শাহাদাত হুসাইন।।
আমরা দুজন গেলাম মাওলানা মনিরুজ্জামান সিরাজি রহ. কাছে। তিনি বিবাড়িয়ার ভাদুঘর মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। তার শৈশব, কৈশোর, ছাত্র জীবন আর দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে জানার জন্যে। আসরের নামাজের পর মসজিদের বাহিরে চেয়ারে বসে আছেন। পাশে এক ভক্ত আর খাদেম। বরাবর সামনে বসলাম আমরা।বিনয়ের সাথে আমাদের উদ্যেশ্যের কথা জানালাম। তাচ্ছিল্যের এক ভাব নিয়ে বললেন, ‘আমাদের আবার জীবন!’
আগেই বেলাল ভাই বলল, "হুজুর কিন্তু জালালি তবিয়তের লোক। অতএব সাবধান! ঐ কথার পর থেকে এমনি তে কলিজা শুকিয়ে গেছে। এখন আবার নির্লিপ্ত ভাব। অতএব, এখান থেকে কোনো ফলাফল আনতে পারবো না ধরেই নিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সব কথা শুকিয়ে একেবারে জীর্ণ প্রায়। আমার মুখের কথা তার কান পর্যন্ত যায় না। সে সাথে পাশের রাস্তায় গাড়ির ছুটে যাওয়ার শব্দ আর হুইসেল।
আমার শরীর একটু একটু কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা একটু ধমক দিলে নির্ঘাত এখন ওক্কা পাবো। বেলাল ভাইকে ইশারা করলাম।বললাম, "ভাই! চলেন। চলে যাই। জীবন বাঁচানো ফরজ। বলল, আমি কথা বলি।
বেলাল ভাই কথা শুরু করলো। কিছুক্ষণ বলার পর আমার দুর্যোগ কাটলো। স্বাভাবিক হলাম। প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার বাবার কথা এখনো মনে আছে?’
এটা কি বড় কোনো প্রশ্ন? কিন্তু বৃদ্ধ লোকটা আমার সামনে কাঁদছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। সবার চোখেই পানি। তিনি চোখের পানি মুছে নিষ্পাপ শিশুর মত আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এগুলো কেন মনে করান! এ বিষয়গুলো না তুললেও তো হয়। এক হাতে লাঠি ভর দিয়ে আরেক হাতে চোখের পানি মুছলেন।আমি একেবারে বাক শূন্য হয়ে গেলাম। এ বৃদ্ধ বয়সে বাবার কথা বলতেই এমন কান্না! কেমন সম্পর্ক ছিলো বাবার সাথে! বিশ মিনিটের মত কথা বললাম। কথা শেষে আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
আমার নাম মনিরুজ্জামান। বাবা মা এ নাম রেখেছে। পরে সিরাজী যোগ করা হয়। ছোট বেলায় অন্যদের মতো ছিলো আমার নানান সখ। মাছ মারার সখ ছিলো। ছিল খেলাধুলার সখ। বোসি খেলাতাম। বাবার সাথে সব সময় চলাফেরা করতাম। জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় বাবার সাথে আসা যাওয়া করতাম।
বাবা যেহেতু শাসন করতো তাই বাবাকে বেশি ভয় পেতাম। আমি কোনো আবদার করলে মা পূরন করতো। যদি তার সামর্থে থাকতো। তার সে সামর্থ না থাকলে বাবা পূরণ করতো। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে বলতাম মাকে। আবার কখনো বলতাম বাবাকে।
পড়ালোখা শুরু হয়েছে বাবার হাতে। অন্যদের মতো নয়। প্রথমে স্কুলে পড়া এর পর একটা সয়ম পর মাদরাসায় আসা। বরং ছোট বেলা থেকে আমার মাদরাসায় পড়া। জামিয়া ইউনুসিয়ায় প্রথম পড়েছি। মক্তবও সেখানে। কিতাব খানায় প্রথম ভর্তি হইনি। বাবার কাছে পড়েছি। জামাতে হাশতুমের আগ পর্যন্ত বাবাই আমাকে পড়িয়েছেন। গুলিস্তা, বোঁস্তা এগুলো বাবার কাছে পড়েছি।
পুরো সময় জামিয়া ইউনুসিয়ায় পড়েছি। মক্তব থেকে দাওরা পর্যন্ত। অন্য কোথাও যাইনি। আমার প্রিয় উস্তাদ ছিলেন আমার বাবা। আমাদের ক্লাসের সবাই ভদ্র এবং ভালো ছিলো। মুফতি নুরুল্লাহ সাহেব আমার সাথি ছিলেন। ক্লাসে সাধারনত আমাদের মতানৈক্য তেমন হতো না। সবাই ভালো। তারপরও কিছু হয়ে গেলে উস্তাদগণ সমাধান করতেন। মোতালায় গুরুত্ব দিলে পরিক্ষার পড়া সহজ হয়। ছাত্ররা মোতালাআ করতো বেশি। এরপর পরিক্ষা আসলে পরিক্ষার জন্য আলাদা মেহনত করতো।
আমার স্ত্রীর সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। বোনের সাথে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে মনোমালিন্য হলে মা সমাধান করতেন। সংসারে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হলে বাবা মা সমাধান করতেন।
আমার বাবা খুব কুরআন শরীফ পড়তেন। ছেলে হিসেবে, ছাত্র হিসেবে যেভাবেই দেখি আমার বাবার এ গুনটা আমার কাছে বেশি ভালো লাগতো। দাঁড়িয়ে, বসে। সব সময় কোরআন পড়তেন।
লেখকের ‘আকর সেতারা’ বই থেকে সংক্ষেপিত
-এটি