শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার 'উলামায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব'   নিউইয়র্কে যাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার গাজাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ২৮ ফিলিস্তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত 'ঢাবি ও জাবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে' ঢাবিতে যুবক হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩ জন আটক কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে বিসিএস এ অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া বৈষম্য: মুফতী ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই  সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ

ফেসবুক লাইভে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা: কী বার্তা দিয়ে গেল আমাদের!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

ফেসবুক লাইভে এসে ব্যবসায়ী মহসিনের আত্মহত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে। এ ঘটনার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, পশ্চিমা জীবন যাপনের প্রতি ঝুঁকে পড়া শ্রেণীর হতাশা, একাকীত্ব ও অসহায়ত্বের এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

আত্মহত্যার আগে লাইভে এসে ব্যবসায়ী বলেছিলেন,  ‘আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি’। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে লাইভে এসে মৃত্যুর পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, দেশের বাইরে থাকা স্বজনেরা কেউ তাৎক্ষণিক তার খবর নিতে আসেনি। দেশে থাকা মেয়ে জামাইও হাসপাতাল থেকে তার বডি নিয়েছেন বেশ দেরিতে। এ সময় শশুরের আত্মহত্যা বিষয়ে কোন ধরনের কথাও বলতে চাননি তিনি।

দেশের অভিজাত এলাকার আলীশান বিল্ডিংয়ে বসবাসকারী ব্যবসায়ীর এমন মৃত্যু ও পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আন নূর জামে মসজিদের খতিব ও মাদরাসা আবু রাফে (রা.)-এর পরিচালক মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাঙালি ও মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে যেই পারিবারিক বন্ধন ও হূদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এই ঘটনা সেই পরিবার ব্যবস্থাকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে গেল’।

‘সন্তান অথবা পিতা-মাতা একে অপরকে অসহায় করে ছেড়ে যাওয়ার মত অমানবিকতার লেশমাত্র নেই আমাদের পরিবারগুলোতে। এর বিপরীতে পশ্চিমা বিচ্ছিন্ন পরিবার ব্যবস্থাকে অনুকরণের এক ধরণের চেষ্টা চলছে বর্তমান সমাজে। এই ঘটনার মাধ্যমে সেই অন্ধ অনুকরণের বিপদজনক দিকগুলো ফুটে উঠেছে’ বলেন তিনি।

কেউ বিপত্নীক বা পরিণত বয়সে উপনীত হলে তার অধিকার বিষয়ে ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট। ইসলাম কোন ব্যক্তিকে কখনো এক ঘরে একাকী থাকার অনুমোদন দেয় না, এমনকি একাকী সফরের অনুমতিও নেই ইসলামে। বাবা-মাকে একাকী ছাড়ার বিষয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে উল্লেখ করে  তিনি বলেছেন, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَىٰ مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ ۚ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

 

তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরাঃ আন-নূর, আয়াতঃ ৩২)

এখানে ‘আয়ামা’ অর্থ শুধু অবিবাহিত নয় বরং যে একাকী (সিঙ্গেল) রয়েছে তাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সাবালক কেউ যেন একাকী না থাকে তার সঙ্গীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

মানুষ সামাজিক জীব সে কখনো একা থাকতে পারবে না, একাকী থাকলে তার মাঝে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। মানুষের একাকী থাকার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে ইসলামে। কিন্তু বর্তমান পশ্চিমা সমাজব্যবস্থার অনুকরণ করতে গিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এর কুফল হচ্ছে এই ঘটনাগুলো- মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব।

‘সাহাবাদের জীবনেও এমন ঘটনাটা ঘটেছে। তারাও একাকী হওয়ার পর আবার নতুন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন’।

‘জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে জৈবিক চাহিদা মূখ্য বিষয় থাকে না বরং এখানে একে অপরকে সঙ্গ দেওয়া, অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ািই এর মূলে থাকে। তাই বাবা-মা দুজনের কেউ একাকী হয়ে গেলে সন্তানদের অবশ্য কর্তব্য হলো তাদের জীবনসঙ্গীর ব্যবস্থা করে দেওয়া’।

এদিকে ফেসবুক লাইভে এসে ব্যবসায়ী মহসিনের আত্মহত্যার ঘটনাকে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের অবক্ষয়ের বার্তা বলে উল্লেখ করেছেন আরবি ভাষার শিক্ষক ও রাজধানীর মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়ার পরিচালক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী

তিনি বলেছেন, ‘ ছোটবেলা থেকে একটা সন্তানকে তিলে তিলে বড় করতে গিয়ে বাবা-মা হাজার স্বপ্ন বুনে থাকেন, তাদের সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় আঘাত হানলো এ ঘটনা’।

