নুরুদ্দীন তাসলিম।।
করোনা মহামারীর কারণে কওমি মাদরাসাসহ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। মাদ্রাসাগুলোতে বন্ধ রয়েছে রমজান, কুরবানী ভিত্তিক কালেকশন ও আর্থিক আয়ের উৎস গুলো। এই পরিস্থিতিতে পুরোনো শিক্ষকদের বেতনভাতা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে। তাই বেশিরভাগ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না নতুন শিক্ষক। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও দাওরা ও তাখাসসুস সমাপ্ত করে বের হচ্ছেন তরুণ শিক্ষার্থীরা। ঘরে ফিরছেন নতুন আশা, স্বপ্ন ও প্রত্যয় নিয়ে। সদ্য পড়াশোনা শেষ করা সন্তানকে নিয়ে বাবা-মাও বেশ আশাবাদী, এতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সন্তানকে, অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনে রেখেছেন সন্তানের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে। তবে করোনায় যেন সব আশায় গুড়েবালি। কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা বাড়িতে বসেই সময় কাটাতে হচ্ছে সদ্য ফারেক তরুণ আলেমদের।
এমনই একজন স্বপ্নবাজ তরুণ আলেম আরাফাত হোসাইন (ছদ্মনাম)। রাজধানীর স্বনামধন্য একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে আদব ও ইফতা মিলে আরো দু'বছর পড়েছেন ঢাকারই আরো দু’মাদরাসায়। দীর্ঘ একযুগ সময় নিয়ে পড়াশোনা শেষে মাদ্রাসায় খেদমত নেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার কথা জানালেন তিনি।
তিনি বলছেন, ‘এখন পর্যন্ত তিন জায়গায় কথা হয়েছে চাকরির ব্যাপারে, এক জায়গায় যুক্ত হওয়ার আগ মুহূর্তে তারা না করে দিয়ে বললেন এই মুহূর্তে নতুন করে আমাদের জন্য শিক্ষক নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আরেক জায়গায় খেদমত ঠিক হলেও সেখানে দরসে এতো বেশি কিতাব দেওয়া হচ্ছে যা আসলে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে এক বিব্রতকর অবস্থা’।
তার ভাষায়, ‘দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত বাবা-মা পড়াশোনাসহ সব ধরণের খরচ বহন করে এসেছেন । সবশেষে বর্তমান সময়টা বাবা-মাকে সাহায্য করার; কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার করার থাকছে না।
তার মতে, ‘মাদরাসা পড়ুয়ারা চাইলেও সহজেই মাদরাসা-মসজিদের বাইরে কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে পারে না। তা ছাড়া বর্তমান যে পরিস্থিতি এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) বন্ধ থাকছে লাগাতার দীর্ঘদিন, আবার বিভিন্ন কারণে মাদরাসা কর্তৃপক্ষও নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন না, মসজিদেও নিয়োগ পাচ্ছেন না তরুণরা। তাই দায়িত্বশীলদের জন্য মসজিদ-মাদরাসা ছাড়াও ভিন্ন কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থানের বিস্তৃতির ব্যাপারে ভাবাটা অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িছে।’
আরাফাত হোসাইনের (ছদ্মনাম) মত আরেক তরুণ আলেম মহিউদ্দিন জুলফিকার। চট্টগ্রামের স্বনামধন্য একটি দীনি বিদ্যাপীঠে দাওরা এবং পরবর্তী তাখাসসুসগুলো সমাপ্ত করেছেন তিনি । তার খেদমতের বয়সও প্রায় আড়াই বছর।
তিনি বলছেন, ‘খেদমতের প্রথম বছরটি মোটামুটি ভালো কেটেছিল, এরপরে করোনার থাবায় বন্ধ হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাঝখানে শুধু কওমি মাদরাসাগুলো খুললেও দ্বিতীয় দফার লকডাউনে আবারো ‘অনির্দিষ্টকালে’র জন্য বন্ধ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের মাদরাসাগুলো।
তার ভাষায়, বিভিন্ন পরিস্থিতি-পারিপার্শ্বিকতা মিলিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সময় বাকি থাকে মাসিক বেতন, এর মধ্যেই আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো, এতে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছে পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে’।
