শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আ.লীগ নেতাকর্মীর প্রভাবে নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সংবর্ধনা বাতিল আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা

আইনুদ্দীন আল আজাদ: সংগীত ও সংগ্রামের অমর নায়ক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি এইচ এম আবু বকর সিদ্দীক।।

‘আল্লাহ তুমি দয়ার সাগর রাহমানুর রাহীম/তোমার দয়ায় পূর্ণ আমার সারা নিশিদিন’ ও ‘সমাধান চাও যদি জীবনে মরনে/ফিরে যাও খুঁজে নাও চোখ রাখো কুরআনে’ এমন হাজারো অমর সুরের স্রষ্টা, অসংখ্য গানের কারিগর মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ। তার সুর ও সংগীত দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর মানচিত্রের লাখো বিশ্বাসী ও বিপ্লবীর হৃদয়ে বেঁচে থাকলেও আজ তিনি পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই।

মাওলানা আজাদ ছিলেন এদেশে জনপ্রিয় নতুনধারার ইসলামী সংগীতের স্থপতি পুরুষ। দেহে সুন্নাহর লেবাস জড়িয়ে বুকে প্রভুর শ্রেষ্ঠত্বের গান তার চেয়ে সুন্দর করে কেউ গাইতে পারেনি। মাথায় সুদৃশ্য আমামা বেঁধে কন্ঠে বিপ্লবের আজান তার চেয়ে দরাজ গলায় কেউ তুলতে পারেনি। সকল দেশের রানী প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থ বিরোধী দেশি-বিদেশী এজেন্ডার বিরুদ্ধে তার মতো জোরালো সুরে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিন। ঈমান, আখলাক, সংগ্রাম, সংগীত ও কর্মোদ্দীপনায় তার উপমা তিনিই।

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই তরুণ তুর্কী আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন এক দশক আগে। ১৮ জুন ২০১০ ইংরেজি (৫ রজব, ১৪৩১ হি.) শুক্রবার নাটোরের লালপুরে তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জন্ম ও পড়াশোনা: স্ব-প্রতিভ আইনুদ্দীন আল আজাদ ১৯৭৭ সালের ১ মার্চ ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার হাজরাতলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহাম্মদ শমসের আলী ও মাতা নবীরুন নেসা। ৮ ভাই, ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম।

গ্রামের মকতবেই মাওলানা আজাদের পড়ালেখা শুরু হয়। এরপরে গ্রামের এক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে ইসলামি শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহে ১৯৯১ সালে ঝিনাইদহ উত্তর কাষ্টসাগর দাখিল মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সেবছর দাখিল পরীক্ষা দেন। ১৯৯৩ সালে ছারছিনা দারুস সুন্নাহ আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম। ১৯৯৫ সালে ঝিনাইদহ সরকারী কে সি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বাংলা সাহিত্যে অনার্স। ১৯৯৬ সালে মাগুরা সিদ্দিকিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে ফাজিল ও ২০00 সালে ঢাকা সরকারি মাদরাসা-ই আলিয়া থেকে কামিল সম্পন্ন করেন তিনি।

সংগ্রাম ও সংগঠন: ‘বিপ্লব মানে জীবন দেয়া বসে থাকা নয়/সে কোনোদিন আসবে না রে করো যদি ভয়’ এবং ‘তোমরা কেউ কি আছো জীবন দেবে খোদার পথে/জীবনের সব বন্ধন সকল মায়া ভুলে যেতে/তোমরা কেউ কি আছো’ এমন সব বিপ্লবী সংগীতের রচয়িতা মাওলানা আজাদ সংগ্রামের চেতনায় তাড়িত হয়ে মফস্বল ছেড়ে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। মসজিদের শহরে এসে সুরের বিলাল হয়ে তিনি গাইতে থাকেন বিপ্লবের গান। ইতোপূর্বেও তিনি গেয়েছেন, তবে একা। এবার তিনি কোরাস ধরলেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই অগ্রসেনানী ইসলামি সমাজ বিপ্লবের প্রত্যাশায় ১৯৯২ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তিনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্বও পালন করেন। পর্যায়ক্রমে ১৯৯৮-৯৯ সেশনে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন এর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক, ২০০০-২০০১ সেশনে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইশা ছাত্র আন্দোলনের দলীয় সংগীত, ‘আমরা নবীন আমরা তরুণ আমরা নওজোয়ান/ওড়াব এই ধরার বুকে তাওহিদী নিশান’ তাঁরই কলমের সোনালী প্রসব।

