শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

স্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক বালাকোট

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এনামুল হাসান।।

ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাটা ছিলো খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। ভারতবর্ষের মুসলমানদের মাথা পুঞ্জিভূত ছিলো ভয় শঙ্কা ও আতঙ্কের কালো মেঘের ছায়ায়।বণিকের বেশে আসা ইংরেজরা প্রবল প্রতাপে একের পরে এক জনপদ দখল করে নিচ্ছে। অবশেষে ১৭৯৮ সালে পথের কাঁটা সুলতান টিপুও বিদায় নিলেন। এদিকে হতভাগা শাসক মোঘলরা হয়ে পড়লো ইংরেজদের করুণারপাত্র। ফলে পুরো ভারতবর্ষ স্থবির, চিন্তিত, শঙ্কিত, কম্পিত, অসীম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়লো।

হতাশার অসীম কুয়াশাঘেরা এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রজনীতেও জেগে ছিলো একটি কাফেলা। এই কাফেলাকেই আমাদের ইতিহাস 'ওয়ালিউল্লাহী সংগ্রামী' দল বলে আখ্যায়িত করেছে। যে কাফেলাকে একদা নেতৃত্ব দিয়েছেন আবু বকর, উমর, উসমান আর আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম! ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই কাফেলার নেতৃত্বে এসেছেন নববী রক্ত ও চেতনার এক চিরসংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৭৮৬ সালে। শাহাদাত বরণ করেন ১৮৩১ সালের ৬ই মে। পয়তাল্লিশ বছরের এই ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর হাতে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের চল্লিশ হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেছিলো ত্রিশ লক্ষ মুসলমান। তাঁর বর্ণিল জীবনী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-র হাতে লিখিত সাত খন্ডের গ্রন্থ 'তারিখে দাওয়াত অ আযীমাত'(সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস)-এর ৭ম খন্ড থেকে। ৬০৭ পৃষ্ঠার পুরোটাই তাঁর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে।

বিজয়ের চেতনাধারী, সত্য-ন্যায়ের পতাকাবাহী হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ. ইংরেজ ভল্লুক ও তাদের দোসর শিখ-সেনাদের বিরুদ্ধে শুরু করলের অঘোষিত আন্দোলন। প্রতিপক্ষ শিবিরে আঘাত হানার পূর্বে শুরু করলেন নিজেদের মাঝে 'আত্মশুদ্ধি' অভিযান। মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া কুসংস্কার, অন্ধ রেওয়াজ,ঘৃণিত বিদআত, ভয়ংকর কুফুরী বিশ্বাস ও কর্মের বিরুদ্ধে শুরু করলেন নয়া-অভিযান।

তার এই যাপিত তাসাউফ ও আত্মসাধনা ক্রমাগত রূপ ধারণ করে রক্তমাখা জিহাদের। ডাক দিয়ে দিলের জিহাদের। তাঁর এই ডাক বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে হিমালয়ের চূড়া ভেদ করে নেপালের সৈকতে পর্যন্ত প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করেছে। ফলে সর্বত্রে বয়ে গেছে জিহাদী কাফেলার তরঙ্গায়িত স্রোত, সকলে শাহাদাতের প্রবল তাড়নায় ছুটে এসেছিলো বালাকোট প্রান্তরে; যা ইতিহাসের এক বিরল অধ্যায়। বস্তুত বস্তুবাদের এই বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন হ্রক্ত হস্ত। তাহলে কী ছিলো তাঁর কাছে? ঈমানী শক্তিই ছিলো তাঁর একমাত্র হাতিয়ার। এই শক্তি নিয়েই জিহাদ করে গেছেন দুর্বার গতিতে। আর এই শক্তি ও নিষ্ঠাই হলো যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর প্রধান হাতিয়ার।

হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.-র এই কাফেলার সংগ্রাম করার মহান লক্ষ ছিলো-ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। তিনি এমন একটি স্বাধীন ভূখন্ড চেয়েছেন-যেখানে সকল মূর্খতার ধর্মের অবসান হয়ে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলাম থাকবে। মহান এই লক্ষ অর্জনের জন্যেই তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেন।

