।।আলেমা রাবেতা হক।।
'বাদাইউস সানায়ে' গ্ৰন্থের নাম আমরা কমবেশি সকলেই জানি। গোটা ফিকহের অঙ্গনে একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে কিতাবটির। ফতোয়ার জগতে কোন মুফতি তা থেকে বে-নিয়ায হতে পারেন না। সর্বমহলে সমাদৃত ও ‘জামে মানে’ একটি কিতাব। এসব জানা থাকলেও গ্ৰন্থটির পেছনে থাকা চমৎকার কাহিনী আমরা অনেকেই জানি না।
প্রখ্যাত গ্ৰন্থটির মুসান্নিফ হলেন আল্লামা আবু বাকর কাসানি রাহিমাহুল্লাহ; যিনি ফাতিমা সামারকান্দিয়ার রাহিমাহাল্লাহ’র স্বামী। ফাতেমা বিনতে আলাউদ্দিন সামারকান্দি রহ. ছিলেন আলেমা, ফাকীহা, মুহাদ্দিস ও মুফতি। কাসানের জ্ঞানপ্রেয়সী, প্রজ্ঞাবান ও গুণগ্ৰাহীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। সুন্দর হস্তলিপির জন্যও বেশ খ্যাতি ছিল তার। ফিকহ ও হাদিসের ওপর কয়েকটি কিতাবও রচনা করেন।
ফিকহে হানাফির বিশিষ্ট ফকীহ আল্লামা আলাউদ্দিন সামারকান্দির রাহিমাহুল্লাহ’র কোলে তুর্কিস্তানের কাসান শহরে জন্মগ্রহণ করেন ফাকীহা ফাতেমা। শৈশব থেকেই পিতার কাছে ফিকহ শেখেন ও পিতার লেখা ‘তুহফাতুল ফুকাহা’ গ্ৰন্থ একদম ঠোঁটস্থ করে নেন। ফাকাহাত ও ফাতওয়া বিষয় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তার বাবা সমকালীন সেরা মুফতি ছিলেন। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার কাছে হাজারো প্রশ্ন আসতো। মাসায়েলের সমাধান তিনি মেয়েকে দিয়েই লেখাতেন। পরে দেখে নিজে স্বাক্ষর করতেন ও মেয়েরও স্বাক্ষর নিতেন। ফলে তখন বাবা-মেয়ে দুজনের স্বাক্ষরেই সকল ফতওয়া প্রকাশিত হতো। সুবহানাল্লাহ!
স্বাভাবিকভাবেই প্রতিভাবান মেয়ের জন্য বিভিন্ন রাজা বাদশাহর প্রস্তাব বাবার কাছে ভিড় করতে থাকে। কিন্তু অগাধ ইলমের অধিকারী মেয়ের এভাবে বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছেন না বা প্রস্তাবগুলো মনঃপুত হচ্ছে না বাবার।
একদিন তার সাহচর্যধন্য ও একান্ত ঘনিষ্ঠ ছাত্র আল্লামা কাসানি একটি ব্যাখ্যাগ্ৰন্থ শায়খের সামনে পেশ করেন। নাম রাখেন 'বাদাইউস সানায়ে' যাতে তিনি শায়েখের লেখা 'তুহফাতুল ফুকাহা' কিতাবটির সাবলীল ব্যাখা করেন। ছাত্রের এমন কাজে মুগ্ধ হয়ে শায়খ মেয়েকে তার কাছেই বিয়ে দেন এবং কিতাবটি মোহরানা হিসেবে ধার্য করেন।
বিয়ের পর আরো সক্রিয়ভাবে তালিম ও তাদরিসের কাজে আত্মনিয়োগ করেন ফাতিমা সামারকান্দিয়া। ইতিহাসবিদ ইবনে আদীম বলেন, ফাতেমা সামারকান্দি উত্তমভাবে মাজাহিব বয়ান করতে পারতেন। স্বামীর সাথে ফাতওয়া-মাসায়েলের কাজেও নিমগ্ন থাকতেন। মাঝেমধ্যে তার স্বামী বাদাইউস সানায়ে প্রণেতা ফাতওয়া প্রদানে ভুল করে ফেলতেন, তখন প্রিয়তমা কারণ দর্শিয়ে তার ভুল শুধরে দিতেন আর তিনি স্ত্রীর মতকে গ্ৰহণ করে রুজু করতেন। অনেক সময় প্রিয়তমা নিজেই বিভিন্ন মাসালার সিদ্ধান্ত দিতেন। তাই তিনি স্ত্রীকে অনেক ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। এভাবেই একজন ফকীহের সম্পূরক হিসেবে ফাতেমা সামারকান্দিয়া জীবন অতিবাহিত করেন।
৫৮১ হিজরিতে মহীয়সী ফাতেমা মৃত্যুবরণ করেন। তাকে আলেপ্পোর মসজিদে আল খলিলের পাশে দাফন করা হয়। স্বামী আল্লামা কাসানি রাহি. মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি জুমআতে স্ত্রীর সঙ্গলাভে যিয়ারতে যেতেন। অল্পের ব্যবধানে মাত্র ৬ বছরের মাথায় ৫৮৭ হিজরিতে তিনিও মাওলার সান্নিধ্যে চলে যান। মৃত্যুর আগে স্ত্রীর পাশে তাকে সমাধিস্থ করার জন্য ওসিয়ত করে যান।
(সূত্র- আ'লামুন নিসা ফি আলিমিল আরবি ওয়াল ইসলামি, ৪র্থ খণ্ড, পৃ: ৯৪-৯৫)
লেখক- প্রধান শিক্ষিকা, মানারাতুল উলুম মহিলা মাদরাসা, সিলেট।
-কেএল