শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

হাদিস ও ইলমে হাদিসের পরিচয়; কিছু পরিভাষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আব্দুর রহিম: হাদিসের এবারত শুধু পড়ে গেলেই হবে না। হাদিস পড়ার আগে মৌলিক কিছু বিষয়ের জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে হাদিস পড়ে যে ফায়দা পাওয়ার কথা ছিল, তা পরিপূর্ণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। হাদিসের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কিছু বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা।

حديث ও علم الحديث এর পরিচিতি

حديث এর আভিধানিক অর্থ কথা। এর বহুবচন হচ্ছে احاديث। অভিধানের দিক থেকে সব ধরণের কথাকে হাদিস বলে, চাই তা কম হোক বা বেশি হোক। কিন্তু হাদিস বলতে আমরা হুজূর সা. এর কথাকেই বুঝি। কারণ তার কথা সব চাইতে অর্থবহ ও সর্বোত্তম কথা।

أصول الفقه এর ইমামগণের মতে হাদিস বলা হয়,

أقوال رسول الله صلى الله عليه وسلم وأفعاله

এই পরিচিতির মধ্যে হুজূর সা. এর চুপ থাকাও শামিল রয়েছে। তেমনিভাবে হুজূর সা. এর ঐসব কাজও এই পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত যা হুজূর সা. স্বেচ্ছায় করতেন। কিন্তু যেসব হাদিস হুজূর সা. এর দৈহিক আকারের বিবরণ সম্বলিত বা হুজূর সা. এর জন্ম ও মৃত্যুর বর্ণনা সম্বলিত সেসব হাদিস এই পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত নয়। أصول الفقه এর দৃষ্টিকোন থেকে এসব বর্ণনা হাদিসের পরিচিতি হতে বের হয়ে যাওয়াও ক্ষতিকর নয়। কারণ, أصول الفقه এর আলেমগণের উদ্দেশ্য হচ্ছে হাদিস হতে মাসআলা বের করা। এই দৃষ্টিকোন থেকে হাদিস শুধু ঐসব বর্ণনার নাম যা হতে হুকুম বের হয়। যেসব বর্ণনায় হুজূর সা. এর দৈহিক আকার, জন্ম ও মৃত্যুর আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলো হতে যেহেতু হুকুম বের হয় না, তাই এসব বর্ণনা হাদিস হতে বের হয়ে যাওয়া ক্ষতিকর নয়।

এর বিপরিতে মুহাদ্দিসগণের উদ্দেশ্য হাদিস বর্ণনা করা, আহকাম বের করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, তাই তাঁরা হুজূর সা. এর সাথে সম্পর্কিত সকল কথাকেই হাদিস বলেন। তাঁদের নিকট হাদীসের পরিচয় হচ্ছে,

أقوال رسول الله صلى الله عليه وسلم وأفعاله وأحواله

এই পরিচয়ের দিক থেকে হুজূর সা. এর ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সর্ব প্রকারের অবস্থায়ই হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। এই পরিচিতিটাকেই আল্লামা সাখাবী রহ. এভাবে ব্যক্ত করেছেন,

الحديث ضد القديم واصطلاحا : هو أقوال رسول الله صلى الله عليه وسلم وأفعاله سواء كانت تلك الأفعال اختيارية أو غير اختيارية وأحواله سواء كانت اختيارية أو غير اختيارية أو تقاريره وكذالك فعل الصحابي وقولهم و كذالك فعل التابعي وقولهم وتقريرهم

