শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


রিহলাহ্ মাবরুকাহ্: বরকতময় সফর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী।।

ফরিদাবাদ মাদরাসা। মুজাহিদে আ’যম হযরত আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসা ঢাকা। প্রধান মুফতী হিসেবে দায়িত্বে আছেন হযরত মাওলানা আবু সাঈদ।

পূর্বে নেওয়া সময় অনুযায়ী হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ১৬ নভেম্বর ২০২১ সোমবার হাযির হয়েছিলাম ফরিদাবাদ মাদরাসায়। সাথে ছিলেন মিরপুর ১৩-এ অবস্থিত দারুল উলূম ঢাকা এর মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা আল্লামা মাহমুদুল হাসান এবং আল্লামা কমরুদ্দীন আহমাদ গোরখপুরী এর বিশিষ্ট খলীফা, মুহাক্কিক আলিমে দ্বীন জনাব মাওলানা মুফতী রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ।

আসরের নামায পড়ে মুফতী সাহেব হুযুরের কামরায় হাযির হলে হুযুরের সাথে মুলাকাত হয়। সালাম বিনিময়ের পরে হুযুরের হালপুরসী করলাম। হুযুরও আমাদের খোঁজখবর নিলেন। মারকাযুদ্ দিরাসার কথা জিজ্ঞেস করলেন। এমনকি আমাদের সাথে সম্পৃক্তদের মাঝে থাকা হুযুরের মুরীদ মুতাআল্লিকদের কয়কজনের নাম-ধাম নিয়ে খোঁজখবর নিলেন।

অবাক লাগলো, হুযুরের বিচরণ এখন গোটা বাংলাদেশ জুড়ে। সেখানে কেন একটি অঞ্চলের ব্যক্তিবিশেষদের কথা হুযুর মনে রাখেন। এরাই জাতির আসল অভিভাবক এবং মিল্লাতে ইসলামিয়ার দরদী রাহবার। মাগরিবের আযান হলে মসজিদে নামায পড়ে সেখান থেকেই বিদায় নেওয়ার অনুমতি চাইলে বললেন-না, নামাযের পরে রুমে এসে নাস্তায় শরিক থাকার কথা বললেন।

দুই.

মসজিদে বেলালের তৃতীয় তলার প্রথম কাতারে উত্তর দিকে দাঁড়ালেন। হুযুরের কামরাও মাদরাসার পুরাতন ভবন; সম্ভবত বর্তমান নাম দারে আবু বকর-এর তৃতীয় তলায়। মসজিদের এই দিকটা হুযুরের কামরা থেকে কাছে। হুযুরের ডানপাশে দাড়ালেন জামিয়ার এক মহারত্ন, নমুনায়ে সুন্নতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, সদাপরিপাটি, নীরব সাধক হযরতুল উস্তায হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম।

এরপরে ছিলেন ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এ জামিয়ার আরেক মহীরুহ, গম্ভীর ব্যক্তিত্বের প্রতাপদ্বীপ্ত চাদরে ঢাকা একজন স্বভাবজাত সহজ-সরল, কোমলপ্রাণ নীতিবান মানুষ,কিন্তু মাদরাসার স্বার্থ এবং নীতিনৈতিকতার প্রশ্নে সদা আপোষহীন, সফল মুনতাযিম, নায়েব সাহেব খ্যাত হযরতুল উস্তায হযরত মাওলানা মুতীউর রহমান।

আপনি ফরিদাবাদের ছাত্র হলে চিত্রটি একটু কল্পনায় আনার চেষ্টা করুন। অসম্ভব ভালো লাগার একটি দৃশ্য। মনভরে দেখলাম। অধিক তৃপ্তির জন্য চোখ বড় বড় করে বারবার তাকালাম। শীতল ও কোমল তৃপির একটি অপার্থিব অনুভূতি হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলো।

بارک اللہ في حياتهم الطاهرة وعمّرهم بخدمات علميّة

তিন.

