মোস্তফা ওয়াদুদ: বাংলাদেশ কওমি মাদরাসার সরকার স্বীকৃত সর্বোচ্চ শিক্ষাসংস্থা আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর অন্তর্ভূক্ত সিলেট অঞ্চলের কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ’।
৮০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে অভিযোগ তুলছেন বোর্ডেরই অপর কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা বলছেন, ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ’ চলছে সংবিধান বহির্ভূতভাবে।
যুক্তি হিসেবে অভিযোগকারীরা বলেছেন, ‘সংবিধানে আছে, বোর্ড রাজনীতিমুক্ত থাকবে।’ কিন্তু বর্তমানে বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। এদিকে বোর্ডের গত নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা বলছেন, সে নির্বাচনে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
এসব নানা বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরে গত ৯ মে বর্তমান এদারার মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছীর-এর কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সিলেটের শাহজালাল রহ. দরগাহ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ীসহ কয়েকজন শীর্ষ আলেম। লিখিত অভিযোগে আরও স্বাক্ষর করেন কৌড়িয়া মাদরাসার মুহতামিম হাফিজ মাওলানা মুহসিন আহমদ ও সোবহানীঘাট মাদরাসার মুহতামিম হাফিজ মাওলানা আহমদ কবীর। ১০ পৃষ্ঠার অভিযোগের কপিটি আওয়ার ইসলামের এ প্রতিবেদকের হাতে পৌঁঁছেছে।
তবে বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছির বলেছেন, ‘তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১২ এপ্রিল ২০২১ তারিখে আমরা ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। সে কমিটি তদন্ত করে তাদের অভিযোগের সত্যতা পায়নি। তারা অভিযোগ করেছিলো, মাওলানা তৈয়বুর রহমান চৌধুরী মুরাদপুর মাদরাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থেকেও মাদরাসার সহকারী মুহতামিম পদের দায়িত্বশীল হিসেবে বোর্ডের সদস্য হোন। কিন্তু তদন্ত করে মাদরাসার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।’
এরপরও এদারার সর্বশেষ মজলিসে আমেলার বৈঠকে এসব অভিযোগ আমলে বোর্ডের বর্তমান সভাপতি শায়খ জিয়াউদ্দীন বলেছেন, ‘আমার নিজের কমতির কারণেই হয়তো এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেন তিনি। এরপর সে মজলিসেই তাদের অভিযোগের বিষয়টি সুরাহা হয়। নতুন করে আবার কেনো এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা আসছে?’ এমন প্রশ্ন করেন বোর্ডের মাহসচিব মাওলানা আব্দুল বছীর।
জানা গেছে, ১৯৪১ সালে গঠিত এ বোর্ডের অধীনে সিলেট বিভাগের ৪ জেলার প্রায় ৭৯৫টি মাদরাসার অর্ধলক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে বোর্ডটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী বলেন, ‘বোর্ডের বিগত নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে শূরা গঠন ও অন্যান্য কার্যক্রমে নিজস্ব সংবিধান লঙ্ঘন ও অবমাননা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তাদের পছন্দের মাওলানা ইউসুফ খাদিমানী, হাফিজ মাওলানা ফখরুজ্জামান ও মাওলানা তৈয়বুর রহমান চৌধুরীকে বোর্ডে পুনর্বাসনে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অথচ এ তিনজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের কথা অভিযোগে বলা হয়েছে।’
অভিযোগকারীদের অন্যতম সদস্য মাওলানা আহমাদ কবীর জানান, ‘আমরা যাদের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছি। তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে আলাাদা প্রমাণ উল্লেখ করেছি।’
তবে আপনারা বর্তমানে কেমন বোর্ড দেখতে চান? মাওলানা আহমাদ কবীরকে এমন প্রশ্ন করলে আওয়ার ইসলামকে তিনি জানান, ‘আমরা চাই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান। ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি সাংবিধানিকভাবে নির্ভেজাল ও ক্লিন ইমেজের লোকদের মাধ্যমে পরিচালিত হোক।’
এদিকে সংবিধানের বাইরে চলছে এদারা বোর্ড-এমন বক্তব্যকে স্ববিরোধী ও ভিত্তিহীন দাবি করে বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছীর আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান রচনা ও সংশোধনের সময়ে অভিযোগকারীরা ছিলেন। তিনি বলেন, সংবিধানে আছে বোর্ড রাজনীতিমুক্ত থাকবে। কিন্তু একথা বলা নেই যে, বোর্ডের ব্যক্তিরা রাজনীতিমুক্ত থাকবে। এখানে এ বিষয়টি বুঝতে ভুল হচ্ছে অভিযোগকারীদের।’
যুক্তি হিসেবে মাওলানা আব্দুল বছীর বলেন, ‘কেননা আল-হাইয়াতুল উলইয়ার গেজেটের ৯ নং পৃষ্ঠায় বলা আছে, এ কমিটি হাইয়াতুল উলইয়ার স্থায়ী কমিটি বলে বিবেচিত হবে। আর কমিটির সদস্যরা দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থাকবে। অর্থাৎ বোর্ডের পরিচয়ে কেউ রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তব্য দিতে পারবে না। এ বিষয়টি বুঝতে তারা ভুল করছেন। না হয় বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মরহুম আব্দুল করিম রহ. কৌড়িয়া আজীবন জমিয়তের সভাপতি ছিলেন। তখনও তো এ সংবিধান ছিলো। তখন কেনো এমন প্রশ্ন করা হয়নি। এতদিন পরে কেন এসব প্রশ্ন?’
তাছাড়া মজলিশে শূরা গঠনে ১১ সদস্যের উপস্থিতিতে ১২৫ জনের কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগকারী মাওলানা আহমদ কবীরের ছোটভাই মাওলানা আহমদ ছগীরকে নিজের প্রস্তাবে সদস্য বানানো হলেও সেটি অভিযোগে নেই কেন-এ প্রশ্নও রাখেন মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছীর।
অভিযোগকারীদের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ‘সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, ছাতক, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা উপজেলা থেকে বোর্ডের কমিটিতে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ সম্পাদক তার ছেলে মাওলানা মিসবাহ উদ্দিনকে সংবিধান বহির্ভূতভাবে কমিটিতে স্থান দেন।’
মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক জানান, ‘আমরা তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলাম। কোনো প্রতিকার পাইনি। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আমরা চাই, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত হোক।’
এমডব্লিউ/