শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি পরিদর্শনে যাচ্ছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল আল্লামা মাহমুদুল হাসানের আহ্বানে সর্বস্তরের আলেমদের নিয়ে পরামর্শ সভা শুরু মসজিদে শোরগোল নিয়ে রাসূল সা. যেভাবে সতর্ক করেছিলেন ভারতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ জয়পুরহাটে ১৫৫ মণ সরকারি চাল সহ আটক দুই তাপপ্রবাহ নিয়ে নতুন সংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’

ফুক্বাহায়ে আহনাফ: একটি আপত্তি ও তার নিরসন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আব্দুল আহাদ ।।

আমরা অনেক সময় আমাদের দ্বীনি ভাই অর্থাৎ তথাকথিত আহলে হাদীস ভাইদের মুখে শুনতে পাই- তারা একটি আপত্তি করে বসে যে, হানাফী মাযহাবের ফক্বিহ উলামায়ে কেরাম নাকি হাদীসের সনদের প্রতি কোন গুরুত্বই দিতেন না!সাথে সাথে তারা এটাও বলে থাকে যে, উলামায়ে আহনাফ নাকি আহাদিসে নাবাবিয়্যাহ এর ক্ষেত্রে অতি নগণ্য!

দলীল হিসাবে তারা যে কারন বর্ণনা করে থাকে তা হচ্ছে -উলামায়ে আহনাফ তথা হানাফী মাযহাবের আলিমগণ ফেক্বহের বই সমূহে যে সমস্ত হাদীস নিয়ে এসেছেন তার সবগুলিই সনদবিহীন। যদি হাদীস শাস্ত্রে তাদের পাণ্ডিত্য থাকতো তাহলে অবশ্যই সনদসহ হাদীস নিয়ে আসতেন। অতএব, এ থেকে বুঝা গেল হানাফী মাযহাবের ফক্বিহ আলিমগণ হাদীসের মূল ও মৌলিক যে বিষয় তথা সনদ (যোগসূত্র) রয়েছে তার প্রতি যত্নহীন ও জ্ঞানের দিক দিয়ে নগণ্য। বিধায় তাদের সনদহীন হাদীস ও যুক্তিভিত্তিক মাযহাব প্রত্যাখ্যাত।

জবাবঃ এই অনৈতিক আপত্তির জবাবে বিজ্ঞ আলেম, মুহাক্কিক,আল্লামা আব্দুর রশীদ নুমানী রহ.(মৃ. ১৪২৯ হি.) তিনি বলেন, হানাফী মাযহাবের উলামায়ে কেরামের উপর ব্যাপকভাবে যে আপত্তি দেওয়া হয়েছে, ফক্বিহদের সাথে সেই আপত্তির আদৌ কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না।

বাকি হ্যা! হানাফী মাযহাবের তিনটি এমন মহান গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির মধ্যে তার লেখকগণ সনদহীন হাদীস নিয়ে এসেছেন।আর সেগুলো হচ্ছে -শামসুল আইম্মা ইমাম সারাখসী রহ.( মৃ. ৪৫০ হি.) 'র রচিত মহানগ্রন্থ আল মাবসুত(المبسوط) ইমামুজ্জামান আল্লামা কাসানী রা.(মৃ.৫৮৭হি.) এর জগৎবিখ্যাত গ্রন্থ বাদায়েয়ুস সানায়ে'( بدائع الصنائع) এবং শায়খুল ইসলাম আল্লামা বুরহান উদ্দীন মারগিনানী রা. রচিত ঐতিহাসিক ফেক্বাহগ্রন্থ আল হিদায়া(الهداية)।

এই তিনটি মহান গ্রন্থাদির মধ্যে উনারা যে সব হাদীস ও আসার (সাহাবায়ে কেরামের বাণী) বর্ণনা করেছেন তার সবগুলিই সনদহীন একথা বাস্তব। কিন্তু এগুলো সনদহীন হওয়ার যুক্তিক রহস্যও রয়েছে, তা হচ্ছে -উপরোক্ত মুসান্নিফগণ যে সব বর্ণনা এগুলোর মধ্যে নিয়ে এসেছেন তার প্রত্যেকটি রেওয়ায়তই মুতাকাদ্দিম উলামায়ে আহনাফ (পূর্ববর্তী হানাফী আলেমগণ)’র গ্রন্থাদী থেকেই নিয়েছেন।