ফরিদাবাদ পড়াকালীন মুফতী সাহেব হুযুরের কাছে সরাসরি কোন কিতাবের সবক পড়ার সুযোগ হয়নি, তবে সালানা ইমতিহানে হুযুরের কাছে কাফিয়া পরীক্ষা দিয়ে ৯৬ নম্বর পেয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।

নায়েব সাহেবের কাছে কাফিয়া জামাতে কুদূরীর কিতাবুল বুয়ূ, মুফতী আব্দুস সালামের কাছে হেদায়েতুন্নাহু, উসূলুশ শাশী, নূরুল আনওয়ারের কিতাবুস সুন্নাহ পড়ার তাওফীক হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

প্রত্যকের সাথেই রয়েছে স্মরণ করার মতো অসংখ্য সুখস্মৃতি, যে স্মৃতি তাদের প্রতি আরও শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

কাফিয়া পড়াকালীন আমাদের এক সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু, চাঁদপুরের মুমিনবাড়ী নিবাসী মাযহারুল ইসলাম ইন্তিকাল করলে বন্ধুত্বের টানে তার কফিন নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে যাই। যদদূর মনের পড়ে পঞ্চান্ন জন ছাত্রের মাঝে চল্লিশ জনই গিয়েছিলাম।

সমবেদনা প্রকাশের মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে মাদরাসার পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা ইউনুস সাহেবকে মুহতামিম সাহেব দায়িত্ব দিলে তিনিও যান। হযরত মাওলানা ইউনুস আহমাদ তরজমায়ে কোরআন পড়াতেন। হুযুরের সাথে একটু বেতাকাল্লুফী ছিলো। হুযুর যাচ্ছেন শুনে আমরা আমাদের মতো ধরে নিয়েছিলাম যে, আমাদের যেতে হলে কোন ছুটিছাটা লাগবেনা।

লঞ্চে গিয়েছিলাম। রাত্রিকালীন নৌপথে শোকের সফরে বিনোদনের ছোঁয়া। মাদরাসায় পরদিন প্রয়াত মাযহারের প্রসঙ্গ দিয়েই সবক হওয়া না হওয়ার ভিতর দিয়ে কেটে যায়। শেষ ঘন্টা তথা আসরের নামাযের পূর্ব ঘন্টা ছিলো হযরতুল উস্তায নায়েব সাহেবের। ব্যস আর যায় কোথায়!

এ যেন এক অগ্নিমূর্তী!

ফিরে এসে রয়ে যাওয়া ছাত্রদের থেকে যা শুনেছিলাম -

আজ ছাত্র এত কম কেন?

বাকিরা কোথায়?

মাযহারদের বাড়িতে গেছে?

ছুটি নিয়া গেছে?

(ছুটির মনযুরী নায়েব সাহেবের থেকে নিতে হতো তখন, এখনের কথা জানিনা)

এক ছাত্রকে লক্ষ করে ‘এই তুমি রফীককে ডাইকা নিয়া আসো!’

রফীক হলো তৎকালীন দপ্তরীর নাম।

আরেকজন ছাত্রকে ‘এই তুমি সবার নাম লেখো।’

(রফীক ভাই আসার পরে)

রফীক! যাও এটা নূর ইসলাম সাহেবের কাছে দিয়ে আসো।

(মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেব মাতবাখের দায়িত্বে ছিলেন। তারমানে আমাদের সবার খানা বন্ধ।)

পরের দিন মাযহারদের বাড়ি থেকে কাফন-দাফন পর্ব শেষ করে মাদরাসায় আসলে মাদরাসার মুকীম ছাত্ররা একের পর এক সদ্য ঘটা কারগুযারীগুলো শোনাতে লাগলো। নৌভ্রমণ, ঐতিহ্যবাহী মুমিনবাড়ি মাদরাসা, ফরিদাবাদ মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা ইসমাঈল রহ. এর কবর যিয়ারত ও আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষাৎ, মাযহারদের গ্রাম, তার আত্মীয়-স্বজনের আন্তরিকতা, পুত্রহারা বাবা-মায়ের শোকসন্তপ্ত দিনরাত, হযরত মাওলানা ইউনুস আহমাদের তত্ত্বাবধানে আমাদের সার্বিক ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা আর কিছুই বলতে পারলামনা। কারণ - সবতো দৌঁড়ের ওপরে আছে।

যাহোক অনেক দৌড়ঝাঁপ করে শাইখুল আরব ওয়াল আযম হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ এবং হযরত মাওলানা আনোয়ারের মাধ্যমে সুপারিশ করিয়ে হযরত মুহতামিম সাহেবের হাতে পায়ে ধরে পূনরায় ডালভাত জারির ব্যবস্থা হয়।

সেই ঘটনার সতেরো বছর পরে একথা বলতেই হয় যে, হযরতুল উস্তায নায়েব সাহেবের দক্ষ ও শক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারনেই আজও ফরিদাবাদ জামিআ আপন স্বকীয়তায় মহিমান্বিত। তবে শুনেছি আজকাল হুযুরও কিছুটা নরম হয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা হুযুরকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন।

হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম সম্পর্কে লিখতে গেলে একটি স্বতন্ত্র বইয়ের কলেবর ছাড়িয়ে যাবে। পরে কখনো এবিষয়ে কথা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে কয়েকটি শিরনাম দিচ্ছি কেবল-

১। জুমআর নামায নিয়মিতই ব্যংক কলোনীতে অবস্থিত হুযুরের মসজিদে পড়তাম। জুমআর পরে হুযুর কিছু কথা বলতেন, হযরত থানভী রহ. এর কিতাব থেকে পড়ে শোনাতেন। মসজিদের দাতা এবং কমিটির সদস্যদের সবাই ব্যংকের কর্মকর্তা হওয়ায় তাদের অর্থায়নে গঠিত তহবিল থেকে হুযুর বেতন নিতেন না। এমনকি হুযুরের আব্বা ব্যংকের অফিসার হওয়ায় আব্বার বাসায় কিছু না খাওয়ার চেষ্টা করতেন। হুযুরের এই সিফাত এবং গুণাবলী আমাদের মাঝে খুব আলোচিত হতো।

২। হুযুর আরবীতে পরীক্ষা দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। পরীক্ষা পরবর্তীতে মুমতায ছাত্রদের পৃথক পৃথকভাবে ভুল সংশোধন করে দিতেন।

৩। জীবন চলার পাথেয় হিসেবে বহু উপদেশ হুযুরের তরফ থেকে পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। এরমধ্যে একদিনের শ্রেষ্ঠ উপদেশ হলো সর্বদা কিছু না কিছু মুখস্থ করতে থাকলে মুখস্ত শক্ত ধারলো হতে থাকে।

৪। হযরত আমাকে হাদিয়া হিসেবে দান করেছেন-

ক) যফারুল মুহাসসিলীন খ) মুশকিল তারকীবোঁ কা হাল গ) আততাসহীলুয জরুরী ফী শরহিল কুদূরী।

তিন.

মসজিদে নামায শেষে মুফতী সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে নায়েব সাহেবও আসলেন। নাস্তার দস্তার লাগানো হলে মুফতী সাহেব আমাদেরকেও খাস কামরায় ডাকলেন। নায়েব সাহেব আমাদরকে দেখে মৃদু মুচকি তাবাসসুমের মাধ্যমে বসার অনুমতি দিলেন।

নায়েব সাহেবকে যারা চিনে জানে, পরিবেশের ভারত্বটা অনুমান করতে আশাকরি তাদের অসুবিধা হবার কথা নয়। জীবনে কত-শত পরীক্ষা দিয়েছি, দেশে বিদেশে, বাংলা আরবী উরদু ইংরেজি হিন্দি-কত ভাষায়, লিখিত মৌখিক কত ভাবে। কিন্তু আজকের ইমতিহানটা তার থেকে, একেবারেই ভিন্ন । গাইড-নোট পড়ে প্রস্তুতী নেওয়ার পরে হলে গিয়ে প্রশ্নপত্র কমন না পড়ার মত পরীক্ষার্থীর অবস্থার মতো।

আমরা দুজনেই বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসা। দেহের ওজনটা যদিও থোড়ের হাড়ের জন্য বহন করা একটু কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে আজকাল। কিন্তু তারপরও হাঁটু গেড়েই বসতে ভালো লাগছিলো আলহামদুলিল্লাহ। ঐদিকে একজন বিচক্ষণ পিতার মতো নায়েব সাহেব আমাদেরকে বেশিবেশি খেতে তাকিদ করতে লাগলেন।

মুফতী সাহেবের মতো আজীম মানুষের দস্তারখানে আমাদের মতো গোলামদের জন্য যেখানে সামান্য একগ্লাস পানিই যথেষ্ট, সেখানে হুযুরের পক্ষ থেকে পেশ করা হলো মদিনার আজওয়া খেজুর, দেশি চাঁপা কলা, বিদেশি যাইতুন, মিলব্যারাকের সুস্বাদু কেক, গ্রামের মুড়ি ইত্যাদি।

