শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

‘অকাল মৃত্যু’ বলা কি ঠিক হবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।শেখ খালিদ সাইফুল্লাহ।।

আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে কালো রঙের এমন কিছু ব্যানার অথবা ফেস্টুন যাতে ‘অকাল’ শব্দের সাথে ‘মৃত্যু’ যোগ করে ‘অকাল মৃত্যু’ লিখে শোক বার্তা প্রদর্শন করা হয় এবং সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ঢালাওভাবে ঐ একই রূপে শোকবার্তা প্রচার করা হচ্ছে।

আবার কোন কোন শোক দিবস আলোচনায় অনেকের বক্তব্যে এমনটাই উচ্চারিত হতে দেখা যায়। যেমন:-অমুকের অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত! লোকটি যে বয়সের ই হোক; এ যুগে অনেকেই মারা গেলে কালো রঙের উপর এরকম লিখে শোক প্রকাশ যেন আধুনিকতায় পরিণত হয়ে গেছে! আর শোক-প্রকাশ মূলক কথায় ‘অকাল মৃত্যু’ শব্দটি যুক্ত করা অবশ্য কর্তব্য বা অঘোষিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি?এভাবে ‘অকাল মৃত্যু’ লেখা বা বলা আদৌ কি সঠিক হচ্ছে? ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

মৃত্যু এমন একটি বিষয় এমন এক অমোঘ বিধান যা কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না,যা থেকে কেউ পালাতেও পারবে না,আল কোরআনের শাশ্বত বাণী- "প্রত্যেক প্রাণী কেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে"।এই চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সকল মানুষ এই একটি ব্যাপারে একমত এবং এর উপর নিশ্চিত বিশ্বাস অন্তরে লালন করে যে,সবার মৃত্যু হবেই হবে,তাই বলা হয় ''Man is mortal'' বা মানুষ মরণশীল। সুতরাং মৃত্যু একটি সর্বজনীন স্বীকৃত ও চিরন্তন সত্য বিষয়।

এবার"অকাল মৃত্যু" নিয়ে আলোচনা করা যাক - "অকাল" মূলত একটি সংস্কৃত শব্দ,ব্যুৎপত্তি দিক থেকে- অ (অপ্রশস্ত; অশুভ) + কাল(সময়;যুগ)= অকাল ধরা হয়। সংস্কৃতে অকাল মানে 'অশুভ কাল’ বলে বিবেচিত হত,পরবর্তীতে হিন্দি তে ‘অকাল’ শব্দ দুর্ভিক্ষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলায় যার অর্থ:- অসময়,দুঃসময়,আকস্মিক অপরিণত সময়, অশুভ সময়, ইত্যাদি। যেমন: 'অসময়' অর্থে-(দুয়ারে পা বাড়াতে ই চোখে পড়ল মেঝের পরে এলিয়ে পড়া ওর অকাল ঘুমের রূপখানি- অকাল ঘুম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

ইংরেজিতে অকাল-(bad season, Premature time)অকাল মৃত্যু -(Premature death) অর্থাৎ অশুভ সময়ে মৃত্যু, দুঃসময়ে মৃত্যু, অসময়ে মৃত্যু ইত্যাদি

কিন্তু আমরা মুসলমান! আমাদের মুখ থেকে এরূপ শব্দ উচ্চারণ করা কিংবা হাত দিয়ে লিখা ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি? অথচ আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেক প্রাণীর জন্য ‘মৃত্যু’ যেমন অনিবার্য; তেমনি তার সময়-কাল, দিনক্ষণ ও নির্ধারিত। সেই নির্ধারিত সময়েই তার মৃত্যু হবে। এতে নূন্যতম এদিক-সেদিক হবে না। এটাই তকদিরের লিখন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-"আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেননা, তা সুনির্ধারিত"। (সূরা আলে ইমরান : ১৪৫)
যেহেতু হায়াত এবং মউতের মালিক একমাত্র সৃষ্টিকর্তার। তাই তিনি ভালো জানেন কার কখন,কোথায় মৃত্যুর পরোয়ানা পাঠাতে হবে,কী অবস্থায় মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন- "অতঃপর যখন তাদের নির্ধারিত সময় উপস্থিত হয়, তখন তারা মুহূর্ত কাল বিলম্ব অথবা তরান্বিত করতে পারবে না"।(সূরা নাহল)

মৃত্যুর সময় যেমন আল্লাহর কাছে সুনির্ধারিত। তেমনি আল্লাহর ইলমে (জ্ঞানে) তার মৃত্যুর ধরন ও নির্দিষ্ট। তিনি তাঁর ইলম দিয়ে জানেন ঐ ব্যক্তির মৃত্যু এতদিন পর এভাবেই হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-"কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত"।(সূরা লুক্বমান) অন্য আয়াতে বলেন,"আর আল্লাহর বিধান সুনির্দিষ্ট,অবধারিত"।(আল-আহযাব)

