শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


সঠিক পদ্ধতিতে কোরআন শিক্ষার বিকল্প নাই!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: মওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি
তর্জমা: মওলবি আশরাফ

তফসির শাস্ত্রের ইতিহাস: খুলাফায়ে রাশেদিনের আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোরআন তফসিরের গতিপথে যদি চোখ না বুলাই, তাহলে এর পরম্পরা বোঝা সম্ভব নয়। আল্লাহর রসুল (স) ও চার খলিফার আমলে তো কোরআনের তফসির গ্রন্থিত করার প্রয়োজন পড়েনি, কারণ কোরআন নাজিল হয়েছে আরবদের মাতৃভাষায়, এবং সহজবোধ্য ভাষাতেই, তাই বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। হজরত ওমর (এর) শাসনামলে যখন মুসলমানদের বিজয়ী নিশান দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ল, শ’য়ে শ’য়ে ভিনদেশি ভিনভাষী লোক ইসলামে দীক্ষিত হতে লাগল, তখন তাদের আরবি কোরআন বুঝিয়ে দিতে বা সহজ করে উপস্থাপন করতে যেখানে যেই ঘটনা বলার প্রয়োজন পড়ে মানুষ বলতে লাগল, এভাবেই জন্ম নেয় তফসির শাস্ত্রের ইতিহাস।

সাহাবায়ে কেরামের যেহেতু তারা সরাসরি আল্লাহর রসুল (স)এর পাক-জবানে কোরআনের তালিম নিয়েছেন, তাই যখনই তাদের জিজ্ঞেস করা হতো তারা ওই আয়াত প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল (স) কী বলেছেন তা বলে দিতেন। হজরত ওসমান (রাদি)এর শাসনামলে গিয়ে তফসিরের জরুরত বেশি পড়ে। তাই হজরত আবু বকর, হজরত ওমর ও হজরত ওসমান (রাদি) থেকে কিছু কিছু আয়াতের তফসির বর্ণিত আছে। কাশফুজ জুনুন কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে—

‘এই তিনজন থেকে খুব কমই বর্ণনা হয়েছে। সাহাবাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তফসির বর্ণিত হয়েছে ইবন আব্বাস (রাদি) থেকে, কেননা তিনি আল্লাহর রসুল (স)এর জীবদ্দশায় অল্পবয়সী ছিলেন, এবং তার ইন্তেকাল ৬৮ হিজরিসনে। ওই সময়ে আরবের বাইরের অনেক মানুষ মুসলমান হয়েছিল, এবং আরবিভাষী না হওয়ায় তাদের কোরআনের শব্দগত ও বাক্যগত অর্থ বুঝতে তফসিরের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক মিথ্যাবাদী তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা ও মনগড়া তফসির ইবন আব্বাসের নামে চালিয়ে দেন।’

সাহাবায়ে কেরামের পরে তাবেয়িনের যুগ শুরু হয়। এসময় কোরআন শিক্ষার দুটি বলয় তৈরি হয়—

(এক) মক্কা
(দুই) কুফা

মক্কায় ইবন আব্বাসের শাগরেদ, যেমন মুজাহিদ, সায়িদ বিন জুবাইর, ইকরামা, তাউস ও আতা ইবন আবি রিয়াহ (র) প্রমুখ কোরআনি শিক্ষার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে কুফায় ইবন মাসউদের (রাদি) শাগরেদবৃন্দ, যেমন আলকামা, আসওয়াদ ইবন ইয়াজিদ, ইবরাহিম নখয়ি ও শা’বি প্রমুখ এই খেদমত আঞ্জাম দিতেন।

তাবেয়িনের সময়ও কোরআনের তফসির গ্রন্থিত আকারে রূপ নেয়নি, বরং নাজিলের সময় ও ব্যবহারিক ফর্ম নিয়েই মৌখিক শিক্ষাদান চলত।

তাবেয়িনের ছাত্ররাই প্রথম তফসির গ্রন্থিত করতে শুরু করে। যেসব তাবে-তাবেয়িনের কাজ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে আছেন— সুফিয়ান ইবন উয়াইনা, ওকি’ ইবনুল জাররাহ, শু’বা, ইয়াজিদ ইবন হারুন, আবদুর রাজ্জাক ইবন আবি আয়াস, ইসহাক ইবন রাহুয়াহ, রুহ ইবন উবাদাহ, উবায়দাহ বিন হামিদ ও আবু বকর ইবন আবু শায়বাহ।

যদি এই ধারাবাহিকতা এভাবেই আজকের দিন পর্যন্ত জারি থাকত, তাহলে আমরা যারপরনাই উপকৃত হতাম, এবং এখনও সত্যিকারের কোরআনি শিক্ষার রঙ-রূপ অমলিন থাকত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাবে-তাবেয়িন বা মুসলমানদের তৃতীয় প্রজন্মের পর এমন এক প্রজন্ম আসে যারা কোরআনের সঠিক মর্ম না বোঝে তাতে মনগড়া ব্যাখ্যা আরোপ করতে শুরু করে, বহুসংখ্যক হাদিসের নামে জাল হাদিস তফসিরে অন্তর্ভুক্ত করে, এবং কোথাও কোথাও এমন তফসির লেখেন যা কোরআনের অন্য বক্তব্যের সাথে স্পষ্ট সাংঘর্ষিক। আবার দেখা গেছে কোরআনের এক অংশের সঠিক তফসির করেছে, অন্য অংশের মনগড়া— এভাবে গোঁজামিল দেওয়া।

এই সম্পর্কে কাশফুজ জুনুন কিতাবে মুস্তফা ইবন আবদুল্লাহ হাজি খলিফা বলেন, ‘এরপর মুতাআখখিরিন (পরবর্তী প্রজন্মের) আলেমদের একদল তফসির গ্রন্থিত করার মধ্য দিয়ে সমুদ্রে বাঁধ বসাতে শুরু করেন।

