সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৫ কার্তিক ১৪৩১ ।। ৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
উপদেষ্টাদের দপ্তর বদল, কে পেলেন কোনটি আলওয়াসি হজ্ব গ্রুপ মিট আপ ১৬ নভেম্বর, যেভাবে করবেন রেজিস্ট্রেশন শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র হত্যা মামলায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার ‘জুলাই গণহত্যার দ্রুত বিচার কার্যকরের দাবিতে সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়নের আহ্বান’ শপথ নিলেন নতুন ৩ উপদেষ্টা খেলাফত মজলিস নিউইয়র্ক শাখার উদ্যোগে দায়িত্বশীল সমাবেশ অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের তালিকা চূড়ান্ত করতে গণবিজ্ঞপ্তি শায়খ আহমাদুল্লাহকে একুশে পদক প্রদানের প্রস্তাব কেন, জানালেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মঞ্চে মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী সড়ক দুর্ঘটনায় ইমামের মৃত্যু

হাদীস অস্বীকারকারীদের মতাদর্শ ও তাদের মতের খন্ডন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আব্দুর রহিম: যেসব মতাদর্শ হাদীস অস্বীকারকারীদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সামনে এসেছে সেগুলো তিন প্রকার।
১. রাসূূলে কারিম সা. এর দায়িত্ব ছিলো শুধু কুরআন পৌঁছানো। আনুগত্য ওয়াজিব শুধু কোরআনের। রাসূল হিসেবে রাসূল সা. এর অনুগত্য না সাহাবায়ে কেরামের উপর ওয়াজিব ছিলো, না আমাদের উপর ওযাজিব। (নাউজুবিল্লাহ) এবং ওহি শুধু মাতলু। ওহিয়ে গায়রে মাতলু বলতে কোন জিনিষ নেই। তাছাড়া কোরআনে কারিম বুঝার জন্য হাদীসের প্রয়োজন নেই।

২. নবী কারিম সা. এর বানীসমূহ সাহাবাদের জন্য হুজ্জত ছিলো। কিন্তু আমাদের জন্য হুজ্জত নয়।
৩. রাসূল সা. এর বাণীসমূহ সমস্ত মানুষের জন্য প্রমাণ। কিন্তু বর্তমান হাদীসগুলো আমাদের নিকট নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছেনি। এজন্য এগুলো মানার দায়িত্ব আমাদের উপর নয়।
হাদীস অস্বীকারকারীরা যে কোন শ্রেণি বা দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক, তাদের প্রতিটি লেখা এই তিনটি মতবাদ থেকে কোন না কোন একটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। আমরা এজন্য তাদের পরস্পর বিরোধী সাংঘর্ষিক মতবাদেগুলোর প্রত্যেকটির উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।

প্রথম মতের খন্ডন: ১. وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ الله إِلَّا وَحيًا أو مِن وَرَاءِ حِجَابٍ أو يُرسِلَ رَسُولًا (সূরা শুরা : আয়াত ৫১) এ আয়াতে রাসূল প্রেরণ ছাড়াও ওহিকে মানুষের সাথে আল্লাহ তায়া‘লার কথা বলার একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, وحي غير متلو।
২. وَمَا جَعَلنَا القِبلَةَ الَّتِي كُنتَ عَلَيهَا إِلَّا لِنَعلَمَ مَن يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَى عَقِبَيهِ (সূরা বাকারা : ১৪৩) এখানে القِبلَةَ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাস। আর তার দিকে রুখ করে নামায আদায় করার হুকুম আল্লাহ তায়া‘লা جَعَلنَا শব্দ দিয়ে নিজের দিকে নিসবত করেছেন। অথচ কুরআনের কোথাও বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায়ের আদেশ উল্লেখ নেই। নিশ্চিত এই আদেশটি وحي غير متلو এর মাধ্যমে দিয়েছিলেন। এবং তাকে নিজের দিকে নিসবত করে একথাই স্পষ্ট করে দিলেন যে, وحي غير متلو এর আদেশও وحي متلو এর ন্যায় মানা জরুরী।
৩. عَلِمَ الله أَنَّكُم كُنتُم تَختَانُونَ أَنفُسَكُم (সূরা বাকারাহ : ১৮৭) এই আয়াতে রমজানের রাত্রিগুলোতে সহবাস করাকে খেয়ানত সাব্যস্ত করা হয়েছে। অতপর তার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই থেকে বুঝা যায় যে কুরআনে কারীম একথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এর পূর্বে সহবাস হারাম ছিলো। অথচ কোরআনের কোথাও এই আদেশ উল্লেখ নেই। নিশ্চিত এই আদেশ وحي غير متلو এর দ্বারা করা হয়েছিলো। এবং তার বিরোধিতা কুরআনের দৃষ্টিতে খিয়ানত।

৪. وَلَقَد نَصَرَكُمُ الله بِبَدرٍ وَأَنتُم أَذِلَّةٌ (সূরা আলে ইমরান : ১২৩) থেকে وَمَا جَعَلَهُ الله إِلَّا بُشرَى لَكُم (সূরা আলে ইমরান : ১২৬) এই আয়াতগুলো উহুদের যুুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘য়ালা বদরের যুদ্ধে ফেরেস্তা অবতরণের কথা পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ কোরআনে কোথাও এই ভবিষ্যতবাণীর কথা উল্লেখ নেই। তাহলে নিশ্চিত বলতে পারি, এই ভবিষ্যতবাণী وحي غير متلو এর দ্বারা করা হয়েছিলো।