ছাত্র যমানা হিসেবে নায়েব সাহেব মুফতী সাহেব হুযুরের চার বছরের সিনিয়র। নায়েব সাহেব ১৯৭৯ ঈসাব্দে যখন দাওরায়ে হাদীস পড়েন, মুফতী সাহেব হুযুর তখন হুযুরের ফরিদাবাদের যিন্দেগীর ২য় বছরে শরহে বেকয়া পড়েন। বলাবাহুল্য যে, তখন হেদায়া জালালাইন পৃথক পৃথক দুই দুই বছরে পড়ানো হতো।

আশ্চর্য হলাম উভয়ের প্রতি উভয়ের আযমত, শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মানবোধ দেখে। কথাও বলছেন কত গাম্ভীর্যের সাথে। দু’জনের কেহই কারো সামনে আসন করে বসলেন না। নিজেদেরকে জীবন্ত এই দুইজন আকবিরের বাস্তব আয়নার সামনে রাখলাম। নাহ, মিল নেই, কোন মিল নেই । তাদের ও আমাদের মাঝে আসমান যমীনের ফারাক।

দস্তরখান ছিলো খাবার গ্রহনের, মজলিস ছিলো শেখার, পরিবেশ ছিলো উপভোগ করার, মুহুর্ত ছিলো মনে রাখার। কোনটা কতটুকুন হয়েছে বলা সম্ভব নয়।

চার.

দস্তরখানপর্ব শেষে নায়েব সাহেব চলে গেলেন। মুফতী সাহেব হুযুর আজ বেশ খোশমেজাজে আছেন। আপনকরে আমাদের সাথে অনেক কথা বললেন। ফুটে ওঠলো জীবন কাননের থোকাথোকা গল্পের অনেক ফুলঝুরি। ওয়াল্লহি, মজলিস ছিলো ভীষণ উপভোগের। সেদিনের কথা জানতে পারলাম-

ফরিদাবাদ মাদরাসায় সর্বপ্রথম শরহেজামীতে ভর্তি হন ১৯৭৭ ঈসাব্দে। দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন ১৯৮৩ ঈসাব্দে। দেওবন্দে পূনরায় দাওরা ও ইফতা করেছেন যথাক্রমে ১৯৮৪ ও ৮৫ ঈসাব্দে। হযরত মাওলানা মুতীউর রহমান ফরিদাবাদ মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস পড়েছেন ১৯৮০ ঈসাব্দে।

৮১ তে ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দে। কিন্তু সেবছর তাকসীমে দেওবন্দের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায় হযরত নায়েব সাহেবের ইলমী সায়রাবী না হওয়ায় তিনি শান্ত পরিবেশে মুতালাআর উদ্দেশ্যে আরো এক বছর তথা ১৯৮২ ঈসাব্দেও দাওরায়ে হাদীস পড়েন। মুফতী সাহেব হুযুর নায়েব সাহেব সম্পর্কে বললেন

مضبوط استعداد کے حامل قابل بھی ہیں اور مقبول بھی

পাশাপাশি হযরত নানুপুরী রহ এর আশআর আবৃতি করলেন-

مقبول جو ہیں شاذ ہیں، قابل تو بہت ہیں

آئینہ کے مانند کم ہیں ، دل تو بہت ہیں

আশ্চর্য হলাম, মুফতী সাহেবের মতো এমন অল্পভাষী মানুষও নায়েব সাহেব সম্পর্কে কেমন উচ্চসিত ভূয়সী প্রশংসা করে যাচ্ছেন। আবার তারা সমসাময়িক।

আলোচনা থেকে বাদ পরল না হাল যামানার বিষয়গুলোও। রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করলেন। দেশ, জাতি ও উম্মাহর মুক্তির জন্য যে দরদ, ব্যথা আর অস্থিরতা লালন করেন তা আমাদের পাষাণ হৃদয়কেও ছুঁয়ে গেলো। আবারও প্রমাণ পেলাম, মুফতী সাহেব হুযুর দা.বা. কেবল মসনদে হাদীসের একজন যোগ্য মুহাদ্দিস বা খানকাহের সাজ্জাদাহ নাশীন এক পীর ও মুরশিদ নন; বরং নিরেট দেওবন্দী চেতনার ঝান্ডাবাহী যুগ সচেতন একজন বর্ষীয়ান মুফতীও বটে, যুগ ও জগৎ সম্পর্কে যার পরিচ্ছন্ন অবগতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

এশার নামাযের কাছাকাছি সময়ে মুফতী সাহেব হুযুরের দোয়া নিয়ে বিদায় নিলাম।

মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস বুখারী শরীফের সবকে হযরত মুহতামিম সাহেব থাকায় হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি। আল্লামা যিকরুল্লাহ খান কামরায় ছিলেন না বলে হুযুরকেও সালাম দিয়ে আসতে পারিনি। মুফতী ইমামুদ্দিন এসময়ে মসজিদে থাকেন।

উলাইকা আবাঈ।

পাঁচ.