তারা বাছবিচারের তোয়াক্কা না করে অনেক অনেক কথা যোগ করেন, ফলে সহিহ (সত্যায়নকৃত সূত্র) ও জইফ (দুর্বল সূত্র) বর্ণনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মনে কিছু একটা এসেছে, অমনি তাকে তফসিরে যোগ করে ফেলেছে। এরপর কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই পরের প্রজন্ম সেসব মতামত গ্রহণ করতে থাকে, তারা ভেবেও দেখেনি সালফে সালেহিন এবিষয়ে কী বলা আছে।’

ওই সমস্ত তফসিরে আল্লাহ পাকের কালামের বিভিন্ন শব্দের সাথে কী পরিমাণ ভুলভাল অর্থ যোগ করে, তার কিছু ধারণা পাই বিখ্যাত তফসিরবিশারদ আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (র)এর বক্তব্য থেকে :

‘আমি “গাইরিল মাগদু-বি আলাইহিম ওলাদ্দ-ল্লি-ন” আয়াতের দশটি ভিন্ন-ভিন্ন তফসির দেখেছি, অথচ আল্লাহর রসুল (স) থেকে এই আয়াতের তফসিরে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।’

এইসব আলগা পণ্ডিতের পর আরও একদল পণ্ডিতের উদ্ভব হয় যারা কোরআনের তফসিরে কেবল মনগড়া কথাই যোগ করেনি, বরং নিজে যেই শাস্ত্রে পণ্ডিত, কোরআনকে সেই শাস্ত্রের গ্রন্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। যেমন যেই ভদ্রলোক আরবি ব্যাকরণে পণ্ডিত, উনি কোরআনের কোন আয়াতে ব্যাকরণের কোন কোন সূত্র প্রয়োগ হয়েছে, একটা আয়াতে কতরকম সূত্রে প্রয়োগ সম্ভব— এসব করে বেড়িয়েছেন। তাদের তফসির পড়তে গেলে মনে হবে কোরআন যেন জীবনবিধান না, আরবি ব্যাকরণের বই।

এরকমই এক তফসিরে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমের সোজাসাপ্টা তর্জমা করার বদলে ব্যাকরণের তিন হাজার সূত্র প্রয়োগ করে দেখানো হয়েছে। এই বিষয়ে আমি নিজে কোনো মন্তব্য না করে কাশফুজ জুনুন কিতাবের উদ্ধৃতি তুলে ধরছি:

এরপর এমন লোকেরা তফসির লিখতে শুরু করে যারা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পাণ্ডিত্য রাখে, যে বিষয়টি তাদের বিশেষ পছন্দ ও তাতে দক্ষতা অর্জন করেছে— কোরআনে তফসিরে তা-ই লিখেন, যেন এই বিষয়েই কোরআন নাজিল হয়েছে, যদিও বলতে হয় কোরআনে সব আছে। আরবি ব্যাকরণের জবর-জের-পেশ আর বাক্যতত্ত্বই কেবল চোখে পড়ে, যদিও সেই সব বিশ্লেষণ দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে করা, তবু তাতে অনেক রঙ চড়িয়ে ভারী বানিয়ে উপস্থাপন করা হয়। যেমন যুজাজ ও ওয়াহিদি তাদের ‘বাসিত’ নামক গ্রন্থে, আবু হিয়ান তার ‘বাহর ও নাহর’ গ্রন্থে, এবং আখবারিও কিছু কিসসা-কাহিনিতে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে।

এই ক্ষেত্রে তারা কেবল ব্যাকরণকেই প্রাধান্য দিয়েছে, কোরআনে ব্যাখ্যা ভুল হচ্ছে না সঠিক হচ্ছে সেই দিকে কোনো নজর ছিল না। সা’লাবিও এই দলের একজন। আইনশাস্ত্রবিদগণও এই কাজটি করেছেন, সব জায়গায় আইনের (ফিকহ) অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। অনেক সময় আইনশাস্ত্রবিদগণ দূরবর্তী কোনো সূত্রের আলোকে আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, যদিও সেই আয়াতটি ওই রকম কিছু বোঝায় না।

কিন্তু তারা মনগড়া ব্যাখ্যা তো জুড়েছেই, সেই সাথে বিরোধীদের ব্যাখ্যাও সেই আয়াতের প্রেক্ষিতে খণ্ডন করেছে। ফকিহ বা আইনশাস্ত্রবিদগণের এই দলে ইমাম কুরতুবিও আছেন।

অনেকে আবার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান, বিশেষ করে দার্শনিকদের বক্তব্য দিয়ে তফসির সয়লাব করেছে। আলোচনা কোনদিক থেকে কোনদিকে নিয়ে গেছে সেই সূত্র খুঁজতে গিয়ে পাঠক কূলকিনারা হারিয়ে ফেলে। আবু হিয়ান ‘বাহর ও নাহর’ গ্রন্থে বলেন, ইমাম রাযি তার তফসিরে এমন অনেক কিছু ঢুকিয়েছে যে তফসিরশাস্ত্রে যার কোনো প্রয়োজন নাই। এইজন্য অনেক আলেম বলেন, ইমাম রাযির তফসিরে সবকিছুই আছে কিন্তু তফসির নাই! আর একজন নব উদ্ভাবনকারীর উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর কালামে বিকৃতি আনাই হয়, যেন তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রামাণ্য বানিয়ে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে পারে।.

এইসব লোকেরা যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই নিজেদের খেয়ালখুশি মতো একটা আলাপ জুড়ে দেয়। এমনকি তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা বলতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যারা বর্ণনাসূত্র ছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা করে, অথবা পূর্বসূরী আলেমদের বক্তব্য আরবি ব্যাকরণের নিয়মকানুন ও শরিয়তের মূলনীতি ছাড়া গ্রহণ করে, তারা সবাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

