শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

এ বছরের সদকাতুল ফিতরের হার ও উত্তম সদকাতুল ফিতর প্রসঙ্গ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি সাইফুল ইসলাম মাদানী।।
মুহতামিম: বড় কাটারা মাদরাসা ঢাকা।
খতিব: উর্দ্দু রোডস্থ মির্জ্জা মান্না দেউরী জামে মসজিদ।

সাদাকাতুল ফিতর সম্পর্কিত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে সাদাকা বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়।
যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম।

এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করতে চাইলে, প্রত্যেকের জন্য এক সা’ দিতে হবে। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আধা ‘সা’ দিতে হবে। ওজনের দিক দিয়ে এই পার্থক্যটি ও সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম হাদিসে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আর মূল্যের দিক থেকে এসব পণ্যের মূল্য অঞ্চল ভেদে এবং মৌসুমভেদে পার্থক্য রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত কয়েকটি দ্রব্য দ্বারা এই বছরের (১৪৪১ হি./২০২০ইং) সাদকাতুল ফিতর এর হার-

১। ভালো মানের লাল আটা বা গমের সর্বোচ্চ মূল্য ৪২ টাকা মূল্য ধরে আশা সা (হাদিসে বর্ণিত আরবের প্রচলিত একটি পরিমাপ) এক কেজি ছয় শত পঞ্চাশ গ্রাম (১.৬৫০) মূল্য= ৭০ টাকা।

২। ভালো মানের যবের মূল্য ১ কেজি ৮৬ টাকা ধরে, এক সা= ৩কেজি ৩০০ গ্রামের মূল্য= ৩০১ টাকা।

৩। কিসমিস ১ কেজি ৪৬০ টাকা দরে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের মূল্য= ১৫০০ টাকা।

৪। মাঝারি মানের খেজুর ১ কেজি ৪০০ টাকা দরে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের মূল্য= ১৪০০ টাকা।

৫। পনির ১ কেজি ৬৯৭ দরে ৩ কেজি ৩০০গ্রামের মূল্য= ২৩০১ টাকা।

বি.দ্র.: উল্লেখিত মূল্য ফিতরা আদায়কারী ব্যক্তি বাজারদর অনুসারে পণ্যের বিভিন্ন মান অনুসারে নির্ধারণ করে চাইলে আরো বেশি দিতে পারবেন। এখানে বুঝার সুবিধার্থে একটি মূল্য দেখানো হয়েছে।

কোন পণ্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম।

হাদিসে এ ৫টি দ্রব্যের যেকোনোটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যেকোনো ১টি দ্বারা তা আদায় করতে পারে।

এখন লক্ষণীয় বিষয় হল, সকল শ্রেণীর লোক যদি সবচেয়ে নিম্ন মূল্য-মানের দ্রব্য দিয়েই নিয়মিত সদকা ফিতর আদায় করে তবে হাদীসে বর্ণিত অন্য চারটি দ্রব্যের হিসেবে ফিতরা আদায়ের উপর আমল করবে কে?

আসলে এক্ষেত্রে হওয়া উচিত ছিল, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকা ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসাবে দেওয়ার সে তাই দিবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারে।

আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিই্ উত্তম নিয়ম। এ নিয়মই ছিল নবী, সাহাবা-তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের স্বর্ণযুগে। এ পর্যন্ত কোথাও দুর্বল সূত্রে একটি প্রমাণ মেলেনি যে, স্বর্ণযুগের কোনো সময়ে সব শ্রেণীর সম্পদশালী সর্বনিম্ন মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করেছেন।

হাদিস ও সাহাবায়ে কিরামের আমল অনুসারে বিষয়টি দেখা যেতে পারে: নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি ইরশাদ করেন-
أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি। সহিহ বুখারি, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮; সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান বাব আফযালুল আমল ১/৬৯।

সাহাবায়ে কেরাম-এর আমল ক) হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন,
كنا نخرج زكاة الفطر صاعًا من طعام أو صاعا من شعير أو صاعا من تمر أو صاعا من أقط أو صاعا من زبيب وذلك من صاع النبي صلى الله عليه وسلم.