ইসলামি সমাজ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় হামলা-মামলা ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। সকল জুলুমের নাগপাশ ভেঙে তিনি গেয়ে উঠেছিলেন, ‘কী হবে বেঁচে থেকে অযথা বিদ্যা শিখে/ যদি না গড়তে পারি শোষণবিহীন সমাজটাকে’

২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের ইসলাম বিরোধিতার প্রতিবাদ করায় ইশা ছাত্র আন্দোলন এর কেন্দ্রীয় কমিটির ১১ জনের মধ্যে তিনিও কারান্তরীণ হয়েছিলেন। কারাগারের অচলায়তন তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, রূদ্ধ কারা প্রকোষ্ঠে বসেই লিখেছিলেন, ‘তোমাদের তরে আমার একটি অনুনয়/বাতিলের প্রাসাদ যেন উঁচু নাহি রয়’।

কর্মজীবন: মাওলানা আজাদ এর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন চরমোনাইর পীর আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম রাহিমাহুল্লাহ। তাঁর সাথে সম্পর্কের ফলে তিনি ইসলামী রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং উদ্যম ও বিশ্বস্ততার কারণে অল্পদিনেই সবার কাছে প্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। দেশব্যাপী অপসংস্কৃতির সয়লাব এবং কিশোর ও তরুণ সমাজের অবক্ষয় রোধে তিনি কাজ শুরু করেন। গান-বাদ্য ও উদোম নৃত্য-গীতের মোকাবেলায় তিনি শুদ্ধ ও নির্মল গজল-সঙ্গীত পরিবেশন করতে শুরু করেন। পাশাপাশি ওয়াজ-নসীহত, বক্তৃতাও করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ইসলামী সংস্কৃতির সেবাকেই তিনি কর্মপেশা রূপে গ্রহণ করেন।

তাঁর সুরে ও কথায় অসংখ্য মানুষ মুগ্ধ হয় এবং দেশে-বিদেশে তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়। হাজারো মানুুষের ভক্তি ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন। তৃণমূল পর্যায়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৮ মে ২০০৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কলরব’। যাতে সারা দেশের প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিবসসহ বিভিন্ন সময় তিনি ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। গজল ও ইসলামী সঙ্গীতের তাঁর মোট ২২টি ক্যাসেট বের হয়েছিল। এছাড়া গ্রাফিক্স ডিজাইন ও প্রচ্ছদ তৈরির সৃষ্টিশীল কাজও তিনি করতেন।

আমল-আখলাক: ‘আমার জীবন আমার মরণ আমার জিন্দেগী/ইয়া এলাহি কবুল করো আমার বন্দেগী’। মাওলানা আজাদের গানে যেভাবে মহান আল্লাহর প্রতি আকুলতা ঝরে পড়ত, তার আমল ও আখালকেও তার প্রতিফলন ঘটেছিল পূর্ণমাত্রায়। হালের আখলাক ও আদর্শ বিবর্জিত কতিপয় শিল্পীদের দিয়ে আইনুদ্দীন আল আজাদকে বুঝতে চাইলে চরম ভুলই হবে।

নামাজের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। সফরে তাঁকে অনেক সময় কাটাতে হত। তা সত্ত্বেও নামাজ যাতে না ছুটে সেদিকে খেয়াল রাখতেন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে নামাজ পড়তে বিলম্ব হবে বলে গাড়ি থামিয়ে নামাজ পড়ে নিতেন।

তিনি ছিলেন সদা হাস্যময়। অপরিচিতকে আপন করে নিতে তাঁর সংকোচ হত না। তাঁর মাঝে পরোপকার ও অপরকে সম্মান করার গুণ ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যের উপকারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। বিশেষত শিশু-কিশোর ও নবীনদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। অজপাড়া গাঁয়ের অনেক ছেলেকে নিজ খরচে ঢাকায় এনে তাদের প্রতিভার পরিচর্যা করেছেন। কেউ সমস্যায় পড়লে স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।