মাহমুদ বিন হামজা কিরমানির তফসির এমনই ক্যাটাগরির তফসির, তিনি যার নাম রেখেছেন ‘আল আজাইব ওল গারাইব’ (আজব-গজব বিষয়)। তার মধ্যে এমন অনেকের বক্তব্য সংকলন করেছেন যারা বিশ্লেষক চোখে দূরের কথা, জনসাধারণের কাছেই অগ্রহণযোগ্য। এমন এমন বিষয়ও তাতে যোগ করেছে যে যার ওপর বিশ্বাস আনা নাজায়েজ।... সিরাজুদ্দিন আল বুলকিনির কাছে এরকম লোকদের তফসিরের বিষয়ে ‘ফতোয়া’ চাওয়া হলে তিনি বলেন, এই ধরনের লোকেরা নাস্তিক ও পরিত্যাজ্য, এবং কোরআন বিষয়ে সুফিদের বক্তব্য তফসিরের আওতায় পড়ে না। ইবনুস সালাহ তার ফতোয়ার কিতাবে বলেন, যেই ব্যক্তি এই ধরনের গ্রন্থকে তফসির বলবে, সে কাফের। নাসাফি তার আকিদার কিতাবে বলেন, টেক্সট থেকে যে অর্থ প্রকাশমান সেটাই গ্রহণীয়, তার বাতেনি (গুপ্ত) অর্থ তালাশ করা শরিয়তবিরোধী।’ (কাশফুজ জুনুন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৭)

কোরআনের নামে এই ধরনের রঙতামাশা হিজরি ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত ছিল। তার পরে তো কোরআনের তফসিরের চল-ই উঠে যায়, এবং তারচেয়ে ভয়ানক তামাশা শুরু হয়— অপব্যাখ্যায় ভরপুর ওইসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও টীকা-টিপ্পনী লেখা শুরু হতে থাকে! মোল্লা এওয়াজ ‘বায়জাবি শরিফ’-এর যে টীকা-টিপ্পনী লেখেন, তা আলাদা করে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়!

দ্রষ্টব্য : এসব লেখার উদ্দেশ্য তফসিরবিদদের ওপর ঢালাওভাবে অভিযোগ করা নয়, বরং কোরআনের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে আনার জন্য বলতে হয়েছে। ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা খালেস নিয়তে উম্মতের জন্য খেদমত করেছেন, আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করবেন। (এখানে কেবল তাদের ওপরই অভিযোগ করা হয়েছে, যার হকের পথ থেকে ক্ষেত্রবিশেষ বিচ্যুত হয়ে গেছিলেন।)

সঠিক পদ্ধতি কোরআন না শিক্ষার ফলাফল: এই বিষয়টি স্পষ্ট যে কোরআনের ওপর চিন্তাভাবনা এক জিনিস আর তফসির-কেন্দ্রিক ভাবনাচিন্তা আরেক জিনিস। কোরআনের মূলানুগ পাঠ ছেড়ে দেওয়ায় অথবা সঠিক পদ্ধতিতে না পড়ার ফলে আমরা কোরআনের মোজেজা উপলব্ধি করা থেকে যে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছি, আশা করি তা দেখতেই পাচ্ছেন। কোরআনে স্বয়ং আল্লাহ পাক যেভাবে কোরআন পড়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা এড়িয়ে গিয়ে ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করলে কীভাবে প্রকৃত ফলাফল পাব? যতদিন আমরা মূল কোরআন থেকে দূরে থাকব, ততদিন আমরা কেবল অধঃপতিত হতেই থাকব। অন্যান্য জাতির যেই পরিণতি, আমাদেরও ঠিক তা-ই হবে। আমাদের স্বভাব-চরিত্রেও বিজাতীয় ছাপ স্পষ্ট।

আমরা তো অন্তরে অন্তরে মুর্দা। যদি কোনো জাতি জিন্দা হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেক সদস্য বীরত্ব, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, প্রগতিশীলতার গুণ ধারণ করে আত্মোৎসর্গের মতো মহান কাজে পিছ-পা হয় না। আর যদি জাতি মুর্দা হয়, তাহলে তাদের লোকজন কাপুরুষ, হিম্মতহারা, সস্তা মানসিকতার আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মতো স্বভাবচরিত্রের হয়। জাতির অধঃপতন লোকজনের মাঝে এমনভাবে প্রভাব ফেলে যে, মহামূল্য অর্থে ব্যবহৃত শব্দও বিকৃত হয়ে সস্তা অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

মরহুম নওয়াব মুহসিনুল মালিক একবার বলেছিলেন, যখন মুসলমানদের অন্তর জিন্দা ছিল, তো তখন ওয়াদা বা কথা দেওয়ার একটাই অর্থ ছিল যে সেটা পূর্ণ করা হবে। যখন তাদের অন্তর মরে গেল, তখন ওয়াদার হরেক রকমের অর্থ হয়ে গেল। আগে বলা হতো— ‘মুসলমানের এক কথা এক জবান, তার জানজীবনের চেয়েও মহান’। তারপর বলা হতো — ‘ওয়াদা করার চেয়ে ওয়াদা রক্ষা করা কঠিন’! আর এখন বলা হয়— ‘ওয়াদা করার কী প্রয়োজন, আমাকে বিশ্বাস করেন না ভাই’!

এরকমভাবেই কোরআনি শিক্ষার কার্যত বাস্তবায়ন ছেড়ে দেওয়ায় কোরআনে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের অর্থ বিকৃত হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে আমি ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) ও ‘সবর’ (ধৈর্য) শব্দ দুটো আপনাদের সামনে পেশ করব।

তাওয়াক্কুল কী?

আজকাল তাওয়াক্কুল বা ভরসার অর্থ দাঁড়িয়েছে হাত-পা গুটিয়ে, কোনো কাজ-কাম না করে বসে থাকা। এইজন্য এরকম কিছু গল্পও প্রসিদ্ধ হয়েছে যে, এক লোক এই ধরনের তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাআলাকে বলে— ‘যতক্ষণ না তুমি নিজ হাতে খাওয়াইবা, আড়ি করলাম আমি খামু না।’ এরপর সে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর এক কাফেলা খাবারদাবারের বিশাল বহর নিয়ে তার সামনে হাজির হয়। লোকটি খাবার পেয়ে খেতে শুরু করে। এমন সময় উপর থেকে আওয়াজ আসে— ‘ওরে বান্দা, যদি তুমি তাড়াহুড়া না করতা, আমি নিজ হাতে তোমারে খাওয়ায়া দিতাম!’

