠিক তদারকি করা সম্ভব হয় না। সেজন্য আমার মতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাকে মূল্যায়ন করতে ফযীলত পর্যায়ের ৩ বছরের পরীক্ষাগুলো এক সাথে হাইয়ার অধীনে নিয়ে আসা উচিত হবে ।
দাওরা হাদিসের পরীক্ষা হয় শুধু হাদীসের উপর। দাওরায়ে হাদীসের বর্তমান যে সিলেবাস এটা অনেক সহজ। আগে উলুমে হাদীস ও উসুলে হাদীসের উপর ভিত্তি করে ৫০ নাম্বার ছিল এখন সেটা নেই। এতে করে পরীক্ষা আরো সহজ হয়ে গেছে।
বছরের শুরুতে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া কতটা জরুরি?
বছরের শুরু থেকেই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অন্যথায় হঠাৎ করে কোন নিয়ম করলে অস্বস্তিতে পড়বে শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সহায়ক কোর্স চালু হয়েছে, এগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা উপকারী?
এর দুইটি দিক। প্রথম হল, সময় যদি পরিকল্পনা অনুযাযী কাজে লাগানো হয় তাহলে এক সাথে অনেক কাজ করা সম্ভব। আমাদের মাদরাসাগুলোতে ক্লাসের পাশাপাশি শুক্রবার ছুটি থাকে, কোথাও বৃহস্পতিবারও হাফ ক্লাস হয়। কুরবানী ও পরীক্ষার সময়গুলোতেও ছুটি থাকে। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সময় কাজে লাগালে এই ছুটিগুলোতে এসব সহায়ক কোর্সে সময় দেওয়া উপকার হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য।
আরেকটা দিক হল এক সঙ্গে অনেক দিকে মনোযোগ দিলে সবগুলোতেই দুর্বলতা আসে , তাই শুধু পড়াশোনাতেও মনোযোগী হতে পারলে ভালো।