তার মতে, ‘ধীর-স্থিরভাবে চিন্তাভাবনা করা, প্রত্যেক বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা মানা, ধৈর্যের সাথে কোন বিষয়ে কাজ করার বিপরীতে প্রবৃত্তির অনুসরণের যে প্রবণতা চালু হয়েছে বর্তমান সমাজে; এ ঘটনাগুলো তারই প্রমাণ বহন করছে’।

আরবি ভাষার এই শিক্ষক আরো বলেছেন, ‘ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে বর্তমান এলিট শ্রেণীর যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এ ঘটনাগুলো তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আজকাল অনেকেই কোন বিশেষ আয়োজনকে ভিত্তি করে নামমাত্র দ্বীনি মজলিস অথবা আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। বেশি ভাগ সময় তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকছেন। তার নানাবিধ ক্ষতির প্রকাশ হচ্ছে এসব ঘটনার মাধ্যমে’।

‘এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হল সন্তানকে দ্বীনের বুঝ এবং এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করা যাতে তারা বুঝতে পারে যে বাবা মাকে কখনো একা ছাড়া যাবে না এবং তাদের শেষ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে’।

‘বাবা-মা ছোটবেলা থেকেই সন্তানের হক ঠিকমত আদায় করছেন কিনা, আবার সন্তান বাবা-মার খোঁজ রাখছে কিনা সব বিষয়ের প্রতিও লক্ষ রাখতে হবে’- মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।

মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলছেন, ‘দুটি সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়’ পশ্চিমা স্লোগানকে অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকেই এক অথবা দুইয়ের অধিক সন্তান নিতে চান না, অথচ তারা একটিবার ভাবেন না; কষ্ট ঘামে অর্জিত অঢেল সম্পদ কে ভোগ করবে অথবা তার জীবদ্দশাতেই এই সন্তান মারা গেলে পরবর্তীতে পুরো জীবন কিভাবে একাকী কাটবে’!

তিনি আরো যুক্ত করেছেন, ‘আমাদের অনেক মন্দ চর্চার মধ্যে এটাও একটা যে, উচ্চ বিলাসী জীবনের জন্য সন্তানদের দূরে অমুসলিম দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অথচ ইসলাম বিশেষ প্রয়োজনে নিজ মাতৃভূমিছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, প্রয়োজন শেষে আবার চলে আসার কথা বলেছে। কিন্তু পশ্চিমা সুযোগ-সুবিধা নিতে সন্তানদের দূরে ঠেলে দিয়ে আমরা নিজেদের কষ্ট ঠেলে দিচ্ছি যা সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী’।

ধর্মীয় মূল্যবোধ ছেড়ে আমরা যখন অন্যদের অনুসরণ ও রবের অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছি তখন কুরআনের ভাষ্যমতে,

ظهر الفساد في البر والبحر بما كسبت ايدي الناس

‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে... (সূরা রূম ৪১ আয়াত)

কুরআনের আয়াতকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, এ সবকিছুই আমাদের নিজের হাতের কামাই।

এই খতিব আরো বলেন, ‘এই ভদ্রলোকের জন্য আফসোস হচ্ছে। তবে তিনি একটা ঘৃণ্য কাজের মাধ্যমে বর্তমান সমাজকে এবং সমাজের রুচিবোধকে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছেন। গুলশান-বনানীর মত অভিজাত এলাকাগুলোতে এমন আরও অনেক মহসিন বসে আছেন একাকীত্ব  নিয়ে। সমাজ চিন্তক ও রাজনীতিবিদদের উচিত ঘরে ঘরে মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া ও সমস্যার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা উচিত। অন্যথায় এমন আরো অনেক মহসিন-এর খোঁজ মিলবে অল্প দিনেই।

আরবি ভাষার শিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী বলেছেন, ‘জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের বিধি-বিধানের গুরুত্ব বুঝা ও তা মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ইসলাম সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের কর্তব্য, বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য এবং প্রতিবেশীর কতটুকু খোঁজখবর নিতে হবে সবগুলো বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘ইসলাম এবং ইসলামি নিদের্শনা মেনে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

‘অনেকেই আত্মহত্যা না করার বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, বিভিন্ন মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে চলেছে এরপরও তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, এর মূল কারণ হলো, মোটিভেশনাল বক্তব্য দিলেও ইসলামী চেতনাবোধ এবং ইসলামি শিক্ষার যে আহ্বান তারা তা ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই ইসলাম এবং ওলামায়ে কেরামের সাথে সাধারণের সম্পৃক্তা বাড়াতে হবে’ বলেন তিনি।

এটি/ এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