হাফেজ মাওলানা ইউসুফ নূর
ইমাম ও খতিব, কাতার ধর্মমন্ত্রণালয়
ইসলামি বর্ষের সর্বশেষ মাস জিলহজ। পবিত্র মাসটির প্রথম দশক অত্যন্ত বরকতময় ও গুরুত্বপূর্ণ। এ দশকের রজনীগুলো মুসলিম উম্মাহর জন্য নেকি ও পূণ্য অর্জনের শেষ মৌসুম বলা চলে। আল্লাহ প্রদত্ত এ সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা মুসলমানদের দায়িত্ব।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয় আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি (পাপাচারের মাধ্যমে) অবিচার করো না’। (সুরা আত-তাওবাহ: ৩৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনা অনুযায়ী চারটি সম্মানিত মাস হচ্ছে, জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব। ইমাম জাসসাস রহ. বলেন, ‘তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি অবিচার করো না’। কুরআনের এই বাক্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ মাসগুলোর এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার ফলে এতে ইবাদত করা হলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও ইবাদাতের তওফিক ও সাহস লাভ করা যায়। অনুরূপ এ মাসগুলোতে পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে বছরের অন্যান্য মাসগুলোতেও পাপাচার থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। তাই এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থাকা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। (আহকামুল কুরআন)
স্বাগতম মাহে জিলহজ
জিলহজ মাসের প্রথম দশককে ঈমানি আবেগ দিয়ে বরণ করে নেয়া পূণ্যের প্রথম ধাপ। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো-
তওবা: ইবাদতের রজনীগুলোকে তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে হয়। তওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং ইবাদতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তওবা দুনিয়ার উন্নতি ও আখেরাতের মুক্তির চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’। (সুরা আন-নুর: ৩১)
ইবাদতের দৃঢ় সংকল্প: বরকতময় রজনীগুলোতে ইবাদত করার দৃঢ় সংকল্প থাকা চাই। ভালো কথা বলার ও ভালো কাজ করার অদম্য আগ্রহ থাকলেই আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হবে আল্লাহ তার জন্য আমলের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন।
আল্লাহ বলেন- ‘যারা আমার জন্য সাধনা করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করবো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। (সুরা আল-আনকাবুত: ৬৯)
গুনাহ না করা: কল্যাণের এ দিনগুলোতে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া নিজের ওপর চরম অবিচার করার শামিল। গুনাহের কারণে আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসে। তার দয়া ও করুণা বন্ধ হয়ে যায়। পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি ইবাদত ও নেক আমলের অনুরাগ হারিয়ে ফেলে। আপাদমস্তক পাপাচারে নিমজ্জিত থেকে মুক্তির আশা করা বাতুলতা মাত্র। হজরত মুআজ রা. বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘তোমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, গুনাহের কারণে আল্লাহর আজাব নেমে আসে’। (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৭০)
বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দশক
মহিমান্বিত জিলহজের প্রথম দশকের কতিপয় বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরছি-
১. আল্লাহ এ দিনগুলোর শপথ করেছেন। তিনি বলেন- ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রজনীর’। (সুরা আল-ফজর: ১, ২)
অধিকাংশ তাফসিরবিদের মতে, এখানে জিলহজের প্রথম ১০দিনের কথা বলা হয়েছে। ইমাম ইবনু কাসির রহ. বলেন, এটাই বিশুদ্ধতম মত।
২. আল্লাহকে স্মরণ করার রজনীগুলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘যাতে নির্ধারিত দিনগুলোতে তারা আল্লাহকে স্মরণ করে’। (সুরা আল-হজ: ২৮)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনুু উমর রা. সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ তাফসিরবিদের মতে আয়াতে নির্ধারিত দিনগুলো দ্বারা জিলহজের প্রথম ১০ দিন বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনু কাসির)
৩. পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দশক। হজরত জাবির রা. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলো হলো জিলহজের প্রথম দশক’। (ইবনু হিব্বান)
৪. আরাফার দিন: ৯ জিলহজ। আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে আরাফার দিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোনো দিন নেই’। ইবনে হিব্বান।
