শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

ইসলামের দৃষ্টিতে 'সিন্ডিকেট' এর বিধান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমীন আল মোহাম্মদ।। বর্তমান সময়ে 'সিন্ডিকেট' কথাটা বা শব্দটা আমাদের মাঝে বহুল পরিচত এবং প্রসিদ্ধ। ছোট থেকে বড় প্রায় সবার মুখেই এখন সিন্ডিকেট শব্দটা উচ্চারিত হয়। কেউ উচ্চারণ করে এ থেকে লাভবান হয়ে আর কেউ এর জাঁতা কলে পিষ্ট হয়ে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য। তাছাড়া পত্র-পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে চোখ বুলাতেই ভেসে উঠে সিন্ডিকেট চক্রের বাজার দখলের কথা।

সিন্ডিকেট চক্র যখন ইসলামী হুকুম অমান্য করে পণ্য বা মালপত্র গুদামজাত করে তখন সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে যায় বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করার জন্য। এর কারণ হল, সরকার প্রতিটা পণ্যের অল্প মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তখন সেই সিন্ডিকেট চক্ররা একজোট হয়ে বেশি লাভের আশায় পণ্যগুলো গুদামজাত করে রাখে।পড়ে যখন বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয় তখন পণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে এতটা আকাশচুম্বী হয়ে যায় যে,ক্রয়মূল্য সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে যায়,ফলে সাধারণ জনগণের ভোগান্তির শেষ থাকে না। এতে সবচে' বেশি ভোগান্তির শিকার হয়; নিম্ন, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক জনগণ।

তারা না পারে চড়া দামে কিনে নিতে না পারে না কিনে থাকতে।অথচ ইসলামে এমনটি করাকে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম বলেছে। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে সে পাপিষ্ট (মুসলিম ও মেশকাত) অপর হাদীসে রাসূল সা. আরও বলেন, "যে ব্যক্তি বেশি মূল্যের আশায় মাল জমা রাখে, সে ব্যক্তি গুনাহগার (মুসলিম ও আবু দাউদ)

গত কিছুমাস আগে পিঁয়াজের দাম খুব বেড়েছিল। ৩০/৪০ টাকা কেজির পিঁয়াজ ১৫০ থেকে ২০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। এমনকি অনেক জায়গায় এই পিঁয়াজের দাম ৩০০ গিয়েও ঠেকেছিল। আমাদের দেশের ঋতুগুলোকে সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১. বর্ষা ২. শুকনো। এই শুকনো মৌসুমেই আমাদের দেশের কৃষকরা নানান ধরনের সবজি উৎপাদন করে বাজার জাত করেন।

কৃষকদের কাছ থেকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সে সমস্ত সবজি নিম্ন দামে খরিদ করে গুদামজাত করে রাখে। পরবর্তীতে অর্থাৎ সব্জির অমৌসুমি বর্ষায় যখন বাজারে মানুষের চাহিদানুযায়ী সে সমস্ত পণ্যের অভাব দেখা দেয় ঠিক তখনই অসাধু ব্যবসায়ীরা চড়া মূল্যে পণ্য বাজারে ছাড়ে।

এ সময় যাতে পণ্যের দাম না বাড়তে পারে, সেজন্য সরকার অতিরিক্ত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চায়। এমনকি সরকারি ভাবে পণ্যের একটা নির্ধারিত মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে সরকারি ভাবে মালের মূল্য নির্ধারণ করারও প্রয়োজন নেই। বরং পণ্যকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত।

হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেল। লোকেরা বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। রাসুল সা. বললেন, মূলত আল্লাহ তায়ালাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সঙ্কীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি যে, তোমাদের কারো যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে। (তিরমিজি : ২৪৫)।

কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে সরকার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেন। পণ্য গুদামজাত করার কারণে জনগণ সঠিক মূল্যে দ্রব্য পায় না। অসাধু ব্যবসায়ীরা সে সমস্ত পণ্যগুলোকে গুদামে রেখে দিয়ে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। যারফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

আর যখনই পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখনই ব্যবসায়ীরা সেই গুদামে মজুদ করে রাখা অতিরিক্ত পণ্য বেশি দামে বাজারে ছাড়ে। আর এই ঘটনাটা হলো এক প্রকারের সিন্ডিকেটের উদাহরণ। তাছাড়া বাজেট ঘোষণার আগে ও পড়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস জিনিসও এরকম সিন্ডিকেট করে রাখে এবং যখন সেটার দাম বৃদ্ধি পায়, তখনই সেটা বাজারে ছাড়ে।

