শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

নিজের আলিয়া মাদরাসাকে কওমিতে রুপান্তর করেন মাওলানা নুরুল হুদা রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক
লেখক ও মুহাদ্দিস

দীনি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের যে সকল অঞ্চল সুপরিচিত, ঐতিহাসিকভাবে নোয়াখালীর অবস্থান তার শীর্ষে। যুগযুগ ধরে নোয়াখালীর হাফেজ-কারী-মুন্সী-মৌলভী সাহেবরা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন ইসলামের প্রদীপ। শিখিয়েছেন মানুষকে পবিত্র কুরআনের জ্ঞান। তাই নোয়াখালীর নাম শুনলেই বাংলার মানুষের মনে জেগে ওঠে ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ ৷ ভক্তিতে ভরে যায় মন। সমষ্টিগতভাবে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি এ অঞ্চলে এমন কিছু মনিষীর জন্ম হয়েছে যাদের নিয়ে শুধু তাদের অঞ্চল নয়, গর্ব করে গোটা বাংলাদেশ ৷

বক্ষমান আলোচনার আলোচ্য ব্যক্তি হজরত মাওলানা নুরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহ তেমনি একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ৷ এই মহা মনীষীকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার, জানার কিংবা বুঝার খুব একটা সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি ৷ তবে আমার শৈশবকাল থেকেই বাংলাদেশের শীর্ষ ওলামা-মাশায়েখের নামের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম সারিতেই এই নামটির উল্লেখ থাকতে দেখেছি ৷ এমনটা দেখে দেখেই পরিচিত ছিলাম তার নামের সাথে ৷ এছাড়াও আমার আব্বাজান মরহুম শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহর সংগ্রাম ও সাধনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার সুবাদেও এ নামের প্রতি আশৈশব একটি ভালোলাগার অনুভুতি মিশে আছে ৷

ইসলামী আন্দোলন ও সংগ্রামের পথপরিক্রমায় অনেক চড়াই উতরাই আছে ৷ শায়খুল হাদিস রাহিমাহুল্লাহর জীবনও এর ব্যতিক্রম ছিল না ৷ সংগ্রামুখর সেই উত্তাল সময়গুলোতে যারা হজরত শায়খুল হাদিসকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছেন, তার পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং তাকে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন হজরত মাওলানা নুরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহ তাদের অন্যতম ৷

হজরত মাওলানা নূরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহর জীবন পর্যালোচনায় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। বিষয়টি হলো বাংলাদেশের সরকারি তথা আলিয়া মাদরাসার অতীত ও বর্তমানের ফারাক ৷ আলিয়া মাদরাসা যেভাবেই হোক যে কারণেই হোক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত ইসলামের অনেক পন্ডিত মনিষী জন্ম দিয়েছে ৷ তৈরি করেছে অনেক দক্ষ ও যোগ্য আলেমেদীন ৷ বাংলাদেশের খ্যাতিমান শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমের শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড আলিয়া মাদরাসা। যার অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন হজরত মাওলানা নুরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহ।

যদিও তিনি উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে, তদুপরি এ কথা বলা যায় যে, তাঁর বুনিয়াদী শিক্ষা ছিল আলিয়াতেই।তিনি বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গন ও আলেম সমাজের নিকট কতটা সমাদৃত ছিলেন, তার ইলমী যোগ্যতা কতটুকু স্বীকৃত ছিল, তা বলাই বাহুল্য ৷ আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করে ইলমেদীনের তথা কুরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান আহরণ ও ইলম চর্চার মাধ্যমে তিনি নিজেকে উন্নীত করেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়৷ আলিয়া মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলামের মাধ্যমে আল্লামা নুরুল হুদাসহ তার সমকালীন ও পূর্বাপর সময়ে এমন অনেক যোগ্য প্রতিথযশা ও বিদগ্ধ আলেমেদীন তৈরি হয়েছেন, একথা যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই ৷ ঠিক তদ্রুপ আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশই তার মূল ধারা থেকে দূরে সরে এসেছে ৷

এমনকি মাদরাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকেও অনেকটা বিচ্যুত হওয়ার পথে, এটিও অনস্বীকার্য এক বাস্তবতা ৷ আর এ কারণেই মরহুম নুরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহ চৌমুহনী আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করলেও মাদরাসায় যখন তার পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয় এবং তিনি যখন দেখলেন সরকারি মাদরাসাগুলোর পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে, ভবিষ্যতে আরো পরিবর্তন ও বিকৃতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সেই সাথে পাঠ্যসূচির প্রভাবে তা’লীমের সাথে সাথে তারবিয়াতের দিক থেকেও অধঃপতন নেমে আসছে, তখন সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাদরাসাকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শের উপর হেফাজতের লক্ষ্যে কওমীতে রূপান্তরিত করেন, যার দৃষ্টান্ত আজকের সময়ে বিরল।

হজরত নুরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহর এই পদক্ষেপ এবং এই সংস্কারকে কোন ধরনের নেতিবাচক অভিধায় অভিহিত করার সুযোগ নেই ৷ এমনকি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখারও অবকাশ নেই ৷ তিনি নিজে আলিয়া মাদরাসা পড়ুয়া হওয়ায় আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ কিংবা হিংসা তার অন্তরে কখনোই স্থান পাওয়ার কথা নয়।

তবে কেন তিনি নিজ কর্মস্থল ও নিজের প্রিয় মাদরাসাটিকে আলিয়া থেকে কওমিতে রূপান্তর করলেন, এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করলে এছাড়া আর কোনো সদুত্তর মিলবে না যে, তিনি তার দূরদৃষ্টি ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণ চিন্তার আলোকে সুস্পষ্টভাবে এ কথা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে এই জনপদে ইলমে দীন ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ খেদমতের জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারী সিস্টেমের বাইরে গিয়ে খেদমত করতে হবে, যেমনটি কওমি মাদরাসা করছে ৷

আর তাই তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত আলিয়া মাদরাসাকে পর্যায়ক্রমিক ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কওমি মাদরাসায় রূপান্তর ঘটান। তাঁর হাতে এভাবেই গড়ে ওঠে নোয়াখালীর প্রথম দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা চৌমুহনী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা। ইতিহাসের একটি বিবর্তনের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদরাসা ৷ আল্লামা নূরুল হুদা রাহিমাহুল্লাহর স্মৃতির স্মারক আর কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসাবে ইনশাআল্লাহ এভাবেই ইলমে নববীর আলো বিকিরণ করে যাবে এই মাদরাসা যুগ যুগান্তর।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