৫. وَإِذ يَعِدُكُمُ الله إِحدَى الطَّائِفَتَينِ أَنَّهَا لَكُم (সূরা আনফাল : ৭) এখানেও যেই ওয়াদার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা وحي غير متلو দ্বারা হয়েছে। কারণ, কুরআনে কারীমের কোথাও তা উল্লেখ নেই।
৬. وَإِذ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعضِ أَزوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَت بِهِ وَأَظهَرَهُ الله عَلَيهِ عَرَّفَ بَعضَهُ وَأَعرَضَ عَن بَعضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَت مَن أَنبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ العَلِيمُ الخبِيرُ (সূরা তাহরীম : ৩)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আয়শা রা. ও হযরত হাফসা রা. এর পুরা ঘটনা আল্লাহ তায়ালা হুজূর সা. নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন। অথচ কোরআনে এই ঘটনা কোথাও উল্লেখ নেই। তাই নিশ্চিত এটি وحي غير متلو এর দ্বারা ছিলো।
৭. سَيَقُولُ المُخَلَّفُونَ إِذَا انطَلَقتُم إِلَى مَغَانِمَ لِتَأخُذُوهَا ذَرُونَا نَتَّبِعكُم يُرِيدُونَ أَن يُبَدِّلُوا كَلَامَ الله قُل لَن تَتَّبِعُونَا كَذَلِكُم قَالَ الله مِن قَبلُ (সূরা ফাতাহ : ১৫)
এই আয়াতে উল্লেখ রয়েছে যে, মুনাফিকরা খাইবারের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ভবিষ্যতবাণী আল্লাহ তা‘য়ালা পূর্ব থেকেই করে দিয়েছিলেন। এই ভবিষ্যতবাণীও وحي غير متلو দ্বারা হয়েছিলো, কারণ কুরআনে কারীমের কোথাও এই ভবিষ্যতবাণীর কথা উল্লেখ নেই।

৮. وَيُعَلِّمُهُمُ الكِتَابَ وَالحِكمَةَ (সূরা বাকারাহ : ১২৯) এছাড়াও বর্ণিত আছে। وَأَنزَلنَا إِلَيكَ الذِّكرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيهِم (সূরা নাহাল : ৪৪) এই সব আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, হুজূর সা. এর দায়িত্ব একজন ডাক পিয়োনের ন্যায় শুধু খবর শুনিয়ে দেয়া নয়। বরং কুরআন শিক্ষা দান, কুরআনের অর্থ শিক্ষা দান, কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনও তাঁর দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি হুজূর সা. এর হাদীস প্রমাণ্য না হয়, তবে কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কি করে সম্ভব? কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য কি হুজূর সা. নিজের পক্ষ হতে কোন কথা বলার প্রয়োজন হতো না? জানা কথা যে, তা ব্যতিত শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়। তাহেল হুজূর সা. এর হাদীস প্রমাণ না হলে শিক্ষাদান কি করে সম্ভব?

৯. কুরআনের জায়গায় জায়গায় أطيعواالله এর সাথে সাথে أطيعوا الرسول এর শব্দও উল্লেখ রয়েছে যা, স্পষ্টভাবেই হাদীস প্রমাণ্য হওয়া বুঝায়। এই বিষয়ে হাদীস অস্বীকারকারীরা বলে যে, এই অনুগত্য শরীয়তের প্রমাণ হিসেবে নয়। বরং রাষ্ট্র পধান হিসেবে। অর্থাৎ হুজূর (সা.) এর বাণীসমূহ একজন রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তৎকালীন লোকদের জন্য মানা আবশ্যক ছিলো। হুজূর সা. এর পর যত রাষ্ট্রপ্রধান আসবে সকলেরই অনুসরণ করা আবশ্যক। শুধু হজুর সা. এর অনুসরণই জরুরী বিষয় নয়। এ বক্তব্যের দুটি জবাব দেয়া যায়। ১. রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যের আলোচনা ভিন্নভাবে করা হয়েছে। সুতরাং হুজূর সা. এর অনুসরণকে রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যের উপর সাব্যস্ত করা সঠিক নয়। ২. এখানে أطيعوا الرسول ব্যাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। আর এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, যখন কোন اسم مشترك এর উপর হুকুম লাগানো হয়। তখন তার মাদ্দাহ ঐ হুকুমের ইল্লাত বা কারণ হয়। সুতরাং أطيعوا الرسول বাক্যতেও অনুসরনের علة রিসালাত, রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া নয়।

১০. فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَينَهُم ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِم حَرَجًا مِمَّا قَضَيتَ وَيُسَلِّمُوا تَسلِيمًا (সূরা নিসা : আয়াত : ৬৫) এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, রাসূল সা. এর বাণীগুলোর অনুসরণ শুধু ওয়াজিবই নয়; বরং এর উপর ঈমান নির্ভরশীল।
১১. পূর্ববর্তী নবীগণের বাণী কুরআন মাজীদের কয়েকটি স্থানে বর্ণিত হয়েছে এবং তাদের বাণীগুলোর উপর উম্মতের আমল ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়েছে আর অবাধ্যদের উপর আযাব অবতীর্ণ করা হয়েছে। এটা হাদীসের প্রমাণ হওয়ার জন্য স্পষ্ট দলিল।
১২. পূর্ববর্তী নবীগণের মধ্যে এরূপ অনেকেই ছিলেন যাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়নি। যদি তাদের বাণীগুলোর উপর আমল ওয়াজিব না হয়ে থাকে তবে তাদের কেন প্রেরণ করা হয়েছে?
১৩. হযরত ইবরাহীম আ. এর স্বপ্নের ঘটনা কোরআনে কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে সন্তান কোরবানী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নবীগণের স্বপ্ন ওহি হয়ে থাকে। যেটা وحي غير متلو।

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