আব্দুল কাদির আল মাহদি
বার্সেলোনা স্পেন থেকে>
আবু হুরায়রা রা থেকে বর্ণিত। এক দিন নবী সা. মসজিদে তাশরীফ আনলেন, তখন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করলো। অতঃপর সে নবী (সা)-কে সালাম করলো।
নবী সা. তার সালামের জবাব দিয়ে বললেনঃ তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর, কেননা, তুমি সালাত আদায় করনি। লোকটি আবার সালাত আদায় করল এবং আবার এসে নবী সা.-কে সালাম দিল। তিনি বললেনঃ আবার গিয়ে সালাত আদায় কর, কেননা, তুমি সালাত আদায় করনি। এভাবে তিনবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল।
অতঃপর লোকটি বলল, সে মহান সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি এর চেয়ে সুন্দর সালাত আদায় করতে জানি না। কাজেই, আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন।
তখন তিনি বললেনঃ যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে, তখন তাকবীর বলবে। অতঃপর কুরআন হতে যতটুকু তোমার পক্ষে সহজ ততটুকু পড়বে। অতঃপর রুকূ‘তে যাবে এবং ধীরস্থিরভাবে রুকূ‘ আদায় করবে। অতঃপর রুকূ‘ হতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। ধীরস্থিরভাবে সিজদা করবে। অতঃপর সিজদা হতে উঠে স্থিরভাবে বসবে এবং পুনরায় সিজদায় গিয়ে স্থিরভাবে সিজদা করবে। অতঃপর পুরো সালাত এভাবে আদায় করবে। (বুখারি)
হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা. এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সালাত আদায় করছে। সে রুকু ও সিজদা পুর্ণরূপে আদায় করছে না। সে যখন তার সালাত শেষ করল, তখন হুযাইফা রা. তাকে জিজ্ঞাস করলেন।
কতদিন যাবত এভাবে সালাত আদায় করছ? লোকটি জবাব দিলেন চল্লিশ বছর যাবত এমনভাবে সালাত আদায় করছি। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান বললেন তুমি চল্লিশ বছর থেকে সালাত পড়নি। তিনি এও বলেছিলেন যে, এভাবে সালাত আদায় করে তুমি যদি মারা যাও, তাহলে মুহাম্মাদ সা. -এর তরীকা হতে বিচ্যুত হয়ে মারা যাবে। (বুখারি)
ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি রুকু ও সিজদাহ করে তার পিঠ সোজা করে না, তার সলাত পূর্ণাঙ্গ হয় না। (ইবনে মাজাহ)
কাজেই একথা দলীল দ্বারা সুস্পষ্ট যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল কিন্তু রুকু অথবা সিজদার পর সোজাসুজি দাঁড়াল না তার সালাত বাতিল হয়ে গেল। এভাবে সালাতের বাকি প্রত্যেক রুকুনের ক্ষেত্রেও ধীরস্থিরতা প্রযোজ্য।
আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. বলেন, আমি রাসুল সা.-কে বলতে শুনেছিঃ এমন লোকও আছে (যারা সালাত আদায় করা সত্ত্বেও সালাতের রুকুন ও শর্তগুলো সঠিকভাবে আদায় না করায় এবং সালাতে পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও খুশু-খুযু না থাকায় তারা সালাতের পরিপূর্ন সাওয়াব পায় না)।
বরং তারা দশ ভাগের এক ভাগ, নয় ভাগের এক ভাগ, আট ভাগের এক ভাগ, সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ্ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ, বা অর্ধাংশ সাওয়াব প্রাপ্ত হয়। (আবু দাউদ)
