শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে আলেম অন্তর্ভুক্তির দাবি হেফাজতে ইসলামের সিংগাইরে হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশ ২৯ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা হলে ‘হাত ভেঙে’ দেওয়া হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘জুলাই বিপ্লবে আলেম-শিক্ষার্থীদের অবদান ও প্রত্যাশা’ নিয়ে আলোচনা সভা সোমবার সিলেটে অনুষ্ঠিত বিহানের ‘লেখালেখি ও এডিটিং কর্মশালা’ দেশে ফিরে কর্মফল ভোগ করুন, শেখ হাসিনাকে জামায়াতের আমির রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামবিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না: জাতীয় পরামর্শ সভা যাত্রাবাড়ীতে জাতীয় পরামর্শ সভায় গৃহীত হলো ৭ প্রস্তাব বারিধারায় হেফাজতে ইসলামের পরামর্শ সভা শুরু ফ্যাসিবাদী সরকারের মূল দায়িত্বের কর্মকর্তারা এখনও অটল রয়ে গেছে

মহীয়সী নারী উম্মুল মোমিনিন সাওদা বিনতে জাময়া রা.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।

উম্মুল মোমিনিন সাওদা বিনতে জাময়া রা.। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশের আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের। বংশ পরম্পরা হলো- সাওদা বিনতে জাময়া ইবনে কায়েস ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদুদ ইবনে নসর ইবনে মালেক ইবনে হাসাল ইবনে আমের ইবনে লুয়াই। মা নাজ্জার গোত্রের শামুস বিনতে কায়েস ইবনে যায়েদ ইবনে আমর। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণ: নবুওয়তের প্রাথমিক জামানায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নবীজির কাছে বাইয়াত হন। তার বংশে তিনিই ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী। প্রথমে চাচাতো ভাই সাকরান ইবনে আমরের বিয়েবন্ধনে ছিলেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, সাওদা বিনতে জাময়া রা. সোহাইল ইবনে আমরের ভাই সাকরান ইবনে আমরের স্ত্রী ছিলেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।

আবিসিনিয়ার দ্বিতীয় হিজরতের সময় তারা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে হিজরত করেন। মক্কায় গেলে স্বামী ইন্তেকাল করেন। কারও কারও মতে আবিসিনিয়ায় ইন্তেকাল করেন।

নবীজির সঙ্গে বিয়ে: স্বামী সাকরান মারা যাওয়ার পর ইদ্দত পালন শেষ করলে রাসুল সা. তাঁকে প্রস্তাব দিলেন এবং বিয়ে করলেন। এটি সাওদার (রা.) অনেক বড় বৈশিষ্ট্য যে, খাদিজার রা. পর সর্বপ্রথম তিনিই নবীজির সা. সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। খাদিজার (রা.) ইন্তেকালে নবী (সা.) অনেক শোকার্ত ও ব্যথিত ছিলেন। এ অবস্থা দেখে ওসমান ইবনে মাজউন (রা.) এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকিম বললেন, আপনার একজন অন্তরঙ্গ সঙ্গী দরকার। তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঘর-বাড়ি, সন্তানাদির দেখাশুনা সবকিছুর দায়িত্ব খাদিজার (রা.) ছিল।
নবীজির (সা.) ইঙ্গিতে তিনি সাওদার (রা.) বাবার কাছে গেলেন।

জাহেলি পদ্ধতিতে সালাম করলেন-নিঅমা সাবাহান (আপনার সকাল কতই না উত্তম) অতঃপর বিয়ের প্রস্তাব শোনালেন। বাবা বললেন, হ্যাঁ, মুহাম্মদ (সা.) সম্ভ্রান্ত পাত্র। কিন্তু সাওদাকেও (রা.) জিজ্ঞেস করে নাও। সবকিছু সিদ্ধান্ত হলে নবী (সা.) নিজে আগমন করলেন। সাওদার (রা.) বাবা বিয়ে পড়ালেন।

৪০০ দেরহাম দেনমোহর নির্ধারণ করা হলো। বিয়ের পর সাওদার (রা.) ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাময়া (রা.) সে সময় কাফের ছিলেন। হজ থেকে ফিরে এসে এ বিয়েতে চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন এবং রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। ইসলাম গ্রহণের পর এ নির্বুদ্ধিতার কারণে তাকে অনেক আফসোস করতে হয়।

সাওদার (রা.) বিয়ে দশম হিজরির রমজানে হয়েছে। তাঁর ও আয়েশার (রা.) বিয়ে কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে যে, কার বিয়ে আগে হয়েছে। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, সাওদার (রা.) বিয়ে আগে হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আকিলের (রহ.) মতে আয়েশার (রা.) আগে হয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, সাওদা (রা.) প্রথম স্বামীর ঘরে থাকতে একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন, হয়তো আমার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী এবং তোমার বিয়ে রাসুলের (সা.) সঙ্গে হবে। এ স্বপ্ন হুবহু বাস্তবায়িত হয়েছে।

নবুওয়াতের ১৩তম বর্ষে নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সাওদাকে (রা.) নিয়ে আসার জন্যে জায়েদ ইবনে হারেসাকে (রা.) মক্কায় পাঠালেন। তিনি ও ফাতেমা (রা.) জায়েদ ইবনে হারেসার (রা.) সঙ্গে মদিনায় এলেন। দশম হিজরিতে নবীজির (সা.) হজব্রত পালন করার সময় সাওদা (রা.)ও সঙ্গে ছিলেন। তিনি যেহেতু অনেক উঁচু ও স্থুলদেহী গড়নের ছিলেন, তাই দ্রুতগতিতে চলতে পারতেন না। এজন্য নবী (সা.) মুজদালিফা থেকে অন্যসব মানুষ রওনা হওয়ার আগেই তাঁকে রওনা করার অনুমতি দিলেন। কেননা, দ্রুতগতিতে চলতে তাঁর অনেক কষ্ট হবে।