কোরআনে ব্যবহৃত ‘তাওয়াক্কুল’ অর্থের বিপরীতে ওই নিকম্মার দল বলে— ‘অমুকে কোনো কাজ-কাম না করেও দিব্যি আরামে দিনকাল কাটাচ্ছে।’ যেই লোক ঘর থেকে বের হয় না, সে যেন আল্লাহর ওপর অনেক বেশি ভরসাকারী। অথচ কোরআনে তাওয়াক্কুল শব্দের অর্থ খুব কঠিন অবস্থাতেও সাহসিকতার সাথে কাজ করে যাওয়া, আর দুশ্চিন্তা না করে আল্লাহর কাছে তার ফলাফল চাওয়া।

মানে কাজের দায়িত্ব বান্দার, আর ফলাফল দেওয়ার মালিক আল্লাহ; কাজের পরে ভালো ফলাফলের আশা করার নামই ভরসা। নীচের আয়াতে এই বিষয়টি স্পষ্ট চোখের সামনে ধরা পড়ে :

قَالُوْا یٰمُوْسٰۤى اِنَّ فِیْهَا قَوْمًا جَبَّارِیْنَ١ۖۗ وَ اِنَّا لَنْ نَّدْخُلَهَا حَتّٰى یَخْرُجُوْا مِنْهَا١ۚ فَاِنْ یَّخْرُجُوْا مِنْهَا فَاِنَّا دٰخِلُوْنَ

قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِیْنَ یَخَافُوْنَ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَیْهِمَا ادْخُلُوْا عَلَیْهِمُ الْبَابَ١ۚ فَاِذَا دَخَلْتُمُوْهُ فَاِنَّكُمْ غٰلِبُوْنَ١ۚ۬ وَ عَلَى اللّٰهِ فَتَوَكَّلُوْۤا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ

তারা বলতে লাগল, “হে মুসা! ওই দেশে তো এক শক্তিধর দুর্ধর্ষ জাতি বাস করে। তারা সেখান থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা কখনোই সেখানে যাবো না। হ্যাঁ, যদি তারা বের হয়ে যায় তাহলে আমরা সেখানে প্রবেশ করতে রাজি আছি।” ঐ ভীরু লোকদের মধ্যে দু’জন এমন লোকও ছিল যাদের প্রতি আল্লাহ তার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলেন। তারা বলল, “এ শক্তিশালী লোকদের মোকাবিলা করে দরজার মধ্যে ঢুকে পড়ো। ভেতরে প্রবেশ করলে তোমরাই জয়ী হবে। আর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো।” (সুরা মায়িদা, আয়াত ২২-২৩)

وَ اتْلُ عَلَیْهِمْ نَبَاَ نُوْحٍ١ۘ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهٖ یٰقَوْمِ اِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَیْكُمْ مَّقَامِیْ وَ تَذْكِیْرِیْ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ فَعَلَى اللّٰهِ تَوَكَّلْتُ فَاَجْمِعُوْۤا اَمْرَكُمْ وَ شُرَكَآءَكُمْ ثُمَّ لَا یَكُنْ اَمْرُكُمْ عَلَیْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوْۤا اِلَیَّ وَ لَا تُنْظِرُوْنِ

(হে নবী) তাদেরকে নুহের কথা শুনাও। সেই সময়ের কথা যখন তিনি তার জাতিকে বলেছিলেন— ভাই সকল! যদি তোমাদের মধ্যে আমার অবস্থান এবং আল্লাহর আয়াত শুনিয়ে শুনিয়ে তোমাদের গাফলতি থেকে জাগিয়ে তোলা তোমাদের কাছে অসহনীয় হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি, তোমরা নিজেদের তৈরি করা শরিকদের সঙ্গে নিয়ে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত করে নাও এবং তোমাদের সামনে যে পরিকল্পনা আছে সে সম্পর্কে খুব ভালোভাবে চিন্তা করে নাও, যাতে করে কোনো একটি দিকও তোমাদের দৃষ্টির আড়ালে না থেকে যায়। তারপর আমার বিরুদ্ধে তাকে সক্রিয় করো এবং আমাকে মোটেই সুযোগ দিয়ো না (সুরা ইউনুস, আয়াত ৭১)

হজরত নুহ (আ) কাজ ছেড়ে দেননি। যদি অকর্মা হয়ে বসে থাকতেন, তাহলে এরকম চ্যালেঞ্জ দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। আর তার স্বজাতি এটাই চাইতো যে তিনি যেন দাওয়াতি কার্যক্রম না চালান।

সবর অর্থ কী?

সবরের অর্থ আজকাল ধরা হয় বিপদ-আপদ হলে চোখেমুখে দুশ্চিন্তা প্রকাশ না করা, এমনকি অসহনীয় যন্ত্রণা বরদাশত করেও ঘাপটি মেরে বসে থাকা, মরে যাবে তবু উফ শব্দটিও করবে না। এরকম নালায়েক ও কাপুরুষদের প্রশংসা করা হয়, এবং ভাবা হয় তারা কোরআনের ওপর আমলকারী। অথচ কোরআনে সবর অর্থ সঠিক কর্মপন্থায় কাজ করার সময়ে যে অসুবিধা ও বালা-মুসিবত সামনে পড়ে, তা সহ্য করে কাজ চালিয়ে যাওয়া, এবং ঘাবড়ে গিয়ে কাজ বন্ধ না করা। নীচের আয়াত থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয় :

فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوْتُ بِالْجُنُوْدِ١ۙ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ مُبْتَلِیْكُمْ بِنَهَرٍ١ۚ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَیْسَ مِنِّیْ١ۚ وَ مَنْ لَّمْ یَطْعَمْهُ فَاِنَّهٗ مِنِّیْۤ اِلَّا مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةًۢ بِیَدِهٖ١ۚ فَشَرِبُوْا مِنْهُ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْهُمْ١ؕ فَلَمَّا جَاوَزَهٗ هُوَ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَعَهٗ١ۙ قَالُوْا لَا طَاقَةَ لَنَا الْیَوْمَ بِجَالُوْتَ وَ جُنُوْدِهٖ١ؕ قَالَ الَّذِیْنَ یَظُنُّوْنَ اَنَّهُمْ مُّلٰقُوا اللّٰهِ١ۙ كَمْ مِّنْ فِئَةٍ قَلِیْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِیْرَةًۢ بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَ اللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ

وَ لَمَّا بَرَزُوْا لِجَالُوْتَ وَ جُنُوْدِهٖ قَالُوْا رَبَّنَاۤ اَفْرِغْ عَلَیْنَا صَبْرًا وَّ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَؕ

তারপর তালুত যখন সেনাবিহনী নিয়ে এগিয়ে চললেন, সে বললেন : “আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নদীতে তোমাদের পরীক্ষা হবে। যে তার পানি পান করবে সে আমার সহযোগী নয়।

একমাত্র সে-ই আমার সহযোগী যে তার পানি থেকে নিজের পিপাসা নিবৃত্ত করবে না। তবে এক আধ আঁজলা কেউ পান করতে চাইলে করতে পারে। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া বাকি সবাই সেই নদীর পানি আকন্ঠপান করল। অতঃপর তালুত ও তার সাথী মুসলমানরা যখন নদী পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তখন তারা তালুতকে বলে দিল, “আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।” কিন্তু যারা একথা মনে করছিল যে, তাদের একদিন আল্লাহর সাথে মিলন হবে, তারা বলল, “অনেক বারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের ওপর বিজয় লাভ করেছে।

আল্লাহ‌ তাআলা সবরকারীদের সঙ্গ দেন।” আর যখন তারা জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলায় বের হলো, তারা দোয়া করলোঃ “হে আমাদের রব! আমাদের সবর দান করো, আমাদের অবিচলিত রাখ এবং এই কাফের দলের ওপর আমাদের বিজয় দান করো।” (সুরা বাকারাহ, আয়াত ২৪৯-২৫০)

وَ كَاَیِّنْ مِّنْ نَّبِیٍّ قٰتَلَ١ۙ مَعَهٗ رِبِّیُّوْنَ كَثِیْرٌ١ۚ فَمَا وَ هَنُوْا لِمَاۤ اَصَابَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ مَا ضَعُفُوْا وَ مَا اسْتَكَانُوْا١ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الصّٰبِرِیْنَ

وَ مَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَ اِسْرَافَنَا فِیْۤ اَمْرِنَا وَ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ

এর আগে এমন অনেক নবী-রসুল অতিবাহিত হয়েছেন যাদের সাথে মিলে বহু রব্বানি (আল্লাহ‌ওয়ালা) লড়াই করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা হিম্মতহারা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করেনি। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদেরকে ভালবাসেন।

তাদের দোয়া কেবল এতটুকুই ছিল— “হে আমাদের রব, আমাদের ভুল–ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। আমাদের কাজের ব্যাপারে যেখানে তোমার সীমালংঘিত হয়েছে, তা মাফ করে দিন। আমাদের পা মজবুত করে দিন এবং কাফেরদের মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করুন।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৬-১৪৭)

কোরআনে সবরকারীদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে যখন তারা কাজ আরম্ভ করেছে, আল্লাহ তাআলা তখন তাদের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী দলের ওপর বিজয় নসিব করেছেন।

اَلْئٰنَ خَفَّفَ اللّٰهُ عَنْكُمْ وَ عَلِمَ اَنَّ فِیْكُمْ ضَعْفًا١ؕ فَاِنْ یَّكُنْ مِّنْكُمْ مِّائَةٌ صَابِرَةٌ یَّغْلِبُوْا مِائَتَیْنِ١ۚ وَ اِنْ یَّكُنْ مِّنْكُمْ اَلْفٌ یَّغْلِبُوْۤا اَلْفَیْنِ بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَ اللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ

বেশ, এখন আল্লাহ‌ তোমাদের বোঝা হালকা করে দিয়েছেন এবং তিনি জেনেছেন যে, এখনো তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। কাজেই যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয়, তাহলে তারা দু’শ জনের ওপর এবং এক হাজার সবরকারী হলে, দুই হাজার লোকের ওপর আল্লাহর হুকুমে বিজয়ী হবে। আর আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে আছেন। (সুরা আনফাল, আয়াত ৬৬)

আরও কয়েকটি উদাহরণ : মূল কোরআনে চোখ না থাকার কারণে, তার দ্বারা সঠিক পদ্ধতিতে উপকৃত না হওয়ার ফলে, এবং তাতে বিভিন্ন মানুষের মনগড়া ব্যাখ্যা আরোপ করায় প্রথমত সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে তা হলো— গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও বিষয়ের বিভ্রান্তিমূলক অর্থ জনমানসে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

দ্বিতীয়ত কোরআনের কেবল নির্দিষ্ট আয়াত সামনে উপস্থাপন করে, বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মোড়কে সাপটে আলোচনার রেওয়াজ শুরু হয়েছে। ফলে কোরআনের প্রকৃত ভাব ও শিক্ষার পরিবর্তে রঙচঙে আলাপই কোরআন হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছে। এর সপক্ষে আরও কিছু উদাহরণ পেশ করব।

প্রথম উদাহরণ: পার্থিব জীবনে উন্নত ও শক্তিধর হওয়ার প্রতি কোরআনে যেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাতে মোটেও নজর দেওয়া হয় না। বরং উদাসীন মানসিকতা রাখে। অথচ দুশমন থেকে হেফাজত, জরুরি অবস্থায় প্রতিরক্ষা, নিজ অবস্থাকে ক্রমশ উন্নত করে কামালিয়াত হাসিল করা, এবং পদার্থের সম্ভাব্য সব শক্তিকে কাজে ব্যবহার করাও আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। কোরআনে এই ব্যাপারে খুব জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন আয়াত আছে—

وَ اَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَّ مِنْ رِّبَاطِ الْخَیْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهٖ عَدُوَّ اللّٰهِ وَ عَدُوَّكُمْ وَ اٰخَرِیْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ١ۚ

আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মোকাবিলার জন্য জোগাড় করে রাখো। এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর দুশমনকে এবং নিজের দুশমনকে।... (সুরা আনফাল,আয়াত ৬০)

