বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যোগ্য আলেম হতে মেনে চলো ৫ পরামর্শ: মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।।

যোগ্য আলেম হওয়া না হওয়ার বিষয়টা নির্ভর করে তালিবে ইলমদের ক্লাসিক্যাল গ্রন্থাদির (দরসী কিতাবাদি) পাঠ-পদ্ধতির উপর। যোগ্য আলেম হওয়ার জন্য তালিবে ইলমদের দরসি কিতাবাদি যে নিয়ম-পদ্ধতি মেনে পাঠ করা চাই তা হল-

১. যোগ্য আলেম হতে চাইলে অবশ্যই প্রথমে নাহু ও সরফ শাস্ত্রদ্বয় পূর্ণ আয়ত্ব করে নিতে হবে। এই দুই শাস্ত্র কিতাবাদি বোঝার বুনিয়াদ। সেমতে মীযান-মুনশাইব, ইলমুস সারফ ও নাহবেমীর- এই তিনটি কিতাব (বা এগুলোর সমমানের কিতাব) অবশ্যই পূর্ণ আয়ত্ব করে নিতে হবে। যাদের এই কিতাবগুলোতে দুর্বলতা আছে শুরুতেই সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। উপরের জামাতের কোন ছাত্রের এমন দুর্বলতা থাকলে তার পক্ষে এই কিতাবগুলো ভাল করে বুঝে নেয়া খুব কঠিন নয়। তারা তো একবার এগুলো পড়েছে। এখন একটু মেহনত করে পূর্ণ আয়ত্ব করে নিলেই হয়।

২. দরসি কিতাবাদি যেহেতু ইলমের হাতিয়ার বা উপকরণ, তাই দরসি কিতাবাদি বুঝার ক্ষেত্রে কোনোরূপ অস্পষ্টতা থাকলে চলবে না। কেউ যোগ্য আলেম হতে চাইলে অবশ্যই তাকে এই প্রতীজ্ঞা নিয়ে চলতে হবে যে, সে কোনো সবক (পাঠ) অস্পষ্ট রেখে বা ঝাপসা রেখে সামনে অগ্রসর হবে না। কোন সবক যতক্ষণ পূর্ণ স্পষ্ট না হবে ততক্ষণ তার পেছনে মেহনত চালিয়ে যেতে থাকবে।

ছাত্রদের মনে রাখতে হবে ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে ইনশিরাহ- তথা পরিষ্কারভাবে জানার নাম। অতএব যতক্ষণ কোন বিষয় পরিষ্কারভাবে জানা না হল, অস্পষ্টতা রয়ে গেল, ততক্ষণ সেটা ইলম নয়। বরং এরূপ অস্পষ্টতা এক ধরনের জাহালত বা অজ্ঞতা। আর শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক দিকগুলোতে অজ্ঞতা রেখে  বিজ্ঞতা লাভের আশা করা যায় না।

৩. যোগ্য, গভীর জ্ঞানসম্পন্ন আলেম হওয়ার জন্য মুতালা হওয়া চাই ফিকিরের সাথে।

বাক্যে বাক্যে নয়, শব্দে শব্দে নয়, হরফে হরফে ফিকির করে মুতালা করা চাই। ভাসাভাসা মুতালায় ইলমের
গভীরতা আসে না। গভীরতা আসে ফিকিরের সাথে মুতালার মাধ্যমে। আর কেউ গভীর জ্ঞান সম্পন্ন আলেম না হলে তিনি যোগ্য আলেম হতে পারেন না।

 কীভাবে ফিকিরের সাথে মুতালা করতে হয়?

একটি ইবারত পাঠ করে চিন্তা করতে হয় এই ইবারত দ্বারা মুসান্নিফের কী উদ্দশ্য? এই উদ্দেশ্য বোঝাতে গিয়ে অমুক অমুক শব্দও ব্যবহার করা যেত, ক্রিয়ার সঙ্গে অমুক অমুক সিলাও ব্যবহার করা যেত, তা না করে এই এই শব্দ এই এই সিলা কেন ব্যবহার করেছেন, এর মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে? এই এই হরফে মাআনী কেন ব্যবহার করেছেন, অন্যটাও তো করা যেত, এর মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে?