নামাজের চুরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় চুরি। রাসুল সা. বলেন, ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর সেই ব্যক্তি, যে নামাযে চুরি করে। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাযে আবার কীভাবে চুরি করে? তিনি বললেন, ‘রুকু-সিজদা পরিপূর্ণভাবে করে না। (আহমাদ)
মহান আল্লাহ তাআলা সফলকাম মুমিনদের গুণাবলী বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রথমেই বলেন- মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র (সূরা মুমিন ১,২)
আর সালাতে বিনয় কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই অর্জন করে যে তার অন্তরকে এতে নিবেদিত করে এবং তার মন এতে ব্যস্ত থাকে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নেক বান্দাদের গুণাবলীর মধ্যে খুশু-খুযুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং তিনি তাদের জন্য ক্ষমা ও পুরস্কার হিসেবে উত্তম ব্যবস্থা প্রস্তুত করে রেখেছেন।
আল্লাহ তা’আলা সফলতাকে সালাতে বিনয় ও নম্রতার সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। কাজেই যে বিনয়-নম্রতা ব্যতিরেক নামাজ আদায় করল সে সফলকামীদের অন্তর্ভূক্ত হল না।
আর এমন চিন্তা করা অসার, তাড়াহুড়া ও ব্যতিব্যস্ত থেকে সালাত আদায়ে বিনয় অর্জন হবে। বরং বিনয় আসে ধীরস্থির ও শান্তশিষ্টতা দ্বারা। যত বেশি ধীরস্থিরতা অভ্যাস গড়া যাবে তথ বেশি খুশু-খুযু পয়দা হবে।
সালাতে খুশু-খুযু পয়দা হওয়ার ধারাবাহিক কয়েকটি পন্থা উল্লেখ করব-
প্রথমত, সালাত আদায়ের পূর্ব থেকে সালাতের জন্য প্রস্তুতি শুরু করা। যখন আমরা মুয়াজ্জিনের আজান শুনব তখন তার শাব্দিক ও কর্মিক জবাব দেব। মুয়াজ্জিন বলেন “তোমরা কামিয়াবির দিকে অগ্রসর হও” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবি। একথা শুনার পর একজন মুসলমান সালাতের দিকে অগ্রগামী হওয়া উচিত যে কামিয়াবির তুলনা অন্য কিছুর সাথে হয় না।
দ্বিতীয়ত, আজন শুনে নামাজের জন্য ওজু শুরু করব। ওজুতেও ধীরস্থিরতা বজায় রাখব। কারন ওজু হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র এবাদত এবং ভালভাবে ওজু করা তথা খেয়াল করে প্রত্যেক অঙ্গপ্রতঙ্গ ধুয়া, যাহা আগত সালাতকে প্রভাবিত করে। ওজু দ্বারা বান্দার ছোট ছোট গুনাহ ঝরেপড়ে। আর ওজু স্থান হচ্ছে সালাতের ভূমিকা স্বরুপ। কাজেই ধীরস্থিরে মনযোগ সহকারে ওজু সালাতে আরও খুশু-খুযু পয়দা করে।
অতঃপর মসজিদের দিকে সালাত আদায়ের জন্য অগ্রগামী হতে যাব। মসজিদের দিকে আগত ব্যক্তির প্রতি কদমে বান্দার দরজা বুলন্দ হয় ও গুনাহ মাফ হয়। কাজেই কত গুনাহ ঝরে পড়ছে! কত সাওয়াব অর্জন হচ্ছে! সেটার অনুধাবন যাতে দিলের ভিতর থাকে।
অতঃপর মসজিদে যখন প্রবেশ করতে যাব তখন মসজিদে প্রবেশের আদবের প্রতি খেয়াল করে দুআ পড়ে ঢুকব। একথা স্বরন রাখব যে আমি এমন এক জায়গায় প্রবেশ করছি যে জায়গাটি রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও তাওবা কবুলের জায়গা। ফেরেশতাকূল যেখানে বান্দাদের স্বাগত জানান! বলতে থাকেন আল্লাহুমাগফির লাহু আল্লাহুমার হামহু!