وَ لَوْ اَرَادُوا الْخُرُوْجَ لَاَعَدُّوْا لَهٗ عُدَّةً যদি তাদের বের হবার ইচ্ছা থাকতো তাহলে তারা সেজন্য কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। (সুরা তওবা, আয়াত ৪৬)

وَدَّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لَوْ تَغْفُلُوْنَ عَنْ اَسْلِحَتِكُمْ وَ اَمْتِعَتِكُمْ فَیَمِیْلُوْنَ عَلَیْكُمْ مَّیْلَةً وَّاحِدَةً١ؕ আর কাফেররা সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তোমরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিসপত্র থেকে সামান্য অমনোযোগী হলেই তারা তোমাদের ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়বে। (সুরা নিসা, আয়াত ১০২)

বরঞ্চ যেসব লোক মুসলমানদের আর্থসামাজিক জীবন উন্নত ও বিকশিত করার জন্যে মাথা ঘামায় না, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে সারাক্ষণ নফল নামাজ নিয়ে পড়ে থাকে, তাদেরকে ‘আদর্শ মুসলমান’-এর নমুনা ভাবা হয়।

এদিকে কোরআনের শিক্ষা হলো যারাই মুসলমানদের সঙ্গিন পরিস্থিতিতে সবধরনের সহযোগিতা, শক্তির জোগান দান ও প্রতিরক্ষার জন্য এগিয়ে না এসে শৈথিল্য প্রদর্শন করে, তাহলে তারা যেমনই হোক না কেন, তাদেরকে মুসলমানদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে যতক্ষণ না তওবা করে ফিরে আসে। খোদ আল্লাহর রসুল (স) একবার তিনজন সাহাবিকে শৈথিল্য প্রদর্শনের কারণে বয়কট করেছিলেন।

এই তিনজন হলেন— কা’ব বিন মালেক, হিলাল বিন উমাইয়াহ ও মুরারাহ বিন রবি (রা)। আল্লাহর রসুল (স) তাদেরকে সব মুসলমানদের থেকে আলাদা এবং সবধরনের সম্পর্ক ছিন্নের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এমনকি কথা বলারও অনুমতি দেননি। যখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে খাস দিলে তওবা করেছেন, আল্লাহ তখন তাদের বয়কট থেকে মুক্তকরণের জন্য আয়াত নাজিল করেন।

وَّ عَلَى الثَّلٰثَةِ الَّذِیْنَ خُلِّفُوْا١ؕ حَتّٰۤى اِذَا ضَاقَتْ عَلَیْهِمُ الْاَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَ ضَاقَتْ عَلَیْهِمْ اَنْفُسُهُمْ وَ ظَنُّوْۤا اَنْ لَّا مَلْجَاَ مِنَ اللّٰهِ اِلَّاۤ اِلَیْهِ١ؕ ثُمَّ تَابَ عَلَیْهِمْ لِیَتُوْبُوْا١ؕ اِنَّ اللّٰهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیْمُ۠

আর যে তিনজন— যারা পিছনে রয়ে গেছিল— তাদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেলো, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল নেই তখন আল্লাহ‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ‌ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সুরা তওবা, আয়াত ১১৮)

হাদিসে পাকেও স্পষ্ট ভাষায় একথা বলা হয়েছে যে মুসলমানদের সবধরনের আগ্রাসন থেকে প্রতিরক্ষার চেষ্টাপ্রচেষ্টা নফল নামাজ ও রোজার চেয়েও উত্তম।

মুসলিম বিন সালমান ফারসি থেকে বর্ণিত। রসুল (স) বলেন, ‘মুসলমানদের হেফাজত করা সবধরনের নফল কাজের চেয়ে উত্তম। এবং একদিন একরাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া গোটা একমাসের নামাজ-রোজার চেয়ে উত্তম।

ইমাম আহমদ বলেন, হজরত ওসমান (রা) মিম্বরে খুতবা প্রদানের সময় বর্ণনা করেন যে, আমি রসুল (স)-এর কাছ থেকে শুনেছি— আল্লাহর রাস্তায় (নির্দিষ্টভাবে ‘যুদ্ধ’ অর্থে শব্দটি ব্যবহার হয়) একরাত কাটানো নফল নামাজ পড়ে হাজারটা রাত কাটানোর চেয়ে উত্তম।

ইবনে কাসিরে বলেন, ১৭০ হিজরিতে আবদুল্লাহ বিন মুবারক,— যিনি তখন মুসলমানদের হেফাজত ও শক্তিধর বানাতে চেষ্টাশ্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন,— কা’বা শরিফে ইবাদত বন্দেগিতে ব্যস্ত তৎকালীন সুফিদের নেতা ফুজায়ল বিন ইয়াজের কাছে এই কবিতাটি লিখে পাঠান :

ওহে দুই পবিত্র মসজিদের ইবাদতগুজার, যদি তুমি আমাদের অবস্থা দেখতে পেতে তাহলে বুঝতে তোমার ইবাদত-বন্দেগি খেলতামাশা ফুজায়ল বিন ইয়াজ এই চিঠি পেয়ে মন্তব্য করেন যে আবদুল্লাহ বিন মুবারক যথার্থই বলেছেন। (তফসিরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৩)

দ্বিতীয় উদাহরণ: সংসারী হওয়া বা দুনিয়ার জীবনে আয়-উন্নতি করার চেষ্টাশ্রমকে ধর্মবহির্ভূত ভাবা হয়। অথচ কোরআনে আল্লাহ পাক শিক্ষা দিচ্ছেন: فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ

তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (অর্থাৎ দুনিয়াবি উন্নতি) সন্ধান করো। এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।

তো অধিকাংশ সাহাবি ও পূর্বসূরী আলেমগণ দুনিয়াদারির জন্য ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে সময় দিতেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আজকালকার ‘মহাপুরুষেরা’ দুনিয়াদারিকে অসম্মানজনক বা ‘শানের খেলাফ’ ভাবেন। এসব ধ্যানধারণার উৎপত্তি কোরআনের সঠিক শিক্ষা সামনে না থাকার ফলে হয়েছে।

