।।আবদুল কাইয়ুম শেখ।।
রহমত ও মাগফেরাতের দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে নাজাতের সময় শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মাহে রমজানের বিদায়ের করুণ সুর বেজে উঠেছে! অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পবিত্র রমজানুল মোবারক বিদায় নেবে! কিন্তু এই রমজান ও রোজা আমাদের জন্য বেশকিছু শিক্ষা রেখে যাবে। মুসলমানদের জন্য সমীচীন হলো রোজার সেই শিক্ষাগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করা। রোজার শিক্ষামালা অনুযায়ী আগামী দিনে পথ চলা। তাই এখানে আমরা রোজার কিছু শিক্ষা নিয়ে আলোকপাত করছি :
তাকওয়া অবলম্বন : মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী রোজার প্রধান শিক্ষা হলো তাকওয়া অবলম্বনে অভ্যস্ত করা। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা, নিবৃত্ত থাকা ও ভয় করা। ব্যবহারিক অর্থে আল্লাহর ভয়, খোদাভীতি, দ্বীনদারি ও ধার্মিকতা বোঝায়। আর ইসলামি পরিভাষায় মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। তাকওয়া অবলম্বন বা সর্বপ্রকার দুরাচার বর্জন করাই রোজার অন্যতম প্রধান শিক্ষা। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে দুষ্ট জিন ও শয়তানদেরকে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে তারা লোকদেরকে পাপের কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। এ কারণে মানুষের মধ্যে অন্যায়, অনাচার ও অপরাধের প্রবণতা কমে আসে। তাদের মধ্যে তাকওয়া অবলম্বন করার যোগ্যতা তৈরি হয়। তারা বহুলাংশে খোদাভীরু হয়ে ওঠে। রোজা মানুষকে তাকওয়া অবলম্বন করতে শেখায়। আর সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন 'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।' (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
সহমর্মিতা অর্জন : মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসকে 'সহমর্মিতার মাস' বলে আখ্যায়িত করেছেন। একজন রোজাদার যখন সুবেহ সাদেক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে তখন সে ক্ষুধার জ্বালা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। জঠর জ্বালায় তার গলা শুকিয়ে যায়! মুখে এক ধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়! সে তৃষ্ণা ও পিপাসায় কাতর হয়! ফলে তার মধ্যে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার বাস্তব উপলব্ধি জাগ্রত হয়। সে হাতে-কলমে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে। তার মধ্যে সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয়। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার যেন তার কবিতায় এ কথাই ব্যক্ত করেছেন :
'চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে?
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।'
সহমর্মিতা জ্ঞাপন করার জন্যই মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে অধিক পরিমাণে দান করতেন। হযরত ইবনু আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজান মাসে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল আ. তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল আ. তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন এবং তারা একে অপরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহমান বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন।'
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬)
ধৈর্যধারণ করা : হাদিসে রমজান মাসকে 'ধৈর্যের মাস' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রোজা মানুষকে ধৈর্য ধারণ করতে শেখায়। ফলে যখন কোন ব্যক্তি রোজা রাখে তখন সে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। তার সামনে বাহারি খাবার থাকা সত্ত্বেও আহার করে না। কোমল পানীয় হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও পান করে না। অন্দরমহলে সুন্দরী রূপসী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সহবাস করে না। এমনকি আচার-আচরণ এবং উচ্চারণেও ধৈর্য ধারণ করে। ক্ষুধার কষ্ট ও পিপাসার জ্বালা সহ্য করে। রোজা তাকে ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা প্রদান করে। হাদিস শরিফেও রোজাদারকে ধৈর্যধারণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার!' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)
ইখলাস তথা নিষ্ঠা : রোজা মানুষকে একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য আমল করার শিক্ষা দেয়। একজন রোজাদার যখন রোজা রাখে তখন তার জন্য সুযোগ থাকে, সে সেহরির সময় পরিবারের সকলের সঙ্গে সেহরি খাবে এবং ইফতারের সময় লোকদের সঙ্গে ইফতার মাহফিলে যোগ দেবে। সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য এই সুযোগও থাকে যে, দিনের বেলা রেস্তোরাঁ কিংবা ভোজনশালায় গিয়ে পানাহার করবে। লোক চক্ষুর অন্তরালে নিজের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণ করে রোজার অভিনয় করবে। কিন্তু প্রকৃত রোজাদার এমনটি করে না। তার মধ্যে ইখলাস তথা আন্তরিকতা কাজ করে। আল্লাহ তাআলার জন্য রোজা রাখার বিষয়টি কাজ করে। সে মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কেবল রোজা রাখে। এ জন্যই হাদিসে কুদসিতে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব!' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)
আল্লাহ সঙ্গে থাকার অনুভূতি : যখন কোন ব্যক্তি রোজা রাখে তখন তার জন্য দিনের বেলা পানাহার করার অনেক সুযোগ থাকে। সে ইচ্ছা করলে কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে পারে। লোক চক্ষুর অন্তরালে আহার করতে পারে। পানীয় পান করতে পারে। নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে। জঠরজ্বালা দূরীভূত করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত রোজাদার এগুলো করে না। কারণ তার মধ্যে এই বিশ্বাস জাগ্রত থাকে, যদিও কোন ব্যক্তি দেখছে না, কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঠিকই আমাকে দেখছেন। তিনি আমার সঙ্গে আছেন। রোজা রোজাদারের মধ্যে আল্লাহ তাআলা সঙ্গে থাকার উপলব্ধি জাগ্রত করে এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান থাকার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান থাকার বিষয়টি মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এভাবে এসেছে, 'তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন তোমরা যেখানেই থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।' (সুরা হাদিদ, আয়াত : ০৪)
ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব : আল্লাহ তাআলা রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন ও সাদা-কালো প্রাপ্তবয়স্ক সকল মুসলমানের উপর রোজা ফরজ করেছেন। তারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ তারাবির নামাজ আদায় করে। অনেক সময় একই দস্তরখানে সম্মিলিতভাবে ইফতার গ্রহণ করে। বহু মানুষ পবিত্র রমজানে জাকাত আদায় করে এবং সদকাতুল ফিতর প্রদান করে। এগুলো ধনী ও নির্ধনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করে। এসব বিষয় রোজাদারদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। তারা একে অপরকে ভাই ভাবতে শেখে। সামর্থ্যবান লোকদের ওপর সদকাতুল ফিতর প্রদান করা অপরিহার্য করার উদ্দেশ্যও তাই। হযরত ইবনু আব্বাস রা. বর্ণনা করেন : ‘মহানবি সা. সদকাতুল ফিতর অবধারিত করেছেন অশ্লীল কথা ও অর্থহীন কাজ হতে মাহে রমজানের রোজাকে পবিত্র করার জন্য এবং গরিব-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৯)
উপসংহার : রোজা বহুবিধ শিক্ষা ও তাৎপর্যময় এক অনন্য ইবাদত! মানব জীবনে এর উপকারী অনেক প্রভাব রয়েছে। রোজার শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে ধারণ করা গেলে পবিত্র মানুষ হওয়া যাবে এবং সুন্দর জীবন গঠন করা সম্ভব হবে। তাই আসুন! রোজার শিক্ষাগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করে পবিত্র ও আলোকিত মানুষ হই! মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১২।
-কেএল