শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

বদর যুদ্ধ: ইসলামের সোনালী ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।এইচ এম আবু বকর সিদ্দীক।।

১৭ রমাদান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্য ও শৌর্য বীর্যের ইতিহাস। এই দিবসটি ইসলামের অতীত বৃত্তান্তে চির স্বরণীয়।

ইসলামী ইতিহাসে বদর যুদ্ধের চেয়েও ঘোরতর অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর বিজয়গাঁথাও রয়েছে অসংখ্য। বদর যুদ্ধ সে তুলনায় ছোট যুদ্ধ হলেও তাৎপর্যের বিচারে এটি উল্লেখযোগ্য। কারণ, ইসলামের ইতিহাসে বদর প্রান্তরের যুদ্ধই প্রথম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের জয় পরাজয়ের উপরেই ছিলো ইসলামের ভবিষ্যত নির্ভরশীল।

বদর যুদ্ধের পটভূমি:

ইসলাম প্রচার শুরু করার পর মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোরতর বিরোধীতার সম্মুখীন হন। সাহাবাদেরদের ওপর নির্যাতনের কারণে নবীজির নির্দেশে তারা মদিনায় হিজরত করেন। বিশ্বনবী নিজেও এক পর্যায়ে মদিনায় হিজরত করেন।

মদিনায় আসার পর মহানবী তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমত, মদিনার গোত্রগুলির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করা হয়; দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়; তৃতীয়ত, মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো হয়। এরপরই সিরিয়ার পথে যাতায়াত করা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলির ওপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

হিজরতের প্রথম বছরই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া অভিমুখী মক্কার একটি বড় বাণিজ্যিক কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এই কাফেলায় কুরাইশদের অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিল। মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিল ১৫০ থেকে ২০০জন এবং আরোহণের উট ছিলো ৩০টি।

বিশ্বনবী তাদের নিয়ে যুল উশাইরাহ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমরা পৌঁছানোর কয়েকদিন পূর্বে কুরাইশরা সে পথ অতিক্রম করে চলে যাওয়ার কারণে সাহাবারা তাদের পথরোধ করতে পারেননি। এই অভিযানটি ‘গাজওয়ায়ে উশাইরা’ নামে পরিচিত।

দ্বিতীয় হিজরির রজব মাসে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের (রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু) নেতৃত্বে বিশ্বনবী ১২ জন মুহাজিরকে আরো একটি অভিযানে পাঠান। বাহিনীর প্রতি দুইজনের আরোহণের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিলো।

ইসলামী বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহশকে (রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু) একটি চিঠি দিয়ে বলেন যাতে দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পর এই চিঠি পড়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক দুইদিনের পথ অতিক্রম করার আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ চিঠি পড়েন।

এতে নির্দেশ দেয়া হয় যে চিঠি পড়ার পর যাতে তারা অগ্রসর হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলায় পৌঁছায়। এরপর কুরাইশ কাফেলার আগমনের অপেক্ষা করে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে যেন মদিনায় অবহিত করা হয়।

চিঠির নির্দেশ পড়ার পর তারা অগ্রসর হন। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ তার বাহিনীকে নিয়ে নাখলা পৌঁছে একটি কুরাইশ কাফেলা দেখতে পান। এই দিনটি ছিলো রজব মাসের শেষ দিন। রজব যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস ছিলো তাই আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে মাস শেষ হওয়ার সময় দিলে কাফেলাটি মক্কার হারাম সীমানায় প্রবেশ করবে ফলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা সম্ভব হবে না।

এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম বাহিনীটি কাফেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে সংঘর্ষ হলে যেসব বন্দী ও গনীমত মর্জি হয় নবীজি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তখন মহান আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাযিল করেন। আয়াতে বলা হয়, পবিত্র মাস লঙ্ঘন করার চেয়ে মক্কার লোকেদের অত্যাচার আরো বেশি নিকৃষ্ট। এরপর বিশ্বনবী কাফেলা ও বন্দীদেরকে গ্রহণ করেন।

ইতিপূর্বে গাজওয়ায়ে উশাইরা থেকে বেঁচে যাওয়া কুরাইশ কাফেলাটি সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার সময় বিশ্বনবী তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও সাইদ ইবনে যায়েদকে উত্তরে প্রেরণ করেণ। তারা হাওরা নামক স্থানে পৌঁছে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকেন এবং কাফেলা এই স্থান অতিক্রমের সময় তারা মদিনায় ফিরে ঘটনা অবহিত করেন।

এই বানিজ্যিক কাফেলার প্রধান ছিলো কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান। কাফেলায় আক্রমণের জন্য বিশ্বনবী সাহাবাদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে পরবর্তীতে বৃহদাকার কুরাইশ বাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা তখনো ছিলো না। তাই তিনি এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক মুসলিম মদিনায় থেকে যায়। ঘোষণার পর বিশ্বনবী বদরের দিকে যাত্রা করেন।

বদর অভিমুখে যাত্রা:

বদর অভিমুখে যাত্রা করার সে দিনটি ছিল দ্বিতীয় হিজরির রমজানুল মোবারকের ১৭ তারিখ। মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিপক্ষে বিশ্বাসী ছোট একটি দলের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াই।

তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে সহস্রাধিক সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জনের প্রায় উপকরণহীন ছোট দলটিকে জয়ী করেন মহান রাব্বুল আলামীন। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযেজিত হয় নতুন একটি অধ্যায়।

উল্লেখ্য, হিজরতের ২য় বছর সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি নিয়ে নাজিল হয় কুরআন মজিদের কয়েকটি আয়াত। সূরা হজের ৩৭ নং আয়াতে বলা হলো, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে, তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো এ জন্য যে, তারা নির্যাতিত হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। তাদেরকে নিজেদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে, তারা বলে আমাদের প্রভু আল্লাহ। এই আয়াত নাযিল হবার পরেই বিশ্বনবী বদর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

যখন মুখোমুখি হলো দুই বাহিনী:

দ্বিতীয় হিজরী সনের ১৭ই রামযান ৬২৪ ঈসায়ী ১১ই মার্চ শুক্রবার ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ছিল মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরের ঘটনা।

বদর প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর মহাসমরবিদ বিশ্বনবী পানির সুবিধা নেওয়ার জন্য বদরের কূপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে গেলেন এবং মধ্যরাতে কূপের কাছে পৌঁছে তাঁবু ফেললেন। সাহাবারা সেখানে হাউস বানালেন এবং বাকি সব জলাশয় বন্ধ করে দিলেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ সেনাবিন্যাস করেন। উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হলো এ সময় রাসুলুল্লাহ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বললেন, ‘হে আল্লাহ, কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহংকারে ঔদ্ধত্য হয়ে তোমার বিরোধিতায় এবং তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ, আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যের বড় বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ, তুমি আজ ওদের ছিন্নভিন্ন করে দাও।’

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে কাতারবন্দি করলেন। কাতার বিন্যাস করার পর তিনি সাহাবীদের বললেন, তাঁর পক্ষ থেকে নির্দেশ না পেয়ে কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। তিনি সাহাবীদের সামনে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনা তুলে ধরলেন এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন।

তিনি বললেন, পৌত্তলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করবে। তীরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে। তারা তোমাদের ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালাবে না।

এরপর নবীজি হজরত আবু বকর সিদ্দীককে (রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু) সঙ্গে নিয়ে তাবুতে চলে গেলেন। তিনি সেখানে দীর্ঘ সিজদায় পড়ে মহান আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তাঁর আত্মনিবেদন এতো বেশি ছিলো যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু) মহানবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এতো মূর্ছিত হবেন না, আজ আমাদেরই বিজয় সুনিশ্চিত ইনশাআল্লাহ’।

যুদ্ধের সূচনা করে আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি। সে ময়দানে বের হওয়ার সময় বলছিলো, আমি আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করছি যে ওদের হাউসের পানি পান করেই ছাড়বো। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউসকে ধ্বংস বা তার জন্য জীবন দেবো।

অন্যদিকে সাহাবিদের মধ্য থেকে হজরত হামজা ইবনে আবদুল মোত্তালেব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এগিয়ে যান এবং আসওয়াদকে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধা দল বেরিয়ে এলো। তারা হলো রাবিয়ার দুই পুত্র ওতবা ও শায়বা এবং ওতবার পুত্র ওয়ালিদ।

তাদের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেলেন হযরত আউফ, মুয়াউয়িজ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম। কুরাইশরা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের পরিচয় কী? তারা বলল, আমরা মদিনার আনসার। কুরাইশরা বলল, তোমরা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা স্ববংশীয় অর্থাৎ কুরাইশদের সঙ্গে লড়াই করতে চাই।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওবায়দা ইবনে হারেস, হামজা ও আলীকে (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা তিনজনই নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। তবে হযরত হারেস রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু ওতবার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবেই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিম বাহিনীর ব্যর্থতা ও হতাশার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুসলমানদের প্রবল আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। যুদ্ধের পরিণাম হয়ে উঠল সুস্পষ্ট। অন্যদিকে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করলেন এবং তাদের সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন।

