মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার।।
সারাবিশ্বের চিকিৎসাবিদদের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এ মহামারি থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপায় যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঠিক সে মূহুর্তে বাংলার পল্লীগ্রামে ভিন্নচিত্র পরিলক্ষীত হয়। তবে সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব পল্লীর মানুষ বুঝলেও অতিরিক্ত আবেগ ও অচেতনতার কারনে তার সে ফল ভোগ করতে পারে না। নিজেদের চিন্তাভাবনার বাইরে মানতে চায় না কোন বিজ্ঞ লোকের পরামর্শ।
সুতরাং এ মহামারিকে পল্লীগ্রামের মানুষ নিছক আবেগ হিসেবে নিয়েছে। যশপুর গ্রামের বাসিন্দা সবুর মিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন নেই। তবে এখন বিভিন্ন জনের নিকট থেকে স্বাক্ষর করা ও নিজের নাম লেখা শিখে নিয়েছেন। এক সময় পুলিশের চাকরি করতেন।
এখন অবসরে এসে রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। তার সঙ্গে কোভিড ১৯ সঙ্কটে সামাজিক দূরত্ব নিয়ে কথা বলার পর তিনি বলেন, কোরআন এবং হাদিসের কোথাও নেই যে মহামারির সময় আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করা নিষেধ। তাই সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বরাবরের মতো সবসময় অবাধ সামাজিক মেলামেশা অব্যাহত রেখেছেন। অথচ দেখে দেখে কোরআন পড়তেও তার দন্তাংশ ভেঙে পড়ে।
তার কিনা জ্ঞানীদের চেয়েও আল্লাহভীতি বেশি। করোনার মতো দুর্যোগের সময়ও মসজিদ ত্যাগে চরম অনিহা। তবে কোভিড ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আর রাস্তাঘাতে চলতে দেখা যায় না। মৃত্যুর ভয় তাকেও এবার জেঁকে বসেছে। কদিন আগেও ধর্মীয় কাজের অজুহাত দিয়ে মসজিদকে আঁকড়েধরা সবুর মিয়ার আল্লাহভীতি মৃত্যুভয় এসে একদম নস্যাৎ করে দিল। আপন সিদ্ধান্তকেও স্থির হতে দেয়নি সবুর মিয়ার আবেগ।
গ্রামের মসজিদ গুলোতে আগে যেখানে গড়ে ১০-১২ জন মুসল্লি দেখা যেত এখন সেখানে মুসল্লির সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে শতাধিকের অঙ্কে।
বিপদের সঙ্কেত শুনেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনার হিড়িক পড়ে গেছে। চলছে সম্মিলিত খাবারের আয়োজন ও মিলাদ মাহফিলের মতো বিভিন্ন কৃত্রিম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। আর এসবের জন্য কোভিড ১৯ কে তারা একটি উপলক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। সুতরাং কোভিড ১৯ সে গ্রামের মানুষের মাঝে সতর্কতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির বিপরীতে উৎসব আমেজের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।
এদিকে পাশের গ্রামে কোভিড ১৯ সঙ্কটের কারনে মানুষ বেশ সতর্ক ও সচেতন। গ্রামের মানুষ বাঁশ ফেলে সকল প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গ্রামের ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে যাতে বাইরের কেউ গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে। গ্রামের ভেতরেও যারা নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদে হাঁটাচলা করছেন তাদের হাতে ও শরীরে ছেলেরা জীবানুনাশক ছিটিয়ে দিচ্ছে। তবে সে সতর্কতা ও সচেতনতা যে কতটা অজ্ঞতার আঁধারে নিমজ্জিত তা একটি ঘটনা থেকেই শতভাগ উপলব্দি করা যায়।
একদিকে গ্রামে রাজমিস্ত্রী, জেলে, ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে কারো আগমন যেমন বন্ধ নেই অন্যদিকে গ্রামের কবির মিয়ার মেয়ে জাহেদা সামাজিক দূরত্ব ঘোষণার পরও স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তাই গ্রামের মানুষ কবির মিয়াকে এমনভাবে ধরে বসলো যে তিনি খুব বড় ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করে ফেলেছেন। তো শেষ পর্যন্ত কবির মিয়ার যুক্তিতে কোন কাজ হলো না। গ্রামবাসী মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বাধ্য করলেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রামবাসীর উচিত ছিল যেহেতু কবির মিয়ার মেয়ে এসেই পড়েছে তাই তার পরিবারকে কিছুদিন গৃহবন্দি করে রাখা। কিন্তু অজ্ঞতার কারনে গ্রামবাসী বিপর্যয়ের মধ্যে আরো অতিরিক্ত বিপর্যয় বাড়িতে ডেকে আনলো। পরে অবশ্য জাহেদা স্বামীর বাড়িতে গিয়েও আশ্রয় নিয়ে নিলেন। তারাও বহিরাগত জাহেদাকে বরণ করলো।
বরণ করার পর কিছু সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা তারাও অনুভব করলেন না। আর সেটিও সম্ভব হয়েছে মূর্খতার কারনে।
গ্রামের বিভিন্ন রাস্তাঘাতে ছেলেরা জীবানুনাশক ছিটানো ও মানুষের হাতে স্প্রে করার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটিকেও তারা নিছক একটি উৎসব ও আবেগের বর্হিপ্রকাশ হিসেবে ধরে নিয়েছে। কারণ স্প্রের চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গুলোর ব্যপারে গ্রামবাসী খুবই উদাস। কারণ গ্রামের দোকান গুলোতে মানুষের আড্ডা ঠিক আগের মতোই আছে, বরং এখন আরেকটু বেড়েছে করোনাভাইরাসের আলোচনা সমালোচনাকে কেন্দ্র করে।
এখনো অব্যাহত আছে আগের মত কর্মদন ও কোলাকুলি। এভাবে কোভিড ১৯ পল্লীগ্রামের মানুষের বিবেকে কোন সচেতনতা ও সর্তকতা অনয়ন করতে পারেনি। দিতে পারেনি কোন শিক্ষাও। শুধু বাড়িয়েছে কিছু মূর্খ আবেগ ও বিবেকবিহীন আনুষ্ঠানিকতা।
লেখক: শিক্ষার্থী, টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম