মুফতি আব্দুর রহিম: হুজূর সা. ও সাহাবায়েকেরামের জামানায় হাদীস লেখার নিয়ম খুব ভালোভাবে প্রচলিত ছিলো। তখন হাদীসের সংকলন ব্যক্তিগত স্মারক আকারে তৈরি হয়েছে। কয়েকটি সংকলনের কথা উল্লেখ করা হলো।
১. আস সহীফাতুস সাদিকা (الصحيفة الصادقة) মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. হাদীসের যে একটি সংকলন তৈরি করেছিলেন, এর নাম রেখেছিলেন الصحيفة الصادقة। এটিই ছিলো সাহাবী যুগে সবচেয়ে বড় হাদীস সংকলন। এর হাদীসগুলোর মোট সংখ্যা নিশ্চিতরূপে জানা যায়নি। কিন্তু সহীহ বুখারীতে এর উপর কিছুটা আলোকপাত হয়েছে باب كتابة العلم এ বর্ণিত হযরত আবু হুরায়রা রা. এর একটি হাদীস দ্বারা।
তিনি বলেন, صحيح البخاري (১ / ৩৪( مَا مِن أَصحَابِ النَّبِيِّ صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَأَحَدٌ أَكثَرَ حَدِيثًا عَنهُ مِنِّي، إِلَّا مَا كَانَ مِن عَبدِ الله بنِ عَمرٍو، فَإِنَّهُ كَانَ يَكتُبُ وَلاَ أَكتُبُ
এ থেকে বুঝা গেলো, হযরত ইবনে আমর রা. এর হাদীস সংখ্যা হযরত আবু হুরায়রা রা. এর হাদীস অপেক্ষা বেশি ছিলো। হযরত আবু হুরায়রা রা. এর হাদীস সংখ্যা ৫৩৬৪ অথবা ৫৩৭৪। দ্বিতীয়টি সহীহ। অতএব ইবনে আমর রা. এর হাদীস সংখ্যা সুনিশ্চিতরূপে এর চেয়ে বেশি হবে। এ দিকে হযতর আমর ইবনুল আস রা. এর এই উক্তি আবু দাউদ ও হাকেম সূত্রে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, كُنتُ أَكتُبُ كُلَّ شَيءٍ أَسمَعُهُ مِن رَسُولِ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ
এর থেকে বুঝা যায়, الصحيفة الصادقة এর হাদীস সংখ্যা ৫৩৭৪ থেকেও বেশি। মোট কথা الصحيفة الصادقة ছিলো তৎকালীন যুগে হাদীসের একটি বিরাট সংকলন এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এটাকে অত্যন্ত হেফাজতে রাখতেন। তাঁর ওফাতের পর এই সহীফা হস্তান্তর হয় তাঁর পুত্র হযরত আমর ইবনে শুআ‘ইব রহ. এর নিকট। যিনি অধিকাংশ সময় عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেন। বরং হাফেজ ইবনে হাজার রহ. تهذيب التهذيب কিতাবে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন ও আলি ইবনুল মাদীনী রহ. এর বক্তব্য বর্ণনা করেছেন। যে হাদীস عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده সূত্রে এসেছে, সেটাকে الصحيفة الصادقة এর হাদীস মনে করবে।
২. সহীফায়ে আলী রা.: (صحيفة علِّي رضى الله عنه ) : আবু দাঊদ শরীফে কিতাবুল মানাসিকের باب فى تحريم المدينة অনুচ্ছেদের অধিনে হযরত আলী রা. এর বর্ণিত হয়েছে।
سنن أبي دأود (২ / ২১৬) عَن عَلِيٍّ رَضِيَ الله عَنهُ، قَالَ: مَا كَتَبنَا عَن رَسُولِ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ إِلَّا القُرآنَ وَمَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ
বুখারী শরীফে চার স্থানে, মুসলিম শরীফে দুই স্থানে এবং নাসায়ী ও তিরমিযী শরীফেও এই বিবরণটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত আলী রা. এর সহীফা তাঁর তলোয়ারের খাপে থাকতো। এই রেওয়ায়েতের বিভিন্ন শব্দ দ্বারা বুঝা যায় যে, তাতে রক্তপন, ফিদিয়া, কিসাস এবং জিম্মিদের বিধিবিধান, যাকতের নেসাব এবং মদিনা তাইয়্যিবা হেরেম হওয়ার ব্যাপারে রাসূল সা. এর ইরশাদগুলো অন্তুর্ভুক্ত ছিলো।
৩. কিতাবুস সাদাকা (كتاب الصدقة) যেগুলো রাসূলুল্লাহ সা. স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন এটি সেসব হাদীস এর সমষ্টি। এতে যাকাত, সদকা, উশর ইত্যাদির আহকাম ছিলো। সুনানে আবু দাউদ দ্বারা জানা যায় যে, এ কিতাবটি রাসূল সা. স্বীয় গভর্ণরদের নিকট পাঠানোর জন্য লিখিয়ে ছিলেন; কিন্তু তিনি এগুলো প্রেরণের পূর্বেই ওফাত লাভ করেন। রাসূল সা. এরপর এ কিতাবটি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর নিকট ছিলো, অতঃপর ওমর রা. এর নিকট এসেছে, অতঃপর তাঁর দুই সাহেবজাদা হযরত আব্দুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহ এর কাছে এসেছে। এরপর তাদের নিকট থেকে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. এটিকে কপি করিয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে সালেম ইবনে আব্দুল্লাহর নিকট হস্তান্তর হয়। হযরত সালেম রা. থেকে ইমাম ইবনে শিহাব জুহরী রহ. এটা মুখস্ত করেন ও অন্যদেরকে শুনান।
৪. صحف أنس بن مالك رضى الله عنه : হযরত সাঈদ ইবন বিলাল (রাঃ) বলেন, كنا إذا أكثرنا عن أنس بن مالك فأخرج إلينا محالا عنده فقال هذه سمعتها من النبى صلى الله عليه وسلم فكتبتها وعرضتها .
অর্থ : যখন আমরা হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. এর নিকট বেশি পীড়াপীড়ি করলাম তখন তিনি তার কাছ থেকে একটি কাগজ বের করলেন। অতঃপর বললেন, রাসূল সা. থেকে এগুলো আমি শুনেছি, অতঃপর লেখেছি এবং এগুলো তাঁর সামনে পেশ করেছি। এতে বুঝা যায়, হযরত আনাস রা. এ নিকট হাদীসের কয়েকটি সংকলন ছিলো।
৫. সহিফায়ে আমর ইবনে হাজম রা. (صحيفة عمرو بن حزم رضى الله عنه) : হযরত আমর ইবনে হাজাম রা. কে যখন রাসূল সা. নাজরানের গভর্ণর নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন, তখন তাঁকে একটি সহীফা প্রদান করেছিলেন যা হুজূর সা. এর হাদীস সম্বলিত ছিলো। হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. তা লেখেছিলেন। আবু দাঊদ ইত্যাদিতে তা হতে বাছাইকৃত যেসব অংশ এসেছে সেগুলো দ্বারা বুঝা যায়, তাতে পবিত্রতা, নামায, যাকাত, হজ্জ্ব, ওমরা, জিহাদ, সিরাত, গনিমত ইত্যাদি সংক্রান্ত হাদীস অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
৬. সহীফায়ে ইবনে আব্বাস রা. (صحيفة ابن عباس رضي الله عنه) : হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর আজাদকৃত দাস কুরায়ব ইবনে আবু মুসলিম থেকে এই ইতিহাস তাবাকাতে ইবনে সা‘দে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর কিতাবগুলোর এতো বিশাল ভাণ্ডার লাভ করেছিলেন, যেগুলো একটি উটের ভোজাই ছিলো।
৭. সহীফায়ে ইবনে মাসউদ রা. (صحيفة ابن مسعود رضي الله عنه) : جامع بيان العلم والفضيلة গ্রন্থে আল্লামা ইবনে আব্দুল বার রহ. বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে মাসউ‘দ রা. এর একটি গ্রন্থ বের করে বললেন, আমি শপথ করে বলছি যে, এটি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কতৃক লিখিত ছিলো।
৮. সহীফায়ে জাযেব ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (صحيفة جابر بن عبدالله رضي الله عنه) মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত জাবের রা. হজ্বের বিধিবিধান সম্পর্কে একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। তারিখে কাবীরে ইমাম বুখারী রহ. হযরত মা’মার রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, التاريخ الكبير للبخاري (৭ / ১৮৬( قَالَ رأيت قتادة قَالَ لسَعِيد بن أَبِي عروبة أمسك على المصحف فقرأ البقرة فلم يخط (৬) حرفا فَقَالَ يا أبا النضر لأنا لصحيفة جَابِر أحفظ مني لسورة البقرة
৯. সহীফায়ে সামুরা ইবনে জুনদুব রা. (صحيفة سمرة بن جندب رضي الله عنه) তাহযীবুত তাহযীব কিতাবে হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বর্ণনা করেছেন যে, হযরত সুলাইমান ইবনে সামুরা রা. নিজ পিতা সামুরা ইবনে জুনদুব রহ. হতে একটি বড় কপি বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রহ. বলেন, ان الرسالة التى كتبها سمرة لأولاده يوجدفيها علم كثير অর্থাৎ সামুরা রা. যে পুস্তিকাটি তাঁর সন্তানদের জন্য লেখেছিলেন তাতে প্রচুর বিদ্যা রয়েছে।
১০. সহীফায়ে সা’দ ইবনে উবাদাহ রা. (صحيفة سعد بن عبارة رضي الله عنه) ইমাম ইবনে সা’দ রহ. ত্বাবকাতে ইবনে সা’দ কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ রা. একটি সহিফা বিন্যস্ত করেছিলেন। যাতে তিনি হাদীসগুলো সংকলন করেছিলেন।
১১. সহীফায়ে আবু হুরায়রা রা. (صحيفة ابي هريرة رضي الله عنه) হযরত হাসান ইবনে আমরের এই ঘটনা ইমাম হাকেম রহ. মুস্তাদরাকে এবং আল্লামা ইবনে আব্দুল বার রহ. جامع بيان العلم والفضيلة কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন- আমি হযরত আবু হুরায়রা রা. এর সামনে একটি হাদীস বর্ণনা করেছি। আবু হুরায়রা রা. এ হাদীস সম্পর্কে অবগত নন বলে মত প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, আমি এ হাদীসটি আপনার কাছ থেকে শুনেছি। এর ফলে হযরত আবু হুরায়রা রা. বললেন, যদি এ হাদীসটি আমি বর্ণনা করে থাকি তাহলে তা আমার নিকট লিখিত থাকবে। এরপর তিনি হাদীসের কিছু কিতাব বের করে আনলেন। তালাশ করার পর সেগুলোতে হাদীসটি পেয়ে গেলেন।
বুঝা গেলো, হযরত আবু হুরায়রা রা. এর কাছে তাঁর বর্ণিত সমস্ত হাদীস লিপিবদ্ধ ছিলো। তাইতো তার কাছে ৫৩৬৪ টি হাদীসের লিখিত একটি ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এর উপর প্রশ্ন হয় যে, হযরত আবু হুরায়রা রা. এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, আমি লেখতাম না। এর ব্যাখ্যা কী? জবাব হচ্ছে, সম্ভবত তিনি হুজূর সা. এবং খলীফাদের প্রাথমিক কালে লেখতেন না। কিন্তু শেষ বয়সে মনে করলেন, এই বর্ণনাগুলো আবার ভুলে যাই কিনা, তাই তিনি নিজের বর্ণিত হাদীসগুলো সংকলন করেছেন। অতএব, কোন বৈপরীত্য রইলো না। এ কারণে হযরত আবু হুরায়রা রা. এর দিকে কয়েকটি সহীফার নিসবত করা হয়।
ক. মুসনাদে আবু হুরায়রা রা. (مسند ابى هريرة رضي الله عنه) আল্লামা ইমাম ইবনে সা’দ রহ. ‘তাবাকাতে ইবনে সা’দ’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. এর পিতা আব্দুল আজীজ ইবনে মারওয়ান রহ. মিসরের গভর্নর থকাকালে কাসীর ইবনে মুররা রহ. কে একটি চিঠি লেখেছিলেন যে, আপনার নিকট সাহাবী বর্ণিত যতগুলো হাদীস রয়েছে, আবু হুরায়রা রা. এর হাদীস ছাড় বাকি সব আমার নিকট পাঠিয়ে দিন। আবু হুরায়রা রা. এর হাদীসগুলো আমার নিকট আছে। এতে বুঝা যায়, হযরত আবু হুরায়রা রা. এর হাদীসগুলো তাঁর কাছে লিখিত আকারে মওজুদ ছিলো।
খ. মুয়াল্লাফে বশীর ইবনে নাহীক রহ. (مألَّف بشيربن نهيق رحمه الله تعالى) হযরত বশীর ইবনে নাহীক রহ. হযরত আবু হুরায়রা রা. এর শিষ্য ছিলেন। হযরত ইমাম দারমী রহ. বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আবু হুরায়রা রা. থেকে আমি যা শুনতাম তা লেখে ফেলতাম। পরবর্তীতে আমি এই সংকলনটি হযরত আবু হুরায়রা রা. এর খেদমতে পেশ করলাম ও বললাম, এগুলো সেসব হাদীস যেগুলো আমি আপনার কাছ থেকে শুনেছি। আবু হুরায়রা রা. বললেন, ঠিক আছে।
গ. সহীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান রহ. (صحيفة عبد الملك بن مروان رحمه الله ) পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান হযরত আবু হুরায়রা রা. কে ডেকে তার কিছু হাদীস পরিক্ষামূলকভাবে লেখেছিলেন।
ঘ. সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ রহ. (صحيفة همام بن منبه رحمه الله تعالى ) হযরত হাম্মাম ইবেন মুনাব্বিহ রহ. হযরত আবু হুরায়রা রা. এর প্রসিদ্ধ শিষ্য। তিনি হযরত আবু হুরায়রা রা. এর হাদীসগুলোর এমন একটি সংকলন বিন্যস্ত করেছিলেন, যার নাম হাজী খলীফা রহ. كشف الظنون গ্রন্থে الصحيفة الصحيحة বলে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. স্বীয় মুসনাদে এই সহীফাটি পরিপূর্ণ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম রহ. ও স্বীয় কিতাব মুসলিম শরীফে বহু হাদীস এই সহীফার সূত্রে এনেছেন। এই সহীফার কোন হাদীস উল্লেখ করলে তিনি বলেন, عن همام بن منبه قال هذا ما حدثنا به أبوهريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فذكر أحاديث منه
কয়েক বছর পূর্বে সৌভাগ্যক্রমে এই সহীফার মূল পান্ডুলিপিটি পাওয়া যায়। এর একটি কপি জার্মানের বার্লিনের লাইব্রেরীতে রয়েছে। দ্বিতীয় কপিটি দামেশকের কুতুবখানা মা‘জমায়ে ইলমিতে রয়েছে। সীরাত ও ইতিহাসে সুপ্রসিদ্ধ এ দুটি কপি মিলিয়ে তথ্যবিদ ড. মুহাম্মাদ হামিদুল্লাহ এই সহীফাটি ছেপে দিয়েছেন। এতে ১৩৮টি হাদীস রয়েছে। মুসনাদে আহমদের সাথে যখন এটাকে মেলানো হয়, তখন কোথাও একটি হরফ বা একটি নুকতাতেও পার্থক্য পাওয়া যায়নি।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা।
-এএ