রাত আটটার দিকে উপস্থিত হলাম সূত্রাপুরের অন্তর্গত কাগজীটোলা জামে মসজিদ সংলগ্ন ৬/৭ মোহনী মোহন লেনে অবস্থিত মানারাতুল উম্মাহ এর মেহমানখানায়। মানব কল্যাণে সযতন পরিচর্যা, Care and development for ummah এবং للتربية والتنمية এর শ্লোগান নিয়ে কার্যক্রম আরম্ভ করা সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি বহুমুখী গবেষণা সংস্থা। দাওয়াহ ও তারবিয়াহ, টেক ফর উম্মাহ, শরীয়াহ কনসালটেশন, গবেষনা ও প্রকাশনা, দারুত তাহকীক ও দারুত তাসনীফ বিভাগে বর্তমানে নানামুখী কাজ চলছে। যার বিস্তারিত পরিচিতি মানারাহ’র ওয়েব সাইট, পেইজ প্রসপেক্টাস ইত্যাদিতে রয়েছে। মানারাতুল উম্মাহর স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ মোমেনশাহীর একজন তরুণ আহলে ইলম, চিন্তক এবং বাস্তববাদী সজ্জন গুণী মানুষ, যার সৃজনশীলতার অনন্য সিফাত যে কাউকে প্রভাবিত ও আকর্ষিত করে। সপ্তাহ দুয়েক আগে মানারাহ আয়োজিত ইসলামী মুআশারাহ শীর্ষক সেমিনারে যোগদান উপলক্ষে আসা হয়েছিলো। তারও মাস খানেক আগে এমনিতেই এসেছিলাম দেখার জন্য। আজ তৃতীয় বার আসা।

বর্তমানে মানারাতুল উম্মাহর বৈঠকখানা লেখক,গবেষক, অনুবাদকসহ বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানীগুনীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে মাশাআল্লাহ। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাওলানা মুজিবুর রহমান, মাওলানা মুসা আল হাফীজ প্রমুখ মাঝেমধ্যেই আসেন।

আজ সাক্ষাৎ হলো বহুগ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মনযুর আহমাদ, সবার খবরের মাওলানা আব্দুল গফফার, সফল শ্রুতি লেখক চমৎকার উপস্থাপক মাওলানা মুহিম মাহফুজ এবং আমাদের বেশ ক’জন পুরাতন আসহাব ও আহবাবের সাথে। মনযুর ভাইয়ের সদ্য প্রকাশিত বাংলার ইতিহাসের উপর অনবদ্য সৃজনশীল মৌলিক গ্রন্থ দুই ভলিউমের সিন্ধু থেকে বঙ্গ এর একটি সেট আল্লামা কমরুদ্দীন আহমাদ এবং মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের খলীফা মাওলানা রেজাউল হক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহকে হাদিয়া পেশ করলেন।

আমি বইটির প্রকাশক মাকতাবাতুল আমজাদের পক্ষ থেকে বেশ আগেই পেয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। মনযুর ভাই বর্তমান কাজ করছেন ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নামের ইতিহাসের আরো একটি অধ্যায় নিয়ে। এরপরে করবেন ‘পচাত্তর থেকে শাপলা চত্বর’ শিরনামে। তার ভাষায়-

‘সিন্ধু থেকে বঙ্গে’ চলছে হাতাহাতি,

‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’তে হবে মারামারি,

আর ‘পচাত্তর থেকে ‘শাপলা চত্ত্বরে’ থাকবে রক্তারক্তি!

রাতে মানারাহ’র রকমারি আয়োজনে ভরপুর আতিথিয়েতা ঐতিহাসিক নববীভোজের ইতিহাস অধ্যায়কে স্মরণ করে দিলো। খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য দিয়ে দস্তরখান পরিপূর্ণ থাকায় ‘ডায়েট যুদ্ধে’ রণভঙ্গ দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ভাবলাম, থুক্কু মেরে আবার শুরু করা যাবে।

ছয়.

রাত দশটা বাজলেও পুরান ঢাকা থেকে এখনো বের হতে পারলামনা। মানারাহ’র মিনার থেকে নেমে এলাম সোজা অন্তীম মনযল তথা কবর যিয়ারতে।

কার কবর?

