বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কোরান ও বিজ্ঞান: আল্লার সৃষ্টি-প্রশাসনের দু'টি সামঞ্জস্যপূর্ণ হাতিয়ার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী ওয়াদুদ নওয়াজ।। সাম্প্রতিক কালে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও তার তত্ত্বের আলোকে ঐশী-গ্রন্থ হিসাবে আল-কোরানের সত্যতা যাচাইএর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বস্তু-বাদী ও পাশ্চাত্য দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এক শ্রেণীর মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশী লক্ষ্য করা যায়।

এ ছাড়াও কোরান যে বিজ্ঞানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সাংঘর্ষিক নয় তা প্রমান করার উদগ্র আকাঙ্খা থেকে কিছু কিছু বিশ্বাসী মুসলিম বুদ্ধিজীবিও এ পথে পা বাড়িয়েছেন। এ প্রবণতা ঝুঁকি পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। এর ফলে কোরানের মৌলিক ও রূপ-কল্প সম্বলিত আয়াত সমূহের (আয়াতে মুহকামাত ও আয়াতে মুতাশাবিহাত) মধ্যে বিরোধ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশংকা দেখা দিতে পারে।

কোরান বলে, “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা, যিনি তোমার উপর এ কিতাব অবতীর্ন করেছেন।(এ কিতাবে দু’ধরনের আয়াত রয়েছে),এর কিছু হচ্ছে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন আয়াত, সেগুলিই হচ্ছে কিতাবের মৌলিক অংশ,(এছাড়া) বাকী আয়াত গুলি হচ্ছে রূপক। যাদের অন্তরে বিকৃতি রয়েছে (তারা এগুলোকে কেন্দ্র করেই নানা ধরনের) ঝগড়া-বিবাদ (সৃষ্টি করে) এবং আল্লার কিতাবের (অপ-) ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে এসব (রূপক) আয়াত থেকে কিছু অংশের অনুসরন করে,( মূলতঃ)এসব রূপক বিষয়ের ব্যাখ্যা আল্লাহ পাক ব্যতীত আর কেউই জানেনা।”[সূরা আল-ইমরান আয়াত ৭]

কোরান যে বিশ্ব-নিয়ন্তা আল্লাতালার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত গ্রন্থ, এ বিশ্বাস একজন মুসলমানের ইমানের মূল ভিত্তি। একে বিজ্ঞানের আলোকে যাচাই করার কোন সূযোগ নাই।

সে প্রচেষ্টা দুর্বল ইমানের বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যাপারে কোন বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক বা প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির মন্তব্য বা সার্টিফিকেট দেওয়ার কোনোই এখতিয়ার নাই। তার প্রয়োজনও নাই। এ ধরনের প্রবনতা ইসলামের মৌলিক নীতিমালা ও তার দার্শনিক ভিত্তির উপর গড়ে উঠা মুসলিম ঐক্যের জন্যও ক্ষতিকর।

আল-কোরান পদার্থ-বিদ্যা, রসায়ন-বিদ্যার মতো কোন বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ নয়। বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কোরানের আয়াত সমূহের ( যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাতশ) লক্ষ্য প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর বর্ণনা ও প্রাকৃতিক নিয়ম বা পদ্ধতি সমূহের বিশদ বিশ্লেষন দেওয়া নয়।

বরং মানুষের চিন্তা-চেতনাকে বিশ্ব-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করা। প্রফেসর আবদুস সালাম ১৯৮৪ সালের ২৭শে এপ্রিল প্যারিসের UNESCO হাউসে পঠিত –‘ইসলাম এবং বিজ্ঞান-সামঞ্জস্য পূর্ণ না সাংঘর্ষিক’ প্রবন্ধে বলেছেন, “একজন মুসলিম হিসাবে আমি কোরানের আধ্যাত্মিক বার্তা সমূহের উপর বিশ্বাস রাখি। একজন বিজ্ঞানী হিসাবে কোরানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন সমূহ আমার চোখে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়।"

কোরানে বর্ণিত প্রাকৃতিক ঘটনা সম্বলিত এমন একটি আয়াতও নাই যা সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সংগে সংগতি পূর্ণ নয়।
কোরান ঘোষণা করে

ক) নিশ্চয় আমি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি ও দিবা-রাত্রির আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শণ রেখেছি। যারা দাঁড়ানো, বসা বা শায়িত অবস্থায় সর্বক্ষন আল্লাকে স্মরণ করে ও আকাশ ভূমণ্ডল সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করে,তারা বলে ,হে আমার প্রভু! তুমিতো নিরর্থক এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করনি [ সূরা আল- এমরানঃ আয়াত ১৮৯-১৯০]

