বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


শীতকাল মুমিনের ইবাদতের মৌসুম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী।।

রাতের আকাশে চলছে ফালি ফালি জোসনার খেলা। ভোরের আলো ফুটতেই মাঠের সবুজ ধানের পাতাগুলো ভিজে উঠছে স্নিগ্ধ শিশিরে। সূর্যের বর্ণচ্ছটায় ধানের শিষের ডগায় নুয়ে পড়া কাঁচের মতো শিশিরবিন্দুগুলো যেন প্রতিবিম্ব হয়ে উঠছে সবুজ প্রকৃতির। আর মায়াবী প্রকৃতির এই অবয়ব যেন বিমুগ্ধ করতে শুরু করেছে সবাইকে। মাঠে পাকা ধানের সোঁদাগন্ধ আর সাতসকালে উত্তর থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া জানান দিচ্ছে আবারও সমাগত কুয়াশাচ্ছন্ন শীত।

সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দান। ষড়ঋতুর এ দেশের প্রকৃতি বছরে ছয় বার ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও সাজ-সজ্জায় আমাদের সামনে আগমণ করে। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় অফুরন্ত এই রূপ রস আর কোথাও নেই। তাই কবি বলেন, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।'

শীতকালে আমরা অধিকহারে ঠান্ডা অনুভব করি, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে অনুভব করি প্রখর তাপ। এ দুই কালে ঠান্ডা ও গরমের প্রচন্ডতার কারণ হাদিসে নববিতে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের নিকট এ বলে অভিযোগ করেছিল, হে আমার প্রতিপালক! (প্রচন্ড উত্তাপের কারণে) আমার এক অংশ অন্য অংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে দু’টি শ্বাস ফেলার অনুমতি দিলেন। একটি শীতকালে, অপরটি গ্রীষ্মকালে। আর সে দু’টি হলো, তোমরা গ্রীষ্মকালে যে প্রচন্ড উত্তাপ এবং শীতকালে যে প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভব কর তাই।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা গরমের যে প্রচন্ডতা অনুভব করো তা জাহান্নামের গরম নিঃশ্বাসের কারণেই। আর শীতের তীব্রতা যা পাও তা জাহান্নামের ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের কারণেই।’ (সহিহ বুখারি)।

পবিত্র কুরআন মাজিদে শুধুমাত্র দুটি ঋতুর কথা উল্লেখ রয়েছে। তা হলো- শীত ও গ্রীষ্ম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তাদের (কুরাইশ বংশের লোকদের) অভ্যাস ছিল শীত ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ।’ (সুরা আল-কুরাইশ, আয়াত নং-০২)।

শীতকালকে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিনের জন্য ঋতুরাজ বসন্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ‘শীতকাল হলো মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

সব ঋতুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে কোনো ঋতুই আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়। তবে কোনো ঋতুতে বিশেষ কিছু সুবিধা থাকে। যেমন শীতকালে দিন ছোট হয় এবং সূর্যের তাপ কম হওয়ায় শীতকালে পানির পিপাসা কম হয়ে থাকে। তাই সহজেই শীতকালীন সময়ে রোজা রাখা যায়। অপরদিকে শীতকালে রাত দীর্ঘ হয়। একজন মানুষের স্বাভাবিক ঘুমের পরেও শীতকালে রাতের আরো কিছু অংশ বাকী থাকে। ফলে কেউ চাইলে সহজেই রাতের বাকী অংশ সালাতুত তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকারের মাধ্যমে কাটিয়ে দিতে পারে। সে হিসেবে হাদিস শরিফে শীতকালীন আমলের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। এক হাদিসে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় মুমিন রোজা রাখতে পারে।’ (বায়হাকি)।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা. বলেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের জন্য গনিমত।’ প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা তা বরকত বয়ে আনে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (রাতের নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হয়, যাতে রোজা রাখতে সহজ।’

ইমাম গাযালি রহ. বলেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কিনা আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয়।' (কিমিয়ায়ে সাআদাত)।

তাই শীতের আগমনে আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে অধিক ইবাদতের জন্য। পাশাপাশি শীতের আগেই সাধ্যানুযায়ী দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো বস্ত্র। সমাজের দরিদ্র মানুষের শীতকালে তীব্র শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক থাকে না।

শীতকালে অন্যসময়ের তুলনায় মোটা, ভারী, উষ্ণ পোশাকের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের পোশাক অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই শীতকালে গরীব-অসহায় মানুষেরা শীতবস্ত্রের দিকে অধিক মুখাপেক্ষী থাকে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র পরিধান না করার কারণে তারা বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়, এমনকি অধিক শৈত্যপ্রবাহে শীত নিবারণ না করার ফলে মৃত্যুর মুখেও পতিত হয়। এর জন্য সমাজের ধনী মানুষের দায়িত্ব তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শীত বস্ত্র বিতরণ করা। দরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল।

বদর যুদ্ধে বন্দী হযরত আব্বাস রা. কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট মুদার গোত্র হতে গলায় চামড়ার আবা পরিহিত বস্ত্রহীন কিছু লোক আগমন করলো। তাদের করুণ অবস্থা দেখে তাঁর চেহারা বিষণ্ন হয়ে গেলো। তিনি নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরামের সামনে দান-সাদকার উৎসাহমূলক খুতবা প্রদান করলেন। ফলে সাহাবায়ে কিরাম এত অধিক পরিমাণ দান করলেন যে, খাদ্য ও পোশাকের দুটি স্তুপ হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বস্ত্র দানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো তৃষ্ণার্ত মুসলমানকে পানি পান করালে মহান আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানীয় পান করাবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ)।

পরিশেষে বলবো, শীতকাল ইবাদত-বন্দেগির জন্য উত্তম সময়। আমাদের উচিত শীতকালে অধিক ইবাদাত-বন্দেগি করা এবং দরিদ্র বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