ইসলামে এধরণের ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে পরকালীন শাস্তি। হজরত রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং তার প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন’। (মিশকাত :১৩১৬)।

হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চল্লিশদিন পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, সে তার মাল পরবর্তীতে সদকা করে দিলেও তার গুনাহ ক্ষমার জন্য যথেষ্ট হবে না। অন্যত্র বর্ণিত আছে, আমদানিকারক মুনাফা অর্জন করবে, সে যেন গুদামজাতকারী অভিশপ্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে। (ইবনে মাজাহ) রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘ন্যায্যমূল্যে জিনিস সরবরাহকারী রিজিকপ্রাপ্ত আর মজুদ করে সংকট সৃষ্টিকারী অভিশপ্ত’। (বোখারি : ৩৭১২)।

গুদামজাতকারীদের জন্য দুনিয়াতেও রয়েছে কঠিন রোগ-শোক, বালা-মুসিবত। হযরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা. বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্য গুদামজাত করে রাখবে, আল্লাহ তাকে দারিদ্র্য ও কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করবেন (ইবনে মাজাহ)

যে সব অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষেধ। ১. স্বল্পমূল্য চলাকালীন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে বেশি লাভের আশায় এমনভাবে গুদামজাত করা যে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। ২. কোন দ্রব্য এমন পরিমাণে গুদামজাত করা, যে কারণে ক্রেতা সাধারণত সে পণ্যের চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। ৩. মানুষের খাদ্যদ্রব্য সংকট অবস্থায় যে কোন পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা। ৪. বাজারে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির জন্য গুদামজাত করা। উল্লেখিত অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ।

এখন প্রশ্ন হলো এই সিন্ডিকেটের দ্বারা মূলত লাভবান হয় কে? এর উত্তর নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যাবে এর দ্বারা মূলত উপকৃত হয় পাইকারি, মধ্যস্থতাকারী ও খুচরা ব্যাবসায়ীরা। আর আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের মতো সাধারন জনগণ।

বেশ ক'বছর থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কৃষক তার সোনালী ফসল ধানের দাম ঠিক মতো পাচ্ছে না। অপরদিকে সে সব কৃষকরা-ই যখন চাল কিনতে হাটে-বাজারে যায় তখন চালের দাম শুনে তাদের মাথা চক্কর দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, কেন তারা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া সত্ত্বেও ধান বিক্রি করতে হচ্ছে, আবার চড়া দামে চাল কিনছে? এর উত্তর একজন কৃষকের বক্তব্য দ্বারাই দিচ্ছি– আমরা গরীব মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ক্ষেতে ধান চাষ করি যে, ধান ফলিয়ে তা বিক্রি করে ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে যা লাভ হবে তা দিয়ে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বাকি একবছর বা পরের ধান মৌসুম পর্যন্ত চালিয়ে যাবো।

কিন্তু আমরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাইনা। তারপরও বাধ্য হয়ে বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করি। নয়তো সুদের গ্লানি টানতে টানতেই বাকি জীবন পার করতে হবে'।

আসলে যারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তারা প্রতি বছর ধানের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সিন্ডিকেট করে। সারাদেশে তারা নিজেরা একটা দাম ঠিক করে দেয় যে, সেই দাম থেকে বেশি দামে কেউ কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে না। যার ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে লস হওয়া সত্ত্বেও কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর একারণেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে লোকসানে পড়ছে বারংবার।

এই সিন্ডিকেট যে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে হয় তা কিন্তু নয়,অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। যেমন, গাড়ির টিকিটের বিষয়টাই বলি। টিকিট থাকা সত্ত্বেও টিকিট নেই এরকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জন্যও কিন্তু সিন্ডিকেট করে।

সর্বোপরি জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলতে পণ্য গুদামজাত করা বা বিভিন্ন জিনিসে সিন্ডিকেট করা ইসলামে চরম ঘৃণিত কাজ। কেননা ব্যবসায়িদের স্বার্থের জন্য গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষ কষ্টের মধ্যে পতিত হয়। আল্লাহর কাছে তাদের ফরিয়াদ বয়ে আনতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষসহ নানান কঠিন আজাব।

আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেন, ‘যেসব লোক বিনা দোষে মুমিন পুরুষ ও নারীকে কষ্ট দেয়। তারা অতি বড় একটা মিথ্যা অপবাদ ও সুষ্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় তুলে নেয়।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৮)

তাই সরকার বা প্রশাসনসহ সর্বসাধারণকে এবিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।ইসলামকে বুঝতে হবে এবং তা মানার চেষ্টা করতে হবে।আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুক, আমীন।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাবন্ধিক

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