তিনি আরো যুক্ত করেন, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, সময়মতো নামাজ আদায়, বাড়ির টুকটাক কাজ, আর শুয়ে বসেই কাটছে সময়গুলো। সাধারণ মানুষ সহজেই যেসব কাজ করতে পারেন আলেম পরিচয়ের কারণে আমাদের পক্ষে আদৌ তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য মসজিদ মাদরাসার পাশাপাশি বিকল্প ভিন্ন কর্মসংস্থান নিয়ে দায়িত্বশীলদের ভাবা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এই তরুণ আলেমের ভাষায়, ‘মসজিদ মাদরাসার পাশাপাশি এবং মসজিদ-মাদরাসা ছাড়া কওমি শিক্ষার্থীদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি নিয়ে যে দাবিগুলো বিগত কয়েক বছর ধরে উঠছিল, করোনার কঠিন বাস্তবতা তার প্রয়োজনীয়তা যেন আবার জোরালোভাবে প্রমাণ করলো আমাদের সামনে’।
ফয়সাল আহমেদ নামে তরুণ আরেক আলেমও জানালেন তার কষ্টের কথা, তিনি বলছেন, পড়াশুনা শেষে সব বাবা মায়েরই আশা থাকে সন্তান এখন সংসারের হাল ধরবে, বাবার বোঝা কিছুটা হালকা করবে। এদিকে আমাদের কর্মসংস্থান অনেকটা মসজিদ-মাদ্রাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তার মাঝে আবার করোনার থাবায় বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থানগুলো আরো সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
‘পরিস্থিতি বিবেচনায় বিকল্প কিছু করতে চাইলেও হঠাৎ করেই তো আর কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ঘরে বসে বসে অনেকটাই বিরক্ত তরুণ আলেম ফয়সাল আহমেদ।
নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বললেন, প্রায় প্রতিদিনই পাড়ার অনেকেই জিজ্ঞেস করেন- কী করছো, কোথায় কী করবে? কিন্তু পরিস্থিতির কারণে ঠিকমতো কোন উত্তরও দেওয়া যাচ্ছে না। বেশ বিব্রতকর অবস্থা’।
মাওলানা মহিউদ্দিন জুলফিকারের মতো তিনিও বলছেন ভিন্ন কর্মসংস্থানের প্রাসঙ্গিকতা আবারো ঘুরেফিরে আসছে এবং তা নিয়ে দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় ভাবনাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এমন আরও দুইজন তরুণ আলেম কথা বলেছেন প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠিানের ওপর ভরসা না করে ভিন্ন কর্মসংস্থান খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
মৎস্য অধিদপ্তরে ট্রেনিং নিয়েছেন বলে জানালেন তাদের একজন। অন্যজন খুঁজছেন ভিন্ন কিছু। তবে এখনো নির্দিষ্ট কিছু ঠিক করতে পারেননি। ভিন্ন কর্মসংস্থান খোঁজার ক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলোতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ না নেওয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটির বিষয়টিকে বড় করে দেখছেন তারা।
এদিকে, আগে থেকে খেদমত করছেন বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অর্থনৈতিক নানামুখী এই সংকটের কারণে কোন কোন মাদরাসায় পুরোনো এবং আগে থেকেই যেসব শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন, নতুন শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের কিতাব, এতে মানসিকভাবেও চাপ বাড়ছে-বলে জানাচ্ছেন তারা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং মাদরাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার এ ধারাবাহিকতা দীর্ঘ হলে অনেকেই হয়তোবা ভিন্ন কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে শুরু করবেন নিজের মত করে। কেউ বেছে নেবেন ব্যবসার পথ, কেউ বা অন্য কিছু। এতে করে ইলমে দ্বীনের রাহবার ও আদর্শ শিক্ষকদের হারাতে হবে হয়তোবা দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাই এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বশীলদের এখন থেকেই প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা-উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
-কেএল/এএ