শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


নারীদের মসজিদে গমন: কিছু মৌলিক কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইফতিখার জামিল।।

নারীদের মসজিদে যেতে দিতে হবে—এখন ব্যাপকভাবে এমন প্রচারণা চলতে দেখা যায়। এর কিছু দিকের সাথে একমত হলেও কেন এই প্রচারণাকে সমস্যাজনক মনে করি, সেটা এই লেখায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। এই প্রচারণার মূল দাবী হচ্ছে, নবীজির যুগে নারীদের মসজিদে যাবার অনুমতি থাকা সত্ত্বেও এখন কেন তাদেরকে মসজিদে যেতে বাঁধা দেওয়া হয়?

মূল আলাপে যাবার আগে তাদের প্রতি একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া যাক। নবীজির যুগে জিহাদ ও হুদুদের চর্চাও ছিল, তারা এখন সেসবকে কেন চর্চা করেন না? নারীদের মসজিদে গমনের প্রসঙ্গের উপস্থাপনা ও ভাষাগত প্রক্রিয়ায় খেয়াল করবেন, তারা মনে করেন, এখন ধর্মীয় সমাজ নারীদেরকে আটকে রেখেছে। তাদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে মসজিদ থেকে। তাই তারা নারীদেরকে মুক্ত করতে চান—এমন ভাষা ও উপস্থাপনাই আপত্তিজনক।

ক) সুনান ও মাজহাব
নবীজির যুগে নারীদের মসজিদে যাবার অনুমতি ছিল। তবে অনেক হাদিসে বিবৃত হয়েছে, নবীজি বলেছেন নারীদের জন্য ঘরে নামাজ পড়াই উত্তম। চার মাজহাবেই এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তারা সবাই মনে করেন, নারীদের মসজিদে যাওয়া বৈধ, তবে না যাওয়াই উত্তম। এর কারণ কী?

আল্লাহ নারীদেরকে কমনীয়-আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। এতে একদিকে যেমন পারিবারিক জীবনে প্রফুল্লতা-সম্প্রীতি তৈরি হয়, একইভাবে তৈরি হয় মানব সমাজের জন্য বড় রকমের পরীক্ষা। তাই নবীজি বলেছেন, নারীরা পুরুষদের জন্য পরীক্ষা', 'নারীরা থাকবে পর্দায়। 'কেননা নারীরা ( কমনীয়ভাবে) বের হলে শয়তান-কামরিপু তাদেরকে সুশোভিত করে তুলে।' এসব কারণে নারীদের ঘরে/ পর্দায় থাকাই উত্তম।

২) মসজিদে গমন নিয়ে প্রশ্ন
সাহাবাদের যুগেই নারীদের মসজিদে গমন নিয়ে প্রশ্ন উঠা শুরু হয়েছিল। আয়েশা (রাঃ) এর বক্তব্য তো প্রসিদ্ধ। এ ছাড়াও অনেক সালাফের স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। যেহেতু নারীদের মসজিদে গমনে তৈরি হতে পারে বিশৃঙ্খলা, তাই সালাফের অনেকে নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাঁধা দেওয়া শুরু করেন। হানাফি মাজহাবের প্রধান তিন ইমাম অর্থাৎ আবু হানিফা, মুহাম্মদ ও আবু ইউসুফ তিনজন থেকেই স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞামূলক বক্তব্য আছে। অর্থাৎ নারীদের মসজিদে যেতে (শিথিল ও শক্ত) নিষেধাজ্ঞার শুরুটা হয়েছিল সালাফের যুগেই।

জিহাদ ও হুদুদের মতো ইসলামের প্রত্যেকটা বিধান নির্দিষ্ট কিছু শর্তের ভিত্তিতে অনুমোদিত। যখন আলেমরা মনে করেন, বৈধতার শর্ত মানা হচ্ছে না, তখন তারা অনুমোদন স্থগিত করে দেন। আমরা এখন জিহাদ-হুদুদের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখলেও চর্চা করতে পারি না। কেননা চর্চার শর্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক একইভাবে হানাফি মাজহাবের প্রধান তিন ইমামসহ সালাফের অনেক ব্যক্তিত্ব মনে করতেন, নারীদের মসজিদে যাবার অনুমোদন স্থগিত রাখা জরুরী। শুধু এই এক বিধান নয়, অনেক বিধানের ক্ষেত্রেই তাদের এমন সিদ্ধান্ত রয়েছে।

৩) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের মসজিদে গমনকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। ক) সফরে-ঘুরতে-মার্কেটে যাবার প্রেক্ষিতে মসজিদে নামাজ। খ) জুম্মার নামাজ। গ) ওয়াক্তিয়া নামাজ। এর মধ্যে প্রথম অবস্থায় নারীদেরকে মসজিদে যেতে দেওয়া জরুরী। আমাদের মা-বোন-খালারাও এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে যান। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অনেক মসজিদে একে বাঁকা চোখে দেখা হয়, গেটে নোটিশ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয় নারীদের প্রবেশ নিষেধ।

ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ মসজিদে জুম্মার নামাজে নারীদের যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা জনসংখ্যা বেশী হওয়ায় মসজিদে পুরুষদের নামাজেরই জায়গা হয় না। পুরুষদের জন্য জুম্মায় মসজিদে যাওয়া বাধ্যতামূলক। যেখানে পুরুষদের জায়গা নেই, সেখানে নারীদের যাবার সুযোগ নেই। ওয়াক্তিয়া নামাজের ক্ষেত্রে বলা যায়, যেসব এলাকায় নারীদের মসজিদে যাবার অবকাঠামো আছে, পারিবারিক সমর্থন আছে, সেখানে তারা মসজিদে যেতে পারে।

৪) মোটকথা
নারীদের মসজিদে যাবার বিষয়টি ইজতিহাদি বিষয়। হানাফি মাজহাবে এতে কঠোরতা আরোপ করা হয়। যেহেতু আমরা হানাফি মাজহাব মানি, আমাদের সমাজ-মসজিদ সেভাবেই গড়ে উঠেছে, তাই আমরা স্বাভাবিকভাবে নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিরুৎসাহিত করবো, যেমন নিরুৎসাহিত করবো বহুবিবাহেও (যদি মসজিদে নামাজের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট না খুঁজেন, তবে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে কেন খুঁজবেন?)।

তবে আমাদের সমাজে যদি ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে, তবে ধীরে ধীরে নারীদের মসজিদে নামাজের অবকাঠামো গড়ে তুলতেও কোন আপত্তি নেই।

অর্থাৎ এটি যেহেতু ইজতিহাদি বিষয়, তাই জনমত-প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব-জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মসজিদে নারীদের উপযোগী অবকাঠামো গঠনের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। আবার অবকাঠামো নির্মিত না হলে একে ধর্মবিরোধী, নারীবিদ্বেষী বা পুরুষতান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া যাবে না। কেননা এভাবে ইজতিহাদি বিষয়ে ট্যাগ দিতে থাকলে মাজহাব-প্রেক্ষাপট-ধর্মীয় মতামতের কোন গুরুত্ব বাকি থাকবে না। এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া, যখন কোন চরমপন্থী গ্রুপ এসে তাদের নির্বাচিত ধর্মীয় মতামত মানতে বাধ্য করবে, তখন বুঝবেন কেন এমন প্রক্রিয়া বিপদজনক।

ধর্মীয় মতামত অনেক জটিল বিষয়। এখান-ওখান থেকে নিজের খেয়াল-খুশিমত মত জারি করার নাম ধার্মিকতা নয়।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