حديث এর অর্থে ব্যবহৃত আরো কিছু শব্দ

حديث এর অর্থে আরো কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন : رواية ـ أثر خبر ـ سنة ـ ইত্যাদি। সহীহ কথা হচ্ছে, এই সব শব্দ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় একই অর্থে ব্যবহৃত। এসবের একটিকে অন্যটির অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে কতিপয় মুহদ্দিস এই পরিভাষাগুলোতে পার্থক্য দেখিয়েছেন। কিন্তু رواية শব্দটির ব্যবহার সকল মুহাদ্দিসের ঐক্যমতে حديث শব্দের আভিধানিক অর্থের উপর হয়ে থাকে। অর্থাৎ যে কোন কথা বা কাজ চাই যে কারোই হউক না কেন তাকে رواية বলা হবে। বাকি চারটি শব্দের ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, حديث শুধু হুজূর সা. এর কথা, কাজ ও অবস্থাকে বলে। কোন কোন মুহাদ্দিস خبر কেও এই অর্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু অনেক মুহাদ্দিসের মতে উভয়ের মাঝে বৈপরিত্বের সম্পর্ক। অর্থাৎ حديث হচ্ছে হুজূর সা. এর কথা, কাজ ও অবস্থার নাম। خبر হচ্ছে হুজূর সা. ব্যতিত অন্য মানুষের কথা, কাজ ও অবস্থার নাম। আবার কোন কোন মুহাদ্দিসের মতে خبر হচ্ছে ব্যাপক আর حديث হচ্ছে খাস। অর্থাৎ حديث শুধু হুজূর সা. এর কথা, কাজ ও অবস্থার নাম। আর خبر হুজূর সা. ও অন্যান্য মানুষের কথা, কাজ ও অবস্থার নাম। তাই উভয়ের মাঝে عموم وخصوص مطلق এর নিসবত।

খোরাসানের ফকীহগণের পরিভাষা হচ্ছে, أن الحديث اسم للمرفوع والأثر اسم للموقوف على الصحابة والتابعين এই ভিত্তিতেই ইমাম মুহাম্মাদ রহ. তাঁর নিজের কিতাবের নাম রেখেছেন “كتاب الآثار”। ইমাম গাজালী রহ. ও নিজের কিতাবে খোরাসানের ফকীহগণে মতকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ইমাম নববী রহ. তাঁর মুসলিম শরীফের শরাহ-তে লেখেছেন, জুমহুর মুহদ্দিসগণের মতে حديث ও أثر এর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। উভয়ের ব্যবহারই مرفوع , مقطوع حديث ও موقوف হাদীসের উপর হয়। আল্লামা আবদুল হাই লৌক্ষ্মুবী রহ. তাঁর “ظفر الأمانى” কিতাবে এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন।

سنة এর বিষয়ে কোন কোন মুহাদ্দিসের মত হচ্ছে এটি শুধু হুজূর সা. ও সাহাবীদের আমলকে বলা হবে। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে এসবের একটির ব্যবহার অন্যটির উপর হয়ে থাকে। এই কারণেই ইমাম ত্বাহাবী রহ. তাঁর কিতাবের নাম দিয়েছেন “شرح معانى الآثار ” অথচ সেখানে অনেক মারফু হাদীসও রয়েছে। এর দ্বার বুঝা যায় এই সব মুহাদ্দিসের নিকট أثر শব্দটি মারফু হাদীসের উপরও ব্যবহার হয়।

এমনিভাবে হাফেজ ইবনে জারীর ত্ববরী রহ. নিজ কিতাবের নাম দিয়েছেন, “تهذيب الأثر” যাতে مرفوع, موقوف ও مقطوع সব ধরণের হাদীস রয়েছে। এমনিভাবে ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম ইবেন মাজাহ, ইমাম বাইহাকী, ইমাম দারামী ও দারা কুতনী রহ.সহ অনেক মুহাদ্দিস তাদের কিতাবের নাম রেখেছেন “ سنن ” দ্বারা। অথচ সেখানে হুজূর সা. এর শত শত قولى হাদীস রয়েছে। মুহাদ্দিসগনের এই কর্ম পদ্ধতি দ্বারা বুঝা যায়, এই সব শব্দ مرادف, একটির উপর অন্যটির ব্যবহার হয়ে থাকে।

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা

ওআই/আব্দুল্লাহ আফফান


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