খ) আসমান-তাকে তিনি সমুন্নত করে রেখেছেন এবং মহাশূন্যে তার ভারসাম্যের জন্য তিনি একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছেন।যাতে করে তোমরা কখনো আল্লা পাকের নির্ধারত এই মানদণ্ডের সীমা অতিক্রম না করো। [সুরা আর- রহমান : আয়াত ৭ – ৯]

গ) অচিরেই আমি আমার কুদরতের নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও তা দেখিয়ে দেবো যতক্ষন পর্যন্ত তাদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ইহাই সত্য;এ কথা কি যথেষ্ট নয়, আপনার প্রভু আপনার সব কিছু সম্পর্কে অবহিত?[সুরা হা-মীম আস্-সাজদাহ: আয়াত-৫৩]

উপরোক্ত আয়াত গুলির মাধ্যমে আল-কোরান বিজ্ঞান সম্পর্কে তার অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছে। মূল লক্ষ্য হলো মানুষের চিন্তা-চেতনাকে বিশ্ব-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্য উদ্ঘাটনে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা।

মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী, ইমাম গাজ্জালী ও আল্লামা ইকবাল সহ বিভিন্ন বিখ্যাত সূফী মুসলিম দার্শনিকদের চিন্তাধারা গভীরভাবে আমাদের আত্মদর্শনে সহায়তা করে এবং বিজ্ঞান ও অতীন্দ্রিয়বাদের ( Mysticism) মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞান ও অতীন্দ্রিয়বাদ হলো একই আয়নার দুটি পিঠ, যা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বস্তু-জগতে প্রতিফলিত স্রষ্টার সীমাহীন গুনাবলী উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রাখে।

বিশ্ব-প্রকৃতির দৃশ্য-অদৃশ্য সকল কিছুর সঙ্গে মানব মনের একাত্মতার অনুভূতিকে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয়বাদকে (Mysticism) অনেক বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি ভাব-বিলাসিতার বহিঃপ্রকাশ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। আসলে তা নয়। অতীন্দ্রিয়বাদ হলো বিজ্ঞানের সম্প্রসারিত রূপ, যা বিশ্ব-জগৎ ও চেতনার ঐক্য অনুধাবনের চাবি-কাঠি।

আলবার্ট আইন্স্টাইন তাঁর “ The Merging of Spirit and Science”নামক গ্রন্থটিতে বলেছেন "মানব মনের সব চেয়ে সুন্দর ও গভীরতম উপলব্ধি তার অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মধ্যেই নিহিত। এটাই সমস্ত বৈজ্ঞানিক সত্যের উৎস।অতীন্দ্রিয় অনুভূতিহীন মন যা সৃষ্টি-জগতের সৌন্দর্য্য ও বিশালত্বে বিস্মিত ও অভিভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখেনা তা মৃতের সমতুল্য। সর্বোচ্চ জ্ঞান ও সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য বস্তুর অস্তিত্ব অনুধাবন ও উপলব্ধির মধ্যেই চূড়ান্ত ধার্মিকতা নিহিত।

কিছু উগ্র নাস্তিক আছেন যাঁদের অসহিষ্ণুতা ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরকেও হার মানায়। উভয়ের অসহিষ্ণুতার উৎস মূল কিন্তু একই-----তারা এমন এক জীব, মহা-বিশ্বের সুর-লহরী যাদের কর্নমূলে প্রবেশ করতে পারেনা। মহা-বিশ্বে বিরাজমান ঐক্যতান আমার মতো সীমিত বুদ্ধির লোকের কাছে প্রকাশিত হলেও কিছু মানুষ তা বুঝতে পারেনা-তারা অন্ধ ভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। কিন্তু আমার সব চেয়ে বেশী রাগ হয় যখন দেখি তারা তাদের মতের সমর্থনে আমার উদ্ধৃতি দেয়।মহা-বিশ্বের অন্তর্নিহিত এই সুরের ঐক্যতান ও ভারসাম্য কি স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমান করার জন্য যথেষ্ঠ নয়?”

বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানুষের অন্তর্দৃষ্টি বৃদ্ধি ক'রে মানুষ ও বিশ্ব-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ঐক্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে। মীজান বা বিশ্ব-জনীন ভারসাম্য সম্পর্কিত কোরানের ধারনাটি আসলে স্রষ্টার সৃষ্টি –প্রশাসন পদ্ধতির কেন্দ্রীয় নীতি মালার অন্তর্ভুক্ত।

মানুষ ও বিশ্ব-প্রকৃতিসহ সমগ্র বস্তু জগতের মধ্যে ক্রিয়াশীল মৌলিক নীতি-মালার তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো এই মীজান। মানব-জীবন ও বস্তু-জগতের অন্তর্নিহিত সত্য ও বাস্তবতাই হলো কোরানের মূল আলোচ্য বিষয় ।সমগ্র বিশ্ব-প্রকৃতি, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া ও ইতিহাসকে কোরান মানুষের জন্য উপদেশ ও স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুণ্যের বাস্তব নিদর্শন হিসাবে চোখের সামনে তুলে ধরেছে। সৃষ্টি-জগতের সামগ্রিক স্বার্থে আল্লার প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সমন্বয় সাধনই হলো আল-কোরানের মূল লক্ষ্য

বিজ্ঞান হলো মানুষকে প্রদত্ত আল্লার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, মেধা ও বুদ্ধি-বৃত্তির ফসল। আদম আ. কে সৃষ্টির পর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য আল্লা যে জ্ঞান তাকে দিয়ে ছিলেন বিজ্ঞান হলো সেই জ্ঞানেরই ধারাবাহিকতা। যে নাম তিনি আদমকে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা হলো তাঁর সীমাহীন করুনা ও গুণাবলী ( সিফাত), যা তিনি সৃষ্টি-জগতের মাধ্যমে প্রতিফলিত করেছেন।

আদমের সমস্ত জ্ঞান আল্লার “সিফাতের” মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাঁর “জাত” সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা চিন্তা করার অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি। আর এটাই হলো আল্লার নির্ধারিত বিজ্ঞানের চুড়ান্ত সীমারেখা। সৃষ্টি-জগতে ক্রিয়াশীল তাঁর সীমাহীন গুনাবলীর স্বরূপ উদ্ঘাটন ও মানব-কল্যানে সেই জ্ঞানকে নিয়োজিত করার দায়িত্ব বিজ্ঞানের। মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ক্রম-বিকাশমান।অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপে এর রূপান্তর ঘটছে। আজকের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আগামীকাল আরো উন্নত তত্ত্ব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।

অনন্ত কাল-প্রবাহের আলোকে মানুষের আবির্ভাব ও তার অস্তিত্ব স্থান ও কালের অতি ক্ষুদ্র এক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। একজন বৈজ্ঞানিক যত প্রতিভাবানই হোন না কেন তাঁর অনেক মানবিক সীমাবদ্ধতা আছে। কালের বিচারে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে মানুষের স্থায়ীত্ব ও অস্তিত্ব-কালও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতার আলোকে বিজ্ঞান যত উন্নতিই করুক না কেন তা কখনও সম্পূর্ণ সৃষ্টি-রহস্য ও আদি-সত্বার (Absolute Truth) স্বরূপ উদ্ঘাটনে সমর্থ হবেনা একথা নির্বিধায় বলা যায়।

বস্তু ও আধ্যাত্মিক জগতের ঐক্য, কোরানিক দর্শণ ও জ্ঞান-তত্বের মূল ভিত্তি।একটি থেকে আর একটিকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ভুল। আল্লার গুণাবলীর সর্বোচচ প্রকাশ ঘটেছে মানুষের মধ্য দিয়ে-তাই মানুষও বৈজ্ঞানিক গবেষণার আওতাভুক্ত।

বিজ্ঞান ইহলৌকিক জীবন, প্রকৃতি ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। মানুষের জীবনের নৈতিক ও পারলৌকিক সমস্ত বিষয় তার আওতা বহির্ভূত। বিশ্ব-জগত সৃষ্টির তাৎপর্য্য উপলক্ষ্যে কোরান ঘোষণা করে, “আমি আকাশ, পৃথিবী ও তার মধ্যস্থিত সকল কিছু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই।এই সমস্ত সৃষ্টির পিছনে একটা সুগভীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা বুঝেনা”।[সূরা আদ-দুখান:আয়াত ৩৮-৩৯]

সম্পূর্ণ বস্তু-কেন্দ্রিক বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে এই তাৎপর্য্য অনুধাবন করা যাবেনা। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানের সংগে আধ্যাত্মিকতা ও অতীন্দ্রিয় বাদের সমন্বয় সাধন। আল-কোরান এই সমন্বয় সাধণের দার্শনিক ভিত্তি ও নৈতিক কাঠামো তৈরী করে দিয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