আবদুল্লাহ তামিম।। কওমি মাদরাসা একটি ইতিহাসের নাম। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আটটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে। যে মূলনীতিগুলো ইসলাম ও মানবতার প্রেরণার বাতিঘর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। আলো ছড়াচ্ছে কোটি কোটি জনপদে। মানুষের হৃদয় আত্মায় মিশে আছে যাদের ঈমান আমল ও ফিকহের সুঘ্রাণ।
১৮৬৬ সালের ৩০ মে ভারতের দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে মাত্র একজন উস্তাদ মোল্লা মাহমুদ ও মাত্র একজন ছাত্র মাহমুদুল হাসানকে দিয়ে যে ইলমি বাতিঘরের গোড়াপত্তন করা হয়। কালের আবর্তনে সেই বাতিঘরের লক্ষ লক্ষ শাখা প্রশাখা আজ সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ইলমের নূর ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আসুন জেনে নেই যে মূলনীতিগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো প্রেরণার বাতিঘর কওমি মাদরাসা
উসূলে হাসতেগানা বা আষ্ট মূলনীতি
১। যথাসম্ভব মাদরাসার আসাতিযায়ে কিরাম ও মুলাযেমদের অধিক হারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করবে। অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
২। যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
৩। মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী ভাব যাতে কারো মাঝে সৃষ্টি না হয়- সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে- উপদেষ্টাগণ স্ব-স্ব মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতকে সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করতে পারছেন না; তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
যথাসম্ভব মুক্তমনে পরামর্শ দিতে হবে এবং অগ্র-পশ্চাতে মাদরাসার শৃংখলা রক্ষার বিষয়টিই লক্ষ্যণীয় হতে হবে। স্ব-মত প্রতিষ্ঠার মনোভাব রাখা যাবে না। এজন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী হওয়া চলবে না। পক্ষান্তরে শ্রোতাদের মুক্ত মন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা শ্রবণ করতে হবে। অর্থাৎ এরুপ মনোভাব রাখতে হবে- যদি অন্যের মতামত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয় তাহলে তা নিজের মতের বিপরীত হলেও গ্রহণ করে নেয়া হবে।
আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেয়া অবশ্যই জরুরি হবে। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন যিনি এ সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী।
তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয় তবে কেবল এজন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন? কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।
৪। মাদরাসার সকল মুদাররিসীনকে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন দুনিয়াদার আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ না করুন, যদি কখনো এরুপ অবস্থা দেখা দেয়, তবে মাদরাসার জন্য এটি মোটেই শুভ ও কল্যাণকর হবে না।
৫। পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিত হবেই না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।
৬। এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন- কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরুপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহ অভিমূখী হওয়ার মূল পুঁজি; তা হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে।
তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয়-আমদানি ও গৃহাদী নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা অবলম্বন করার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
৭। সরকার ও আমির উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।
৮। যথাসম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদা দানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদা দাতাগণের নেক নিয়্যাত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়িত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।
-এটি