তৃতীয় উদাহরণ: সাধারণভাবে ভাবা হয় মুসলমানরা দুনিয়ার জীবন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর মিসকিনের মতো কাটাবে, এটাই তাদের নিয়তি। অথচ কোরআনে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর মিসকিনিকে আল্লাহর আজাব-গজবের নমুনা হিসেবে বিবৃত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে: كَذَّبَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَاَتٰىهُمُ الْعَذَابُ مِنْ حَیْثُ لَا یَشْعُرُوْنَ

فَاَذَاقَهُمُ اللّٰهُ الْخِزْیَ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا١ۚ وَ لَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَكْبَرُ١ۘ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ আল্লাহ দুনিয়ার জীবনেই তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার করেছেন। আখেরাতের আজাব তো তার চেয়েও অধিক কঠোর। হায়! তারা যদি তা জানতো।

এদের পূর্বেও বহু লোক এভাবেই অস্বীকার করেছে। শেষপর্যন্ত এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর আজাব আপতিত হয়েছে যা তারা কল্পনাও করতে পারতো না। তারপর আল্লাহ তাআলা তাদের দুনিয়ার জীবনে অপমানিত করলেন, (তাদের জন্যে) আখেরাতের আজাব হবে (আরও) গুরুতর (কত ভালাে হতো) যদি তারা (কথাটা) জানতাে! (সুরা যুমার, আয়াত ২৫-২৬)

সুরা বাকারায় ইহুদিদের অবাধ্যতার কথা আলোচনার আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তির পরোয়ানা দেন:

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ١ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا١ۚ وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤى اَشَدِّ الْعَذَابِ١ؕ

তোমরা তো আল্লাহর কিতাবের এক অংশের ওপর ঈমান আনছো আর অপর অংশ অস্বীকার করছো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে? (সুরা বাকারা, আয়াত ৮৫)

অন্যত্রে আহলে কিতাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন

ضُرِبَتْ عَلَیْهِمُ الذِّلَّةُ اَیْنَ مَا ثُقِفُوْۤا اِلَّا بِحَبْلٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ حَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ وَ بَآءُوْ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ ضُرِبَتْ عَلَیْهِمُ الْمَسْكَنَةُ١ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ كَانُوْا یَكْفُرُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ وَ یَقْتُلُوْنَ الْاَنْۢبِیَآءَ بِغَیْرِ حَقٍّ١ؕ ذٰلِكَ بِمَا عَصَوْا وَّ كَانُوْا یَعْتَدُوْنَۗ

এদের যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই এদের ওপর লাঞ্ছনার মার পড়েছে। তবে কোথাও আল্লাহর দায়িত্বে বা মানুষের দায়িত্বে কিছু আশ্রয় মিলে গেলে তা অবশ্য ভিন্ন কথা, আল্লাহর গজব এদেরকে ঘিরে ফেলেছে। এদের ওপর মুখাপেক্ষিতা ও পরাজয় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব কিছুর কারণ হচ্ছে এই যে, এরা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করতে থেকেছে এবং নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। এসব হচ্ছে এদের নাফরমানি ও বাড়াবাড়ির পরিণাম। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১১১)

অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা যাদেরকে অনুগ্রহ ও সম্মান দান করেছেন তাদের ব্যাপারে ওয়াদা দেন যে, তাদেরকেই তিনি রাজত্ব ও উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। ইরশাদ করেন :

وَ لَا تَهِنُوْا وَ لَا تَحْزَنُوْا وَ اَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ তোমরা হিম্মতহারা হয়ো না এবং দুঃখ করো না, (শেষমেশ) তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৯)

وَ لَقَدْ كَتَبْنَا فِی الزَّبُوْرِ مِنْۢ بَعْدِ الذِّكْرِ اَنَّ الْاَرْضَ یَرِثُهَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوْنَ আর জবুর কিতাবে আমি উপদেশের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, দুনিয়ায় রাজত্বের উত্তরাধিকারী হবে আমার সৎকর্মশীল বান্দারা। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৫)

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِی الْاَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ١۪ আল্লাহ পাক ওয়াদা দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন। (সুরা নুর, আয়াত ৭৫)

সাধারণ মানুষ মনে করে জান্নাত পাওয়ার জন্য নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, তসবিহ টিপা, নবীর শানে দরুদ-মিলাদ পড়া, আর দাড়ি রাখলেই যথেষ্ট। যদি এই সবই খালি ধর্ম হয় তাহলে কী প্রয়োজন আছে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হেফাজের জন্য এত কষ্ট স্বীকার করার, তারপর মুসলমানদের সাফল্য ও উন্নতির জন্য এত মেহনত করার? আরামসেই তো জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। যখন জীবনের শুরুতেই মন ও মগজে এই কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত না করেও (কেবল নামাজ-রোজা আদায় করে) একজন সাচ্চা মুসলমান হতে পারে, সে কীভাবে বড় হয়ে জাতির স্বার্থে জান কোরবান করতে উৎসাহী হবে? (এমনকি জাতির স্বার্থে কাজ করতে হয় এই বিষয়টিই তো সে জানে না।) অথচ কোরআনে সাফ সাফ বলা হয়েছে যে মুক্তির জন্য আমৃত্যু সবধরনের কলাকৌশল অবলম্বন করে বিপ্লব ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। সুরা বাকারায় ইরশাদ করা হয়েছে :

اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَ لَمَّا یَاْتِكُمْ مَّثَلُ الَّذِیْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ١ؕ مَسَّتْهُمُ الْبَاْسَآءُ وَ الضَّرَّآءُ وَ زُلْزِلُوْا حَتّٰى یَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَعَهٗ مَتٰى نَصْرُ اللّٰهِ١ؕ اَلَاۤ اِنَّ نَصْرَ اللّٰهِ قَرِیْبٌ