সুতরাং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি হুকুম নির্ধারিত সময়ে ই ঘটবে,এর সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটবে না। তিনি যা চান,তা ঘটে। আর যা চান না, তা ঘটে না।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ রা. বলেন-‘আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, ‘আসমান-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আল্লাহ সব কিছুর তকদির লিখে রেখেছেন।(মুসলিম শরীফ : ২৬৫৩)অন্য এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল ইরশাদ করেন-‘তকদিরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না’।(মুসনাদে আহমাদ : ৬৭০৩)

এ ধরনের অসংখ্য কোরআনের আয়াত এবং হাদীস রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়- মানুষের মৃত্যুকাল সুনির্ধারিত,মৃত্যুর ধরণ সুনির্দিষ্ট এবং তা তকদির অনুযায়ী হয়।

অতএব সব মৃত্যু সঠিক সময়ে ই হয়, অকালে নয়; নির্ধারিত ভাবেই হয়, অপ্রত্যাশিত কিংবা আকস্মিক মৃত্যু নয়। এমনটা বলা ইসলামী চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

তাছাড়াও ‘অকাল মৃত্যু’ বলার দ্বারা কয়েকটি মারাত্মক বিচ্যুতি প্রকাশ পায়-

এক. সবার হায়াত যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং সুনির্দিষ্ট, ‘অকাল’ বলার দ্বারা পরোক্ষভাবে তা অস্বীকার করা হয়।

দুই. আর যারা অসময়ে বা অপরিণত বয়সের অর্থে "অকালে মৃত্যু" হয়েছে বলেন। তাদের কথায় প্রতীয়মান হয় যে, উনারা ঐ মৃত ব্যক্তির হায়াত সম্পর্কে জানতেন, এবং কিভাবে মৃত্যু হবে সেটাও জানতেন। মা'আজ আল্লাহ! প্রকারান্তরে উনারা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন বলে স্বীকারোক্তি দিলেন। যা কিনা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মানবজাতির বৈশিষ্ট্য নয়।

তিন. এরূপ বলে আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ধারিত সময়ের আগে বান্দাকে মৃত্যু প্রদানের পরোক্ষ অভিযোগ আরোপ করা হয়। যেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাকে অভিযোগের সুরে বলা হচ্ছে যে,লোকটি চাইলে আরো অনেকদিন বেচে থাকতে পারতো, আপনি তাকে অকালে মৃত্যু দিলেন কেন? অকাল মৃত্যু বলতে বোঝায় কালের আগে মৃত্যুবরণ করা। অর্থাৎ- মৃত্যুবরণ করার কথা ছিল অমুক তারিখ, আল্লাহ তায়ালা এর আগেই দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন। নাউজুবিল্লাহ! এতে আল্লাহর মর্যাদার ক্ষুণ্ণ হয়।

চার. অল্প বয়সে,মহামারিতে অথবা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে কিছু মানুষ অপমৃত্যু,অকাল মৃত্যু, খারাপ মৃত্যু ইত্যাদি বলে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বাড়িয়েও বলেন- 'পোড়া কপাল! মরার আর সময় পেল না'- বলে সম্বোধন করে। নাউজুবিল্লাহ! একজন মুসলমানের কাছে কোন মৃত্যুই অশুভ হতে পারেনা। বরং ইহা উপহার স্বরূপ-একটি নেয়ামত!
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মৃত্যু হল মু’মিনের উপহার। (বায়হাক্বী’র শু‘আবুল ঈমান-৯৪১৮)

তবে হ্যা! কিছুকিছু মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে বড় ই কষ্ট হয়, এই মৃত্যুগুলো আমাদেরকে ভাবায় এবং কাঁদায়! তাই বলে এতে "অকাল মৃত্যু" বলার কোন অবকাশ নেই। এজন্য আমরা যারা জীবিত আছি আল্লাহর হুকুম কে অমান্য বা অস্বীকার না করে বরং তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া-ই হবে আমাদের এবং তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপকারের বিষয়। এছাড়া একেকটা মৃত্যু হচ্ছে আমাদের জন্য শিক্ষা। আমরাও যেন তৈরি থাকি আমাদের শেষ গন্তব্যের জন্য।

তাই আসুন ‘অকাল মৃত্যু’ বলার এই ভ্রান্ত সংস্কৃতি পরিহার করি। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত হায়াতের উপর সন্তুষ্ট থাকি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য বুঝা ও তদোনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন;আমীন!

তথ্যসূত্র:-
মা'রিফুল কোরআন
তাফসীরে ইবনে কাসীর
বাংলা ভাষার ব্যকরণ- প্রফেসর মাহবুবুল আলম
সংসদ বাংলা অভিধান- শৈলেন্দ্র বিশ্বাস
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান- মুহম্মদ এনামুল হক - বাংলা একাডেমী

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক; ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলূম হুসাইনিয়া মাদ্রাসা, সিলেট।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