বদর যুদ্ধে খোদায়ী মদদ:

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদও দিলেন। সূরা আনফালের ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ সাহায্যের কথা তুলে ধরে বলেন, "তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে স্বীয় রবের কাছে, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদ কবুল করলেন যে, আমি তোমাদের সাহায্য করব ধারাবাহিকভাবে আগত ফেরেশতার মাধ্যমে"। অপর এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, "আমি কাফিরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেবো, কাজেই তাদের গর্দানের ওপর আঘাত হান এবং তাদের জোড়ায় জোড়ায় কাট"। (সূরা আনফাল, আয়াত-১২)

এ ছাড়াও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের কাছ থেকেও আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্যের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, বদরের দিন ব্যতীত ফেরেশতারা আর কখনো যুদ্ধ করেননি। তিনি আরো বলেন, বদরের দিন ফেরেশতারা সাদা পাগড়ি পরিহিত ছিল। যুদ্ধের জন্য তাদের অগ্রভাগে প্রেরণ করা হয়েছিল।

আল্লাহর সাহায্য ও মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের কাছে অহংকারী কুরাইশদের নির্লজ্জ পতন হলো। এই যুদ্ধে ৭০ জন কাফের নিহত হয় এবং সমপরিমান বন্দী হয়। যারা নিহত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিলো মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।

একনজরে বদর যুদ্ধ:

কাফের সৈনিক ছিলো ১০০০ হাজার। তন্মধ্যে সশস্ত্র সৈনিক ৬০০ জন, উট ৭০০টি, ঘোড়া ৩০০টি, তাদের নিহত ৭০ জন ও বন্দি ৭০ জন। পক্ষান্তরে মুসলিম সৈনিক ছিলেন ৩১৩ জন। মুসলিম বাহিনীর তলোয়ার মাত্র ৮টি, উট ৭০ টি, ঘোড়া ২টি, তাঁদের শহীদ হয়েছেন ১৪ জন এবং কেউ বন্দী হননি।

তৎকালীন সভ্যতা ও রাজনীতিতে বদর যুদ্ধের প্রভাব:

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই বদর দিবসকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’—সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

এই যুদ্ধই মুসলিমদের ঈমান ও মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। কারণ, এই যুদ্ধে বিজয় ছিলো আল্লাহর পক্ষ হতে সাক্ষাৎ সহযোগিতা। বদর যুদ্ধের অবস্থা তুলে ধরে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন। অথচ তোমরা ছিলে ক্ষীণশক্তি।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১২৩)

ঐতিহাসিকরা ধারনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিলো। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিলো একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়।

শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়।

এই যুদ্ধে বন্দীদের যারা নির্ধারিত মুক্তিপন দিতে ব্যার্থ হবে তাদের সাথে এই চুক্তি করা হয়েছিল যে, তারা প্রত্যেকে মদীনার ১০ জন শিশুকে ভালোভাবে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি মিলবে। তৎকালীন সময়ে ঐতিহাসিক এই উদ্যোগ জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামের ব্যাপক সম্ভাবনা ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা।

বদর দিবসের শিক্ষা:

মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাসের শুরু যে বদর যুদ্ধ দিয়ে হয়েছিলো তা সর্বকালে সকল সত্যান্বেষীকে তাড়িত করবে সত্য, সাহস, আল্লাহ নির্ভরতা ও বস্তুবিমুখীতার প্রতি। জরাজীর্ণ এক ক্ষুদ্র বাহিনী শক্তিপূর্ণ বিরাট বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলো তাওহীদে অগাধ আস্থার কারণেই।

বদরের যুদ্ধবন্দীদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ ইসলামের সুমহান আদর্শ ও উদারতার প্রতীক হয়ে থাকবে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম এতবড় বিজয়ের পর বিশ্বনবী উম্মাতকে উন্মাদনায় না ভাসিয়ে মুসলিম উম্মাহর অক্ষরজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে শিক্ষার যে গুরুত্ব তুলে ধরেছেন বর্তমান প্রাগ্রসরমান পৃথিবীও তা অতিক্রম করতে পারেনি।

আজও যদি কোনো ইসলামী শক্তি পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করতে চায় তাদেরকে অবশ্যই বদরের শিক্ষা ধারণ করে অগ্রসর হতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

লেখক- তরুণ আলেম, ইসলামী আলোচক

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