তোমরা কি মনে করেছো এমনি এমনিই জান্নাতে চলে যাবে আর তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যেসব পরীক্ষা নেমে এসেছিল তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসবে না? তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল। এমনকি (তৎকালীন) রসুল এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চীৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহ‌র সাহায্য কবে আসবে?’ তখন তাদেরকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল— ‘অবশ্যই আল্লাহ‌র সাহায্য অতি সন্নিকটে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)

اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَ لَمَّا یَعْلَمِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ جٰهَدُوْا مِنْكُمْ وَ یَعْلَمَ الصّٰبِرِیْنَ

তোমরা কি ভাবছো এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ‌ তাআলা এখনো দেখেনই নাই তোমাদের মধ্যে কে তার পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আর কে সবরকারী। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪২)

اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تُتْرَكُوْا وَ لَمَّا یَعْلَمِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ جٰهَدُوْا مِنْكُمْ وَ لَمْ یَتَّخِذُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ وَ لَا رَسُوْلِهٖ وَ لَا الْمُؤْمِنِیْنَ وَلِیْجَةً١ؕ وَ اللّٰهُ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ۠

তোমরা কি ভেবে রেখেছো যে, তোমাদের এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে? অথচ আল্লাহ‌ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা (তার পথে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো এবং আল্লাহ, রসুল ও মুমিনদের ছাড়া কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহণ করলো না? তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ‌ তা জানেন। (সুরা তওবা, আয়াত ১৬)

وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّٰى نَعْلَمَ الْمُجٰهِدِیْنَ مِنْكُمْ وَ الصّٰبِرِیْنَ١ۙ আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করব যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ আর কারা দৃঢ়প্রত্যয়। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত ৩১)

সুরা আসরে ‘হক’ আর ‘সবর’-এর উপদেশকে সবার উপর আবশ্যক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে এই কাজ ছাড়া মানুষের ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে বাঁচার উপায় নেই।

وَ الْعَصْرِۙ

اِنَّ الْاِنْسَانَ لَفِیْ خُسْرٍۙ

اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوْا بِالْحَقِّ١ۙ۬ وَ تَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ۠

সময়ের কসম। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে যারা ঈমান এনেছে, নিজে সৎকাজ করে এবং একজন অন্যজনকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দেয় তারা এর ব্যতিক্রম। (সুরা আসর, আয়াত ১-৩)

আমি মোটামুটি স্পষ্ট করতে পেরেছি যে প্রকৃত কোরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া আর সঠিক পদ্ধতিতে কোরআন থেকে উপকৃত না হওয়ার ফলে একে-তো বিকৃত অর্থ ও ভাবের ছড়াছড়ি ঘটেছে, দ্বিতীয়ত কোরআন আমাদের ব্যক্তিজীবনে কোনো প্রভাব ফেলছে না। অথচ এই বিষয়ে খুব জোর দেওয়া হয়েছে যে কোরআনকে কার্যত বাস্তবায়ন করতে হবে, নাহলে লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা আর আজাবের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বনি ইসরাইলকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেন :

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ١ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا١ۚ وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤى اَشَدِّ الْعَذَابِ١ؕ

তোমরা তো আল্লাহর কিতাবের এক অংশের ওপর ঈমান আনছো আর অপর অংশ অস্বীকার করছো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে? (সুরা বাকারা, আয়াত ৮৫)

সঠিক পদ্ধতিতে কোরআন না শিক্ষার তৃতীয় ক্ষতি হচ্ছে— আল্লাহর নির্দেশ আল্লাহর ভাষ্য থেকে চিন্তা-ফিকিরের সাথে গ্রহণ না করে অন্য একজনের মনগড়া ব্যাখ্যার সাহায্যে গ্রহণ করছি। এবং প্রকৃত অর্থ বোঝার চেষ্টাই করছি না। (এরচেয়ে ক্ষতিকর আর কিছু হতে পারে?) আল্লাহ তাআলা কোরআনে পূর্ববর্তীদের অনেক কিসসা-কাহিনি বলেছেন, আমরা তার সঠিক মর্ম উদঘাটন করতে পারছি না, ফলে (কাফেরদের মতো) এভাবে মূল্যায়ন করছি :

اِنْ هٰذَاۤ اِلَّاۤ اَسَاطِیْرُ الْاَوَّلِیْنَ এ তো আগিলা আমলের কিসসা-কাহিনি। (সুরা আনফাল, আয়াত ৩১) অথচ আল্লাহ পাক এইসব কিসসা-কাহিনি আমাদের জীবনে প্রায়োগিক শিক্ষা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ করেন:

وَ كُلًّا نَّقُصُّ عَلَیْكَ مِنْ اَنْۢبَآءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهٖ فُؤَادَكَ١ۚ وَ جَآءَكَ فِیْ هٰذِهِ الْحَقُّ وَ مَوْعِظَةٌ وَّ ذِكْرٰى لِلْمُؤْمِنِیْنَ

(হে নবী!) এ অন্য নবী-রসুলদের বৃত্তান্ত, যা আমি তোমাকে শোনাচ্ছি, এসব এমন জিনিস যার মাধ্যমে আমি তোমার হৃদয়কে মজবুত করি। এসবের মধ্যে তুমি পেয়েছো সত্যের জ্ঞান এবং ঈমানদারগণ পেয়েছে উপদেশ ও জাগরণবাণী। (সুরা হুদ, আয়াত ১২০)

فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ یَتَفَكَّرُوْنَ

তুমি এ কিসসা-কাহিনি তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তাভাবনা করবে। (সুরা আ’রাফ, আয়াত ১৭৬)

یُرِیْدُ اللّٰهُ لِیُبَیِّنَ لَكُمْ وَ یَهْدِیَكُمْ سُنَنَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَ یَتُوْبَ عَلَیْكُمْ١ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ

তোমাদের আগে যেসব সৎলোক চলে গেছে, তারা যেসব পদ্ধতির অনুসরণ করতো, আল্লাহ‌ তোমাদের সামনে সেই পদ্ধতিগুলো সুস্পষ্ট করে দিতে এবং সেই সব পদ্ধতিতে তোমাদের চালাতে চান। তিনি নিজের রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান। আর তিনি সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানময়। (সুরা নিসা, আয়াত ২৬)

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