আর এসব গ্রন্থের লেখকগণ নিঃসন্দেহে ফক্বীহ ও মুজতাহিদ ছিলেন।তাকওয়া -পরহেজগারীর মধ্যে উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে উসওয়াহ তথা আদর্শ। আর উনারা যেগুলি গ্রন্থাদি রচনা করেছেন তার সবগুলিই সনদসহ বর্ণনা করেছেন।

হাফিজ কাশিম বিন কাতলুবাগা রাহি. (মৃত্যু ৮৭৯ হি.) তিনি মুনয়াতুল আলমায়ী,,(منية الألمعي فيما فات من تخريج أحاديث الهداية للزيلعي) বইয়ের প্রথমদিকে বলেন, আমাদের উলামায়ে মুতাকাদ্দিম-রাহিমাহুমুল্লাহ-ফেক্বহী মাসআলার ক্ষেত্রে যে সমস্ত আহাদীস দলীল সরূপ নিয়ে এসেছেন তার সবগুলি সনদসহ বর্ণনা করেছেন। যেমন, ইমাম আবু ইউসুফ রাহি. (মৃ.১৮২ হি.) তার লিখিত বই কিতাবুল খিরাজ (كتاب الخراج)
ও আমালী(أمالي) ,ইমাম মুহাম্মদ রাহি. (মৃ.১৮৯ হি.) কিতাবুল আসল(كتاب الأصل)ও কিতাবুল ইয়াসীর( كتاب اليسير)
উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও ইমাম তাহাবী রাহি. (মৃ.৩২১ হি.) ইমাম খাসসাফ রাহি. (মৃ.২৬১ হি.) ইমাম আবু বকর রাযি. রাহি. (মৃ.৩৭০ হি.) ইমাম করখী রাহি.( মৃ.৩৪০ হি.) সহ অনেক জগৎবিখ্যাত শায়েখদের রচনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

এই সমস্ত ইমামরা নিজ নিজ রচনাবলীতে আহাদিসসমূহ সনদ সহ নিয়ে এসেছেন। এ সব মনীষিদের পরে যে সকল মনীষি এসেছেন তারা এদের কিতাবাদীর উপরই নির্ভর ও পূর্ণ অনুসরণ করে আপন গ্রন্তাদির মধ্যে সনদছাড়া হাদীস নিয়ে এসেছেন।

আর এদের উপর নির্ভর করে স্বীয় কিতাবে হাদীসের সনদসমূহ না আনলেও উম্মাহ তাদের কিতাবাদী গুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নিয়েছে। আর এভাবে আমলও চলে আসছে যা অধ্যবদি চলমান।

আসলে বাস্তবতা হল- উলামায়ে মুতাআখখিরিনদের আত্মবিশ্বাস পূর্ববর্তীদের উপর এতোটুকুই ছিলো যতটুকু বিশ্বাস ইমাম বাগোবী রাহিমাহুল্লাহ( মৃ.৫১৬ হি.)ও ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ( মৃ.১১৭৬ হি.)'র সিহাহ সিত্তাহ তথা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ এর উপর ছিল। অতএব সহীহ ছয় কিতাবের কোন হাদিস যে কেহ সনদ ছাড়া উল্লেখ করলে এতে দোষের কিছু নেই। বরং এটা বড়দের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশই হয়। যেমন, ইমাম বাগাবী রাহি. মাসাবিহুস সুন্নাহ(مصابيح السنة)ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহি. তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা (حجة الله البالغة
) সমূহের মধ্যে যে সমস্ত বর্ণনাবলী তারা নিয়ে এসেছেন তা সনদহীন নিয়ে এসেছেন।কারন তারা এই সব হাদীসের ক্ষেত্রে সিহাহ ও সুনানের লেখকদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে তাদের কিতাবের হাদীসই নিয়ে এসেছেন।তবে শুধুমাত্র হাদীসের সনদটা বাদ দিয়ে দিছেন। এটার কারন সংক্ষিপ্ত করনও হতে পারে তবে প্রতমটাই শ্রেয়।

তবে এর কারন এটা কখনই নয় যে, সনদ সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ বা স্বল্পজ্ঞানী ছিলেন। অতএব এখন যদি কেহ প্রশ্ন করে বসে যে, ইমাম বাগোবী ও মুসনাদুল হিন্দ আল্লামা দেহলভী রাহিমাহুমাল্লাহ হাদীসের ক্ষেত্রে স্বল্পজ্ঞানী ছিলেন!