আজকের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী আবু রায়হানসহ নামি দামী অনেককে তত্ত্বাবধানে রেখে তাদের শিল্পী হওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা পালন করেন মাওলানা আজাদ। লেবাস-পোশাক ও বেশ-ভূষায় সব সময়ই সুন্নতের ইত্তেবা করতেন। পাগড়ি, জুব্বা ও শ্মশ্রুশোভিত বদনে তাকে মর্দে মুমিনের মতোই দৃশ্যমান হতো। সঙ্গী ও সহকর্মীদেরও ইত্তেবায়ে সুন্নতের অনুসরণের তাগিদ দিতেন। দীনের খেদমতের প্রেরণা তাঁর মধ্যে জাগ্রত থাকত। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘এ অঙ্গনে আমার দ্বারা যদি দ্বীনের কোনো ক্ষতি হয় কিংবা আমি যদি ইসলামের বিরুদ্ধে চলি তাহলে আল্লাহ যেন এর পূর্বেই আমার কণ্ঠ নষ্ট করে দেন’। তিনি জীবনের সর্বশেষ অ্যালবামেও গেয়েছেন, ‘গান গেয়ে কুড়াতে চাইনি জশ খ্যাতি/জানাতে চাইছি কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি’।

পারিবারিক জীবন : মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. মৃত্যূকালে স্ত্রী হাবীবা আজাদ, গালীব বিন আজাদ ও তোহফা আজাদ রূহী নামে যথাক্রমে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন।

মাওলানা আজাদই ছিলেন তাঁর পরিবারের দীনি ধারায় পড়াশোনা করা একমাত্র ব্যক্তি। ফলে মা-বাবার খেদমতে তিনিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালে তার মা-বাবাই সবচে বেশি শোকাহত হয়েছেন। তার বাবা বলেন, ‘আজাদ থাকতে আমার কোনো চিন্তা ছিল না। এখন তাঁর মতো করে কে আমাদের খোঁজখবর নেবে?’

পারিবারিক পরিমন্ডলেও তিনি ছিলেন সুন্নতের একজন পূর্ণ অনুসারী। তার সহধর্মিনী হাবিবা আজাদ লিখেছেন, ‘আমি তাকে কোনদিন কোন সুন্নত ছেড়ে দিতে দেখিনি। আমি গ্লাসের যে স্থানে মুখ দিয়ে পানি পান করতাম তিনি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বাকি পানিটুকু সেখানে মুখ লাগিয়েই পান করতেন, আর বলতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত আয়েশার সাথে এমন করতেন। আমি রাসূলুল্লাহর এই সুন্নতটা কিভাবে ছাড়ি?’

মূল্যায়ন ও অভিব্যক্তি : ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতী সৈয়দ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) তাঁর অভিব্যক্তিতে বলেছিলেন, ‘মাওলানা আজাদ একজন ত্যাগী কর্মী ছিলেন এবং সারাদেশে বিশেষত ইসলামী সংগীতে যে খিদমত তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।’

দেশের শীর্ষ আলেম মুফতী আবদুস সবুর সাহেব বলেছেন, ‘তাঁর ইন্তেকালে দেশ একটি সম্পদ হারাল।’ এছাড়াও দেশ বিদেশের অসংখ্য গুণগ্রাহী তাকে মূল্যায়ণ করেছেন বিভিন্নভাবে।

মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. আজ বেঁচে নেই। কিন্তু নিজ কর্মে তিনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন যুগযুগ ধরে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো তিনি ফিরে আসবেন না আর কোনোদিন, তবে আকাশের ঐ চাঁদ তারার মতো তিনি আলো দিয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।

আপনার অক্ষয় কীর্তিসমূহ আপনাকে অমর করে রাখবে হাজারো বসন্ত ধরে। আপনি থাকুন লাখো সংগীতমোদী, বিপ্লবী ও স্বপ্নবাজ মানুষের হৃদয়াকাশে জ্বলজ্বলে তারা হয়ে। আপনার সেই সুরের মাঝে সবার হৃদয়ে আজও আছেন, যেমন ছিলেন।

‘বন্ধু, ভুলে যেওনা কখনও/যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো, মনে রেখো/আমিও আছি তখনও...

লেখক: গীতিকার, লেখক ও সংগঠক

ওআই/আব্দুল্লাহ আফফান/মোস্তফা ওয়াদুদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