আরাফার দিন। মহামুক্তির মহান দিবস। মুমিনের কাঙ্খিত দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যেদিনে আরাফার দিন হতে অধিক বান্দাকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি এদিন বান্দার খুব কাছে চলে আসেন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়’? শুধু আরাফার দিনের বৈশিষ্ট্য মর্যাদা ও ফজিলতের ব্যাপারে আলোকপাত করার জন্য স্বতন্ত্র রচনার প্রয়োজন। ওলামায়েকেরাম বলেন, জিলহজের প্রথম দশকের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য আরাফার দিনই যথেষ্ট।
৫. কোরবানির দিন: ১০ জিলহজ। কোরবানির দিন। বছরের সর্বোৎকৃষ্ট দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত দিন হচ্ছে কোরবানির দিন’। (আবু দাউদ ও নাসায়ি)
ফজিলতপূর্ণ দশক:
জিলহজের প্রথম দশকে ইবাদতের মর্যাদা ও সওয়াব অনেক বেশি। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘এমন কোনো দিন নেই যে দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহর কাছে জিলহজের এই ১০ দিনের অপেক্ষা অধিক প্রিয়। সাহাবারা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি এতো প্রিয় নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এর চাইতে অধিক প্রিয় নয়। তবে কোনো ব্যক্তি যদি নিজের সত্ত্বা ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে বেরিয়ে যায় এবং এ দুটির কিছু নিয়ে আর ফিরে আসতে না পারে তবে তার ব্যাপার ভিন্ন। (অর্থাৎ শহিদের মর্যাদা স্বতন্ত্র)। (তিরমিজি শরীফ)
অনন্য মর্যাদা ও অশেষ ফজিলতপূর্ণ জিলহজের প্রথম দশকের কতিপয় আমল-
১. হজ-ওমরা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘তোমরা পরপর হজ ও ওমরা করো। কেননা, হজ ও ওমরা দারিদ্র ও গুনাহ মিটিয়ে দেয়, যেমন হাপরের আগুনে লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর হয়। কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (তিরমিজি: ৭৫৭)
২. নফল রোজা ও নামাজ: জিলহজের ১০দিনে নফল রোজা রাখার অনেক সওয়াব। আল্লাহ তা খুবই পছন্দ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজের ১০ দিনের ইবাদতের চাইতে অধিক প্রিয়। প্রতিটি রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য এবং প্রতিটি রাতের ইবাদত শবেকদরের ইবাদতের সমতুল্য। (তিরমিজি: ৭০৬)
তবে আরাফার দিনের রোজার ফজিলত স্বতন্ত্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি আরাফাতের দিনের রোজার বিনিময়ে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন’। (তিরমিজি: ৬৯৭)
৩. জিকির: কল্যাণের এ দশকে অধিক হারে আল্লাহর জিকির ও তসবিহ পাঠের জন্য হাদিস শরিফে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘জিলহজের ১০ দিনের চাইতে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান দিন নেই। আর এমন কোনো দিন নেই যে দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে এ ১০ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। অতএব, তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পড়ো’। (মুসনাদে আহমদ)
এ দশকে যেকোন সময়ে একাকী ও সমবেতভাবে তাকবীর দেয়া সুন্নত। তবে ৯ জিলহজ্জের ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্জের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীর বলা সুন্নাত।
৫. কোরবানি: সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এছাড়া নফল কোরবানিও করা যায়। কোরবানি প্রভুপ্রেমের নিদর্শন ও তার পানে নিবেদন। এর বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে অশেষ সওয়াব ও বিপুল ক্ষমার আশ্বাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমা রা. কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে ফাতেমা! তুমি তোমার কোরবানির কাছে যাও এবং তা দেখো। কেননা, কোরবানির পশুর রক্তের প্রথম ফোটার বিনিময়ে তোমার অতীত সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বাজ্জার, আততারগিব ওয়াততারহিব: ৬২৪)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘(কোরবানির পশুর) প্রত্যেকটা চুলের বিনিময়ে একটা সওয়াব। প্রত্যেকটা পশমের জন্য একটা সওয়াব। (হাকেম, আততারগিব ওয়াততারহিব: ৬২৩)
এছাড়া পূণ্যময় এ দশকে প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর সন্তোষ ও করুণা অর্জনের উদ্দেশে যার যার সাধ্য মোতাবেক সৎ কাজ বাড়িয়ে দেয়া যায়। যেমন, দান-সদকা, কোরআন তেলাওয়াত, কোরআন শিক্ষা, ইসলামি জ্ঞান ও শিক্ষামূলক কার্যμম, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, দুঃস্থ ও অসহায় লোকদের সেবায় আত্মনিয়োগ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ, দাওয়াত ও জনহিতকর কর্মসূচীর মাধ্যমে কল্যাণময় এ দশক উদযাপন করার সুযোগ রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন।
এমডব্লিউ/