হ্যাঁ,তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন সাতচল্লিশের হিজরতের সূত্রে কোলকাতা থেকে ঢাকা আগমনকারী, বহু ইলমী কিতাবের মুসান্নিফ হযরত মাওলানা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বারাকাতী রহ.। দারুল উলূম দেওবন্দে ইফতা বিভাগে তার লিখিত কাওয়াঈদুল ফিকহ পড়ার তাওফীক হয়েছে। মনে পড়ে কাওয়াদের ফিকহের উস্তায, বহু গ্রন্থপ্রণেতা হযরত মাওলানা জামীল আহমাদ সাকড়োঢাবী রহ. তার পরিচিতি তুলে ধরলে ভীষণ আবেগ আপ্লূত হয়েছিলাম। পুরান ঢাকার কলুটোলাতে তার কবর অনুসন্ধানের প্রক্ষাপট সম্পর্কে মুহতারাম রেজাউল ভাই বললেন-

‘ফরিদাবাদ মাদরাসায় তার ইফতা বিভাগে পড়াকালীন এই কিতাবের উস্তায বর্ষীয়ান মুহাদ্দিস ও মুফতী হযরত মাওলানা মুফতী ওবায়দুল্লাহ তাদেরকে বলেছিলেন, যাও কলুটোলাতে মুফতী সাহেব শায়িত, তার কবর যিয়ারত করে আসো। এরপর আগামীকাল থেকে সবক আরম্ভ হবে। সেই থেকে পুরান ঢাকায় আসলে মুফতী সাহেবের কবর যিয়ারত করার চেষ্টা করি।’

মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ. ছিলেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সর্বপ্রথম খতীব (১৯৬৪-১৯৭৪) ও বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফতী এবং বহু উচ্চ ইসলামী গ্রন্থাবলীর রচয়িতা ও সংকলক। তিনি কলকাতা আলিয়া ও ঢাকা আলিয়ায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন।

তিনি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রথম খতিব ছিলেন তার অনেক বই আরব বিশ্বে ও উপমহাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সিলেবাসভূক্ত রয়েছে।

মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারী (হিজরী: ২২ মুহাররম ১৩২৯) ভারতের বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাকিম আবদুল মান্নান এবং মায়ের নাম সৈয়দা সাজেদা।

আমীমুল ইহসান চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। পিতা ও মাতা উভয় সূত্রেই তিনি নাজিবুত্তারাফাইন। জন্মের পর মুফতী সাহেবের নাম রাখা হয় মুহাম্মাদ এবং লকব ‘আমীমুল ইহসান’। তার দাদা সাইয়্যেদ নুরুল হাফেয আল-কাদেরিও একজন আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। তিনি কুরআনের বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল-কাদেরী আল মোজাদ্দেদী আল মুংগেরীর একজন খলীফা ছিলেন। তার বংশ-তালিকা হযরত ফাতেমা রা. হয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে বিধায় তার পূর্ব-পুরুষগণ নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. নিজ পিতা ও চাচার নিকট থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পাচ বছর বয়সে মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে তার চাচা আবদুদ দাইয়ানের নিকট হতে ৩০ পারা কুরআন খতম করেন। এরপর আবদুদ দাইয়ান তাকে ফার্সি ভাষা শেখান।

এরপর তিনি পাঞ্জাবের সাধক সুফি বরকত আলীর নিকট দুই বছর ধরে আরবী ব্যাকরণের মীজান মুনশায়ের, উচ্চতর ফার্সী সাহিত্য ও তাজবীদের প্রাথমিক জ্ঞান গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. সুফি বরকত আলীর মুরীদ হন। এজন্য মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. নিজ নামের শেষে ‘বারকাতী’ শব্দটি যুক্ত করেন।

দশ বছর বয়সে ১৯২১ সালে তিনি তার সুফি বরকত আলীর নিকট কুরআন মাজীদের অনুবাদ, সুফী মতবাদ সম্পর্কিত বই-পুস্তক, ইলমে সরফ, তাফসীর, হেসনে হাসিন ও ফার্সি সাহিত্যের উচ্চতর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন।

১৯২৬ সালে পনের বছর বয়সে ইহসান কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে আলিম পরীক্ষায় হাদীস বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফাযিল ও ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে হাদীস বিষয়ের উপর কামিল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং “মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন” উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি তার ওস্তাদ মুফতী মুশতাক আহমেদ কানপুরীর নিকট থেকে মুফতী সনদ লাভ করেন।

মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. ১৯২৫ সালে পিতার মৃত্যুর ২ বছর পূর্বে পারিবারিক চিকিৎসালয় পরিচালনা ও প্রেস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পাশাপাশি স্থানীয় জালুয়াটুলী গ্রামের মসজিদের ইমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে তাকে কলকাতার নাখোদা মাদ্রাসার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ও নাখোদা মসজিদের সহকারী ইমাম পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯৩৫ সালে নাখোদা মাদ্রাসা দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনি এই দায়িত্ব ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পালন করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল থেকে গ্রান্ড মুফতী অফ কলকাতা নামে এক বিশেষ সীলমোহর ও পদবি প্রদান করা হয়। এরপর থেকে তিনি 'মুফতী-এ-আযম' উপাধি লাভ করেন।

১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে মধ্য কলকাতার কাজী পদে নিয়োগ করেন। এই সময় তিনি একাধারে নাখোদা মসজিদের ইমামত, মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনার দায়িত্ব এবং কাজী পদের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

১৯৪০ সালে তিনি আঞ্জুমানে কুররায়ে বাংলার (বাংলার ক্বারী সমিতি) সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ভারত বিভাজন (১৯৪৭) পর্যন্ত তিনি টাইটেল কামিল ক্লাসে হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ এবং ফাযিল শ্রেণীতে উর্দু-ফার্সীর ক্লাস নিতেন। এছাড়াও তিনি কলিকাতার কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. ২২ আগস্ট কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এই দেশে চলে আসেন, এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন।

১৯৪৯ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা, হযরত মাওলানা যফর আহমদ উসমানী অবসর গ্রহণের পর মুফতী আমীমুল ইহসান সাহেব সেই পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সেই পদে নিযুক্ত ছিলেন।

আলিয়া মাদ্রাসায় কর্মরত অধ্যাপক হিসাবে তিনি বুখারী শরীফ পড়াতেন। তার নিজের উক্তি হতে জানা যায়, তিনি কমপক্ষে পঁচিশবার বুখারী শরীফের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। কয়েক হাজার হাদীস তার কণ্ঠস্থ ছিল, তিনি লেখালিখির কাজে সময় দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ১৯৬৯ সালের ১ই অক্টোবর উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৬৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কাবা শরীফের গেলাফ প্রস্তুত করে ঢাকায় প্রদর্শনীর জন্য আনা হলে গেলাফটি প্রদর্শনীর দায়িত্বে ছিলেন মুফতি মুহাম্মাদ গোফরান বারকাতী ও মুফতী আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ.।

১৯৬৪ সালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তিনি সেই মসজিদের খতীবের এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন।

অনেক আরবী ভাষা-ভাষী উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও রাষ্ট্রনায়কও তার খুৎবার প্রশংসা করেছেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানার পদে উন্নীত হবার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দান ঈদগাহে ইমামতি করেছেন।

১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় এসে একটি ভাঙ্গা মসজিদের খবর পান, এবং মসজিদটিকে পুনর্নির্মাণ করে নামকরণ করেন নকশবন্দী মসজিদ, তবে ১৯৯৪ সালে মসজিদটিকে সম্পূর্ণ নতুন ভিত্তিতে গড়ে তুলে নাম দেওয়া হয় মসজিদে মুফতী-এ আযম। আমীমুল ইহসান ঢাকায় এসে এই মসজিদের নিকটেই বাড়ি তৈরি করে আমৃত্য পর্যন্ত বাস করেছিলেন।

মুফতী আমীমুল ইহসান রহ. ইলমে তাসাউফের প্রানসাধক ছিলেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি তার চাচা মুহাম্মাদ আব্দুদ দাইয়ান বারাকাতী এবং শ্বশুর মুহাম্মাদ সুফি বরকত আলীর নিকট থেকে বিভিন্ন তরীকতের ইজাজাত গ্রহণ করেন। ঢাকায় আগমনের পর শাহ সাইয়েদ আবদুস সালাম আহমদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এরপরে তিনি নকশবন্দি বারকাতীয়া তরিকা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

মুফতী আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ. ১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (হিজরী: ১০ শাওয়াল ১৩৯৫) সালে ৬৩ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারনে নিজ বাস ভবনে মৃত্যুবরণ করেন।