যদিও অতীতে অসংখ্য গাজী ও শহীদের আকস্মিক সংঘাত-সমঝোতা ও শাহাদাতের হাজারো ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক এই বালাকোট ময়দান। তবুও পরবর্তীতে হজরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.-র পরিচয় 'শহীদে বালাকোট' হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছিলো তাঁর বর্ণাঢ্য জিহাদী জীবনের হিরাতুল্য সংক্ষিপ্ত চিত্র।

আজ থেকে বহু বছর পূর্বে সায়্যিদ সাহেবের শাহাদাত বরণ সম্পর্কে দুটি মন্তব্য করা হতো। কারো মতে তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন আবার কারো মতে তিনি অদৃশ্য হয়ে আছেন এবং তিনি এখনো জীবিত আছেন। একটি বিরাট দল তাঁর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পক্ষে মতও প্রকাশ করেছেন। এখন চলুন তাঁর এই অনিশ্চিত শাহাদাতের সুবহে সাদিক কিভাবে হয়েছে জেনে নেই..!

১২৪৬ হিজরির ২৪ জিলক্বদ মোতাবেক ১৮৩১ সালের ৬ই মে। দিনটি ছিলো তাঁর জীবনের শেষ দিন। এই একই তারিখে ইতিহাসের আরেক বরিত ব্যক্তি হযরত ইসমাইল শহীদ রহ. শাহাদাত বরণ করেন। সেদিন ফজরের আজান শেষে হজরত নিজেই ফজরের ইমামত করেন। নামাজ শেষে মুজাহিদীনে ইসলামকে নিজ নিজ স্থানে সতর্ক অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন। তারপর ওজিফা আদায় করে সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত ইশরাক পড়ে তাঁবুতে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর অজু করে চোখে সুরমা লাগিয়ে দাড়িতে চিরুনী করেন। পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে যুদ্ধের হাতিয়ার কাঁধে তুলে নেন। এই ছিলো তাঁর শাহাদাতের শেষ প্রস্তুতি। অদূরে প্রস্তুত শিখ-বাহিনী। লড়াই শুরু হলো। শক্তিশালীর বিরুদ্ধে নগন্য এই মুজাহিদীনে ইসলামের অসম্ভব লড়াই। সমতলে মুজাহীদগন আর পাহাড়ের উপর থেকে নির্দয় শিখদের বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ।

এদিকে মুজাহিদদের ভয়ংকর প্রতিরোধ। তাঁদের এককবদ্ধ হামলায় কচু-পাতার মতো জান দিতে থাকে একের পর এক শিখশৈনিকরা। একপর্যায়ে নরপশু শিখবাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পশ্চাতে পালিয়ে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাকে। হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ে আমীরুল মুমিনীন নিখোঁজ! কোথায়?নেই, কোথাও তাঁকে খুঝে পাওয়া যাচ্ছিলো না? এদিকে তাঁর তালাশে মগ্ন হয়ে পড়ে মুজাহিদীন। বদলে যায় রণচ্চিত্র। পরাজয় বরণ করেন হিজবুল্লাহ তথা আল্লাহর বাহিনী...! এই বালাকোট যুদ্ধে তিন শতাধিক মুজাহিদ শহীদ হন। এদের মধ্যে তালিকাভুক্ত ১২৪ জনের নাম সংকলিত করা হয়।

ইতিহাস যদিও বালাকোটকে পরাজয় ও হেরে যাওয়ার অধ্যায়ে রচনা করেছে, তবে এই বালাকোট অনন্ত জয়ের উৎস! কারণ শামেলির মহাবিপ্লব পলাশীর আম্রকানন আর শায়খুল হিন্দের রেশমি রুমাল, যা-ই বলুন সবই তো বালাকোটেরই প্রতিধ্বনি।অবশেষে আমি বলবো- খুনোখুনির এই ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম উম্মাহর হিমায়িত ধমনিতে যেন জেগে ওঠে বালাকোটের রক্তমাখা সেই ইতিহাস--এই দোয়াই করি

লেখক: জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