এভাবে দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করার পর যখন মুসান্নিফের ব্যবহৃত ইবারতের আদ্যোপান্ত রহস্য পূর্ণ উদঘাটিত হবে, তখন পরবর্তী ইবারত ধরতে হবে।

কীভাবে শব্দে শব্দে ও হরফে হরফে ফিকির করে মুতালা করতে হয় হাতে কলমে তার একটা উদাহরণ পেশ
করছি।-

ধরুন আপনি بسم الله الرحمن الرحيم -এর তরজমা শিখতে চান। এখন কোথাও দেখলেন তার তরজমা লেখা
হয়েছে- শুরু করছি পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে। ব্যস কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়া আপনি তরজমাটুকু
মুখস্থ করে নিলেন। তাহলে এভাবে শিখে আপনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে পারবেন না।

আপনি ভেবে দেখুন ঐ তরজমা সঠিক হয়েছে কি না। আর-রহমান;আর-রহীম;- উভয় শব্দেই মুবালাগার অর্থ রয়েছে , আর- রহমান-শব্দে মুবালাগা বেশি রয়েছে। আপনি ভেবে দেখুন তরজমা সেভাবে হয়েছে কি না। দেখা যাবে ঐ তরজমায় পরম করুণাময় শব্দে মুবালাগা ব্যক্ত হয়েছে কিন্তু দয়ালু শব্দে কোন মুবালাগা ব্যক্ত হয়নি। তাহলে তরজমা যথার্থ হয়নি।

যদি তরজমা এভাবে করা হয়- পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে ... তাহলে উভয় শব্দের অর্থে মুবালাগা ব্যক্ত হয় ঠিক কিন্তু একটাতে মুবালাগা বেশি ব্যক্ত হওয়ার যে কথা ছিল তা হয় না। এখন ভেবে-চিন্তে যদি এভাবে তরজমা করা হয়- অত্যন্ত দয়ালু অতি মেহেরবান আল্লাহর নামে... তাহলে উভয় স্থানে মুবালাগাও হয় আবার একটিতে মুবালাগা বেশিও হয়। অতি-এর চেয়ে অত্যন্ত-এর মধ্যে মুবালাগা বেশি।

কেননা অত্যন্ত শব্দটি গঠিত হয়েছে অতি ও অন্ত যোগো (অতি+অন্ত=অত্যন্ত)। আর অতি ও অন্ত- উভয় শব্দেই মুবালাগা রয়েছে। এ গেল শব্দে শব্দে চিন্তা করে বুঝা।

এবার হরফে হরফে চিন্তা করুন। بسم الله (বিসমিল্লাহ) শব্দের বা (ب) বর্ণটি কী অর্থে?

মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, الباء للاستعانة অর্থাৎ বা বর্ণটি এখানে ইস্তিআনাত তথা সাহায্য কামনা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে "আল্লাহর নামে"-এরূপ তরজমা করলে তো ইস্তিআনাত-এর অর্থ আদায় হয় না, বরং তা হয় মুসাহাবাত-এর অর্থ।

অনেক সময় 'নামে' কথাটি 'উদ্দেশ্যে' অর্থও জ্ঞাপন করে। যেমন বলা হয় পিতা মাতার নামে দান করো, অমুকের নামে সদকা করো। তাহলে "আল্লাহর নামে"-এরূপ তরজমা করলে 'নামে' শব্দটি কী অর্থ জ্ঞাপন করল তা-ই তো অস্পষ্ট হয়ে গেল।