আমরা সদকা ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর, কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। আর এক ‘সা’-এর ওজন ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘সা’ অনুযায়ী। -মুয়াত্তা মালেক পৃ.১২৪; আল ইসতিযকার, হাদীস ৫৮৯, ৯/৩৪৮

এ হাদীসে রাসূলের যুগে এবং সাহাবাদের আমলে সদকা ফিতর কোন কোন বস্ত্ত দ্বারা আদায় করা হত তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

(খ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি একবার মাত্র যব দ্বারা আদায় করেছেন। -আলইসতিযকার, হাদীস নং ৫৯০,৯/৩৫৪

ইবনে কুদামা রা.আবু মিজলাযের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন তাই ইবনে ওমর রা. সাহাবাদের তরীকা অবলম্বন করতে সারা জীবন খেজুর দ্বারাই আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে ওমরের ভাষ্য হল-

إن أصحابي سلكوا طريقا وأنا أحب أن أسلكه. ‘সাহাবীগণ যে পথে চলেছেন আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।’

এবার দেখা যাক মাযহাবের ইমামগণ উত্তম সদকা ফিতর হিসেবে কোনটিকে গ্রহণ করেছেন।

উত্তম সদকাতুল ফিতর

ইমাম শাফেয়ীর মতে উত্তম হল হাদীসে বর্ণিত বস্ত্তর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেওয়া। অন্য সকল ইমামের মতও এমনই।

ইমাম মালিক রাহ.-এর নিকট খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ‘আজওয়া’ খেজুর দেওয়া উত্তম। আজওয়া খেজুরের ন্যূনতম মূল্য ১০০০-১২০০ টাকা প্রতি কেজি।

ইমাম আহমদ রাহ.-এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। -আলমুগনী ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক সা খেজুরের সমপরিমাণ ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মদীনাতে গমের ফলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীতে হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে ফলন বৃদ্ধি পেলেও মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে, সেকালে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক সা খেজুরের সমপরিমাণ ছিল।

فلما كان زمن معاوية وكثرت الحنطة جُعِلَ نصف صاعٍ منها مثل صاع من تلك الأشياء.

হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা’ গমকে সদকা ফিতরের অন্যন্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হত। আলইসতিযকার ৯/৩৫৫।

ইবনুল মুনযির বলেন- فلما كثر في زمن الصحابة رأووا أن نصف صاع منه يقوم مقام صاع من شعير.

সাহাবিদের যুগে যখন গম সহজলভ্য হল তখন তারা আধা ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ যবের সমতুল্য গণ্য করলেন"।
-ফাতহুল মুলহিম ৩/১৫; আওজাযুল মাসালিক ৬/১৩

বুঝা গেল য, হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে গম দ্বারা সদকা ফিতর আদায়ের প্রচলন বেড়েছিল। এর কারণ হল যে, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যমানের খাদ্য। এ সময় হযরত ইবনে ওমর সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করতেন। তখন তাঁকে আবু মিজলায রাহ. বললেন-

إن الله قد أوسع والبر أفضل من التمر

‘আল্লাহ তাআলা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম। অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্ত্ত সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।

যাক আমাদের কথা ছিল, সাহাবায়ে কেরাম গম দ্বারা এজন্যই সদকা ফিতর আদায় করতেন যে, এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। হাদীসে পাঁচ প্রকারের খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সর্ব শ্রেণীর জন্য এমনকি সম্পদশালীদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে?

বড়ই আশ্চর্য! পুরো দেশের সব শ্রেণীর লোক বছর বছর ধরে সর্বনিম্ন মূল্যের হিসেবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকলেই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ৫৫/৬০ টাকা করে।

মনে হয় সকলে ভুলেই গেছে যে, গম হচ্ছে ফিতরার ৫টি দ্রব্যের একটি (যা বর্তমানে সর্বনিম্ন মূল্যের)। সুতরাং আমরা এদেশের ফিতরা আদায়কারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি তারা যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদীসে বর্ণিত দ্রব্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক উচ্চমূল্যের দ্রব্যটির হিসাবে ফিতরা আদায় করেন।

পনির, কিসমিস, খেজুর কোনোটির হিসাব যেন বাদ না পড়ে। ধনীশ্রেণীর মুসলিম ভাইদের জন্য পনির বা কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করা কোনো সমস্যাই নয়। যেখানে রমযানে ইফতার পার্টির নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়, ঈদ শপিং করা হয় অঢেল টাকার, সেখানে কয়েক হাজার টাকার ফিতরা তো কোনো হিসাবেই পড়ে না। যদি এমনটি করা হয় তবে যেমনিভাবে পুরো হাদীসের উপর মুসলমানদের আমল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত যিন্দা করা হবে, তেমনি এ পদ্ধতি দারিদ্র্যবিমোচনে অনেক অবদান রাখবে। গরীব-দুঃখীগণের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে ঈদের পবিত্র দিনে।

ওলামায়ে কেরাম ও সরকারের দায়িত্ব হলো, মুসলমানদেরকে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যের ফেতরা আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করেন।

এতে সব বেশি এবং গরিবের উপকার বেশি। আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলমানকে তার তার সন্তুষ্টি মোতাবেক এবাদত করার তাওফীক দিন। আমিন।

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