ইসলামের সেবায় ও দাওয়াতি কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে তাকে মরণোত্তর স্বর্ণপদক ও সনদ দান করেন।

মুফতী আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ. ২০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন।

উল্লেখযোগ্য হলো-
ইলমে তফসীর এবং উসূলে তফসীর
ইতহাফুল আশরাফ বি হাশিয়াতিল কাশশাফ;
আল ইহসানুস সারী বিত তাওযিহ ই তাফসিরই সহীহিল বুখারী
আত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির;
আত- তাবশীর ফি শরহিত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির।
ইলমে হাদীস এবং উসূলে হাদীস
ফিকহুস সনানি ওয়াল আসার
মীযানুল আখবার
মানাহিজুস সুআদা;
উমদাতুল মাযানী বি তাখরিজে আহাদীস মাকাতিবুল ইমামুর রাব্বানী;
আল আরবাঈন ফিস্ সালাত;
আল-আরবাঈন ফিল মাওয়াকিত
আল আরবাঈন ফিস্ সালাতি আলান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
জামে জাওয়ামেউল কালাম
ফিহিরস্তত কানযুল উম্মাল
মুকাদ্দামায়ে সুনানে আবু দাউদ
মুকাদ্দামায়ে মারাসিলে আবু দাউদ,
লাইল ওয়ান নাহার
মীযানুল আখবার
মিয়ারুল আসার
হাশিয়ায়ুস সাদী
তোহফাতলি আখইয়ার
তালিকাতুল বারকতী
তালখীসুল মারাসিল
আসমাউল মুদিল্লীন ওয়াল মুখতালিতীন,
কিতাবুল ওয়ায়েযীন
মিন্নাতুল বারী
ফাতাওয়ায়ে বারকাতীয়া
তরীকায়ে হজ্জ,
আল কুরবাহ ফিল কুরা,
হাদিয়াতুল মুসাল্লীন
আতনবীহ লীল ফকীহ
লুববুল উসূল
মালাবুদ্দা লিল ফকীহ
আত-তারীফাতুল ফিকহিয়্যাহ
উসূলুল কারখী
উসূলুল মাসায়েলীল খিলাফিয়্যাহ
কাওয়ায়েদুল ফিকহ
আদাবুল মুফতী,
তুহফাতুল বারকাতী বি-শরহে আদাবুল মুফতী
আওজায়ুস সিয়ার
আনফাউস সিয়ার
সীরাতে হাবিবে ইলাহ
রেসালা-হায়াতে আবদুস সালাম
ইলমে তাসাওউফ
রেসালায়ে তরীকাত
আততাশাররুফ লি আদাবিত তাসাওউফ
তারীখে ইসলাম
তারিখে আম্বিয়া
তারিখে ইলমে হাদীস
তারীখে ইলমে ফেকাহ
আল হাভী ফি যিকরিত তাহাভী
তারিফুল ফুনুন ওয়া হালাতে মুসান্নেফিন
নাফয়ে আমীম
মুকাদ্দমাতুন নাহু
নাহু ফারসী
ওয়াজ ও মিলাদ সম্পাদনা
মজুমায়ে খুতবাত
মজুমায়ে ওয়াজ
ওয়াজিফায়ে সাদিয়া বারকাতীয়া
শাজারা শরীফা
সিরাজাম মুনীরা ও মিলাদ নামা
আদবে উর্দু,
শরহে শিকওয়াহ ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহ
মুযীলুল গাফলাহ আন সিমতিল কিবলাহ
মুয়াল্লেমুল মীকাত
নিযামুল আওকাত
ধোপঘড়ি
ওয়াসিয়াতনামা

হযরত মুফতী সাহেবের অনেক গ্রন্থ মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকাভুক্ত। তার প্রধান গ্রন্থসমূহ যেমনঃ ফিকহুস সুনানে ওয়াল আসার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ, তারীখে ইলমে ফিকাহ, তারীখে ইসলাম, তারীখে ইলমে হাদীস, আদাবুল মুফতী, কাওয়ায়েদুল ফিকাহ, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার প্রভৃতি মিসরের জামে আল আজহার, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দসহ, পাকিস্তান, সিরিয়া, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল কওমী, আলিয়া মাদ্রাসা গুলোতে পাঠ্য বই হিসাবে পড়ানো হয়।

এছাড়াও তার রচিত 'কিতাবুল আওকাত' এর উপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তার রচিত নামাযের সময়সূচি অনুযায়ী বর্তমানে সারা বাংলাদেশে নামাযের সময় ও ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