এবার চিন্তা করে যদি এরূপ তরজমা করা হয়- "আল্লাহর নামের সাহায্য কামনা করে", তাহলে ইস্তিআনাত-এর অর্থ যথার্থই আদায় হবে। এভাবে পূরো بسم الله الرحمن الرحيم -এর তরজমা দাঁড়াবে- (শুরু করছি) অত্যন্ত দয়ালু অতি মেহেরবান আল্লাহর নামের সাহায্য কামনা করে। এরূপ শব্দে শব্দে ও হরফে হরফে চিন্তা করতে পারলে জ্ঞানের গভীরতা আসবে। এভাবে চিন্তা করে মুতালাআ করতে গেলে শুরুর দিকে মুতালাআর গতি খুব মন্থর হয়ে যাবে সত্য, তবে ধীরে ধীরে গতি বৃদ্ধি পাবে। শুরুর দিকে প্রতিদিন কোন একটা কিতাবে একটু একটু করে এভাবে অনুশীলন চালানো, তারপর ধীরে ধীরে অনুশীলনের পরিমাণ ও পরিধি বাড়ানো।

৪. মুহাক্কিক আলেম হতে চাইলে প্রত্যেকটা বিষয় দলীল সহকারে বুঝতে হবে। যিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কুরআন হাদিসের বিষয়াদি জানেন বোঝেন তিনি হলেন আলেম। আর প্রত্যকটা বিষয় দলীলাদি সহকারে জানলে তিনি মুহাক্কিক আলেম। আর সেই দলীলাদি সম্বন্ধেও বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে পারলে তিনি মুহাক্কিক মুদাক্কিক আলেম।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা স্পষ্ট করছি। "কুরআন-হাদিসের ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয"- এ কথাটুকু জানা হচ্ছে ইলম, যিনি জানেন তিনি এতটুকুর আলেম। এর সঙ্গে এ বিষয়ের দলীল যদি জানেন যে, এর দলীল হল ইবনে মাজায় বর্ণিত হাদীছ طلب العلم فريضة على كل مسلم. , তাহলে তিনি এতটুকুর ক্ষেত্রে মুহাক্কিক। এরপর এই দলীল সম্বন্ধে তথা এই হাদিস সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত জানেন যে, হাদিসটি জয়ীফ হলেও تعدد طرق তথা বহু সনদ থাকার কারণে হাসান দরজার, তাই এটি গ্রহণযোগ্য এবং আরও জানেন যে, এ হাদীছের مسلم শব্দটি পুরুষবাচক (যার অর্থ মুসলমান পুরুষ) হলেও এর হুকুমে মুসলমান নারীগণও অন্তর্ভুক্ত। তবে কেউ কেউ যে হাদিসটি এভাবে বলে থাকে- طلب العلم فريضة على كل مسلم ومسلمة -এভাবে কোন গ্রহণযোগ্য সনদে হাদিসটি বর্ণিত হয়নি, তাই সেভাবে বর্ণনা করা সহীহ নয়। এভাবে জানলে তিনি এ ব্যাপারে মুদাক্কিক হবেন।

ঠিক তেমনি কোন ছাত্র যদি এভাবে প্রত্যেকটা বিষয় দলীলসহ এবং সেই দলীল সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞানসহ অগ্রসর হতে থাকে তাহলেই সে হতে পারবে মুহাক্কিক মুদাক্কিক আলেম।

৫. বিজ্ঞ আলেম হতে চাইলে প্রতিটি বুনিয়াদী শাস্ত্রের একটি করে কিতাব মুখস্থ করা বিশেষ উপকারী। ইবারত মুখস্থ না হলেও অন্তত বিষয়গুলো অবশ্যই পূর্ণ আত্মস্থ করে নিতে হবে। সেমতে পূর্বে উল্লেখিত নাহু, সরফসহ বালাগাত, উসূলে ফেকাহ, উসূলে তাফসীর ও উসূলে হাদীস- অন্তত এই কয়টি শাস্ত্রের একটি করে কিতাব মুখস্থ/আত্মস্থ করা চাই। এ পর্যায়ে যে কিতাবগুলো নির্বাচন করতে হবে সেগুলো হওয়া চাই বিশুদ্ধ ও ব্যাপক মর্মবিশিষ্ট অথচ সংক্ষিপ্ত। এ ব্যাপারে যোগ্য আলেম থেকে মাশওয়ারা গ্রহণ করে নেয়া মুনাসেব।

-এনটি/কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