মৃত্যু: ইমাম ওয়াকিদি (রহ.) বলেন, তিনি মুয়াবিয়া (রা.) এর শাসনামলে ৫৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা হলো, তিনি ওমর ফারুক (রা.) এর খেলাফতের শেষ সময়ে ইন্তেকাল করেন। ওমর (রা.) ২৩তম হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এজন্য সাওদার (রা.) মৃত্যুর সন ২২তম হিজরি হবে। খামিসে এ বর্ণনা এসেছে এবং এটাই অধিক বিশুদ্ধ। এ বর্ণনাকে ইমাম বোখারি (রহ.), যাহাবি (রহ.), জাযারি (রহ.), ইবনে আবদুল বার (রহ.) ও খাযরাজি (রহ.) গ্রহণ করেছেন। তার মৃত্যু হয় মদিনা মুনাওয়ারায়।
সন্তান-সন্ততি : তাঁর গর্ভে নবীজি (সা.) থেকে কোনো সন্তান আসেনি। প্রথম স্বামী সাকরান একটি ছেলে রেখে গেছে। নাম আবদুর রহমান, যিনি জালওয়া ফারেস যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন।

মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব : সাওদা (রা.) থেকে মাত্র পাঁচটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে বোখারিতে রয়েছে একটি। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের, ইয়াহইয়া ইবনে আবদুর রহমান ইবনে সা‘দ ইবনে যারারাহ তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান, ইউসুফ ইবনে যোবায়ের ও যোবায়ের ইবনুল আওয়ামের কৃতদাস প্রমুখ তাবেয়িনে কেরাম।

পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার পেছনে ছিল তাঁর অবদান। তিনি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বাইরে গেলেন। ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর মত ছিল নবীপত্মীরা যেন বাইরে না যায়। এজন্য তিনি একবার নবী (সা.) এর সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু নবী (সা.) তখন চুপ ছিলেন। একদিন সাওদা (রা.) প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য জঙ্গলে গেলেন। রাস্তায় ওমর (রা.) পেয়ে গেলেন। সাওদা (রা.) তো অনেক উঁচু আকৃতির ছিলেন। ওমর (রা.) তাঁকে চিনে ফেললেন এবং বললেন, সাওদা, তোমাকে চিনে ফেলেছি। ওমরের (রা.) এ কথায় তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। নবী (সা.) এর কাছে ওমরের (রা.) বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। বোখারিতে এসেছে, এ ঘটনার পরই পর্দার বিধান সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয়। এর পর নবীপত্মী সবাই পর্দার প্রতি যত্নবান হয়ে যান।

আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে খুনশুটি : আয়েশা (রা.) বলেন, আমি সাওদা বিনতে জাময়া (রা.) এর কাছে গিয়ে বসলাম, আর রাসুল (সা.) আমার ও তাঁর মাঝে অবস্থান করছেন। আমি হারিরা (এক প্রকার খাবার) বানিয়ে নিয়ে এসেছি। আমি সাওদাকে (রা.) লক্ষ্য করে বললাম, তুমি খাও। তিনি বললেন, আমি তা খেতে পারব না। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! অবশ্যই তোমার তা খেতে হবে নয় তো আমি এটা দিয়ে তোমার চেহারা মাখিয়ে দেব।

তিনি বললেন, আমি তা খেতে পারব না। অতঃপর আমি এ থেকে কিছু নিয়ে তাঁর চেহারায় মাখিয়ে দিলাম, আর রাসুল (সা.) আমাদের মাঝখানে থেকে হাসছেন। অতঃপর তিনিও আমার মুখে মাখিয়ে দেওয়ার জন্য তা থেকে কিছু হাতে নিলেন। রাসুল (সা.) তখন দাঁড়ানো থেকে একটু ঝুঁকে গেলেন যাতে তিনি আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারেন। অতঃপর তিনি আমার মুখ মাখিয়ে দিলেন আর রাসুল (সা.) হাসছেন।

চরিত্র: আয়েশা (রা.) বলেন, সাওদা (রা.) ছাড়া কোনো নারীকে দেখে আমার মনে হয়নি যে, তাঁর মধ্যে আমার রুহ রয়েছে। আনুগত্য ও মান্যতায় তিনি ছিলেন নবীপত্মীদের মধ্যে সেরা। বিদায় হজের সময় নবী (সা.) স্ত্রীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আমার পর ঘরে বসে থাকবে।

তিনি এ আদেশ এত কঠোরভাবে পালন করেছেন যে, এরপর আর কখনও হজব্রত পালন করেননি। তিনি বলেছেন, আমি তো হজ ও ওমরা পালন করে ফেলেছি। তাই এখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ঘরেই থাকব।

উদারতা ও দানশীলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। নবীপত্মীদের মধ্যে আয়েশা (রা.) ছাড়া এ গুণে ছিলেন অন্য সবার সেরা। একবার নবী (সা.) তাঁকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। তিনি তখন নবী (সা.) এর সংশ্রব থেকে মাহরুম হয়ে যাবেন এ কারণে তাঁর রাতের ভাগ আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দেন। নবীজিও তা গ্রহণ করেন।

লেখক: শিক্ষক, হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