তখন আমরাও বলবো এরকম যারা বলে তারাই স্বল্পজ্ঞানী, হাদীসের ক্ষেত্রে অজ্ঞ। এজন্য আল্লামা আব্দুল্লাহ লাজপুরী লাহুরী হাফি. বলেন-উপরোক্ত গ্রন্থ সমূহ থেকে পরবর্তী ফক্বীহগণ হাদীসসমূহ স্বীয় কিতাবে সনদ ছাড়া নিয়ে এসেছেন। এর মানে এটা নয় যে, উনারা হাদীসের ইলমে স্বল্প জ্ঞানী ছিলেন। (হাদীস কে উসুল) তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে,মুসলমানদের উপর সপ্তম শতাব্দীতে তাতারিদের ফেৎনায়ে তাতার (বিস্তারিত দেখুন "তাতারিদের ইতিহাস" রাগিব সারজানী)নামে এক ভয়ংকর বিপদ আপচে পড়ে। যার হৃষ্টতা অনারব দেশ সমূহ থেকে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফাহ (বাগদাদ, ইরাক) পর্যন্ত স্পর্শ করে। শুধু এতেই শেষ নয়, বরং তাতারিরা মুসলিম ইতিহাসের তখনকার যতসব ইতিহাস -ঐতিহ্য ছিল(ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,ইসলামী লাইব্রেরি, প্রদর্শনীয় স্থান ইত্যাদি) তার সবগুলো সমূলে ধ্বংস করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিমদের হাত থেকে ঐ সকল গ্রন্থাদি সহ অনেক মূল্যবান জিনিস পত্র বিলিন হয়ে যায়।যা সত্যিই দুঃখজনক।

তখন মুসলিম ইতিহাসে অনাকাঙ্ক্ষিত এক বিপর্যয় নেমে আসে যা কারো কল্পনায়ই ছিল না। এইসময় তাতারিরা অগেকার অনেক গ্রন্থাদি ধ্বংস করে দিলে পরবর্তী আলেমদের মধ্যেও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। যা সবার কাছে জানা কথা।

তবে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য হওয়ার অন্য আরেকটি কারন ছিল তারা এ সমস্ত হাদীসকে পূর্ববর্তী হানাফীদের কিতাবাদীতে না খোজে মুহাদ্দিসিনদের কিতাবাদীতে খোজেছিলেন।

আর মুহাদ্দিসিনদের কিতাবাদীতে না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে উনারা মতানৈক্যে লিপ্ত হয়ে যেতেন। (হাদীস কে উসুল-৪১)আর এরকারনেই কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস রাহি. হেদায়া কিতাবের কিছু হাদীস নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। যা অবশ্যই দোষের কারন নয় বলে মনে করি।

আর হিদায়ার লেখকের ক্ষত্রে একটি কথা না বললে নয় যে, ইমাম মারগিনানী রাহি. এর ব্যাপারে এমন মন্তব্য তো করার প্রশ্নই আসে না কারন তিনি শুধু একজন মুহাদ্দিস ই ছিলেন না বরং তিনি হাদীসশাস্ত্রে একজন হাফিজুল হাদীস ছিলেন। বিধায় যে সব হাদীস অন্য ফক্বীহের উপর আস্থাবান হয়ে উনার কিতাব থেকে সনদ ছাড়া নিয়ে এসেছেন তার উপর ভিত্তি করে উনাকে এবং উনার জামাতের উপর মন্দ আপত্তি উত্তাপন করা সভ্য জাতির পরিচয় বহন করে না।

সাহিবুল হিদায়াকে জানতে হলে উনার ইলমের গভীরতা বুঝতে হলে উনার লিখিত গ্রন্থাদী যে কেহ দেখতে পারে। অতএব আমরা নিজের স্বল্প জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে অল্প কিতাবাদী দিরাসা করে ইলমের সমুদ্র ও হাদীসের ধারক-বাহকদের নিয়ে মন্তব্য করা অবশ্যই ভদ্রলোকের কাজ বলে মনে করি না।

পরিশেষে হানাফী মাযহাবের ভাস্যকারদের নিয়ে মন্তব্য কারীদের প্রতি অনুরোধ করবো -আপনারা হানাফিদের মানহাজ,মাযহাব ভালকরে পড়ুন, দীর্ঘ চর্চা করুন, তখন ইনশাআল্লাহ বুজতে পারবেন, বাস্তবেই কী ফুক্বাহায়ে আহনাফ হাদীসের সনদের প্রতি গুরুত্বহীন ছিলেন? এবং বাস্তবেই কী তারা হাদীস শাস্ত্রে স্বল্প জ্ঞানী ছিলেন কিনা! না ভাই!কখনও এমনটা বুঝে আসবে না ইনশাআল্লাহ।
রাব্বে কারীম তোমাকে ও আমাকে সঠিক বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