অতঃপর সম্ভবনাময় সময় থাকলে দুখলিল মসজিদ সালাত দুরাকাত পড়ব। যেটা আমাকে আল্লাহ তা’আলার নিকট নিয়ে যাচ্ছে অতঃপর সম্ভব হলে কোরআন তেলাওয়াত করব, দু’আ করব, ইস্তেগফার করব। এগুলো হচ্ছে আমাকে পর্যায়ক্রমে আল্লাহ তাআলার নিকটে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম।
অতঃপর নামাজের আগে দ্বিতীয় রিমাইন্ডার আসে একামত। মুয়াজ্জিন আবার বলেন “আপনি সফলতার দিকে আসুন”! আপনি তখন সালাত আদায়ে পুরাপুরি প্রস্তুত। এতক্ষণ আজান থেকে শুরু করে ইক্বামত পর্যন্ত সবগুলি কাজ পর্যায়ক্রমে আপনার মন মানসিকতাকে দুনিয়া থেকে আল্লাহ তা’আলার দিকে ট্রেন্সফার করে দিচ্ছে। যেগুলো সালাতে খুশু-খুযু পয়দা হওয়ার পুরাপুরি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অতঃপর যখন সালাত শুরু হবে, সালাতের ভিতর মনযোগ সহকারে তিলাওয়াত করুন অথবা শুনুন। অর্থা জানা থাকলে দিল দিয়ে অনুধাবন করুন। কারণ কোরআন অনুধাবন সালাতে মনযোগ আকর্ষণ করে তুলে।
অতঃপর নামাজের ভিতর প্রতিটি রুকুন মনযোগ সহ ধীরস্থিরে আদায় করুন। একথা দৃঢভাবে স্বরন রাখবেন যে আমি মহান রাব্বুল আলমিনের সামনে দন্ডয়মান।
কাজেই রুকু করুন রুকুর হক্ব আদায় করে। সিজদাহ করুন ধীরস্থিরে মনযোগ সহ। কারণ, আপনি আপনার সব চেয়ে সম্মানি অঙ্গ- মাথাকে আল্লাহ তা’আলার সামনে ঝুকিয়েছেন। স্বরন রাখবেন! এই মাথা ঝুকানো সম্মানের এবং আল্লাহ তা’আলার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনের। রাসুল (সা) বলেন বান্দা আল্লাহ তা’আলার সব চেয়ে নিকটবর্তি হয় যখন সে সিজদাহ করে।
হিজরী ৩য় শতাব্দীর একজন প্রসিদ্ধ ও আল্লাহ ওয়ালা সালফ- যার নাম “হাতিমুল আসিম”। তাকে খুশু-খুযু প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হল । তিনি বলেন- যখন আযান শুনবে সাথে সাথে নামাজের জন্য পবিত্রতা হাসিল কর। তারপর মসজিদের দিকে চল। আল্লাহ তা’আলার বড়ত্বকে সামনে রেখে সালাত শুরু কর।
ধীরধিরে কোরআন তিলাওয়াত কর, নম্রতার সাথে রুকু কর, বিনয়ের সাথে সিজদাহ কর, ইয়াক্বিনের সাথে তাশাহহুদ পড়, ইতমিনানের সাথে বস। একথা চিন্তা কর যে জান্নাত আমার ডানে, জাহান্নাম আমার বামে, মালাকুল মাওত আমার পিছনে, সিরাত আমার নিচে, কিবলা আমার সামনে, এমতা অবস্থায় আমি আমার রবের সামনে দন্ডয়মান। এমন আশা ও ভয় নিয়ে নামাজ পড়া যে আমার নামাজ কবুল হচ্ছে নতুবা আমার উপরও নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।
সর্বশেষ রাসুল সা. বাতিয়ে দেয়া ছোট্ট একটি হাদিস দিয়ে শেষ করব। যে হাদিসে সালাতে খুশু-খুযু পয়দা হওয়ার পরিপূর্ণ একটি দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসুল (সা) বলেন- তুমি যখন সালাত আদায় কর; তখন এমন ভাবে সালাতে দন্ডয়মান হও যে এটি তোমার জীবনের শেষ নামাজ। (ইবনে মাজাহ)
স্পেনের তারিক বিন জিয়াদ মসজিদে প্রদত্ত জুম্মার খুতবাহ থেকে।
-এটি