বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


রমজান: আত্মশুদ্ধির পাঠশালা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা তৈয়ব উল্লাহ নাসিম।।

এক.
রোজা শুধু উপবাস থাকার নাম নয়। পানাহার বর্জন করলেই রোজা রাখা হয়ে যায় না। রোজা হল আত্মশুদ্ধির পরিপূর্ণ একটি পাঠ, আর রমজান হল তার পাঠশালা।

হাদিসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও পাপাচার ছাড়তে পারলো না, তার পানাহারে বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই আল্লাহর নিকট। (বুখারি)

আমরা যদি এই পাঠশালায় পূর্ণরুপে আধ্যায়ন করে আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ নিই, তবেই এই প্রশিক্ষণের আলোকে পুরো বছর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রদর্শিত পদ্ধতিতে জীবন যাপন করতে পারবো। কারণ মানুষ প্রশিক্ষণ নেয় আগত সময় তার আলোকে পরিচালনার জন্য। সুতরাং পানাহার বর্জনের পাশাপাশি আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর রোজাও বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুই.
অন্তরের জন্য রয়েছে রোজা।আমাদের জিহ্বার জন্যও রোজা পালন অত্যন্ত জরুরী।চক্ষু, কর্ণ, উদর সবকিছুর জন্য রয়েছে রোজা। এই সবকিছুর রোজা সমষ্টিগতভাবে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারলে তবেই আমাদের রোজা পরিপূর্ণরুপে আদায় হবে এবং এর দ্বারাই হবে আমাদের প্রকৃত আত্মশুদ্ধি।যা আল্লাহ তাআলা আমদের কাছ থেকে চান।

এতে করে আমরা পাবো মহান আল্লাহ তাআলার ঘোষিত সে পুরস্কার যা তিনি নিজ হাতে দিবেন বলে অঙ্গিকার করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা রা, থেকে বর্ণীত রাসুল সা, বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটি আমল তার জন্য, একমাত্র রোজা ছাড়া। রোজা শুধুই আমার জন্য এবং এর বিনিময় আমি স্বয়ং দেবো। (বুখারি,মুসলিম)

অর্থাৎ নামাজ, জাকাত, হজ্ব ইত্যাদী যদি মানুষ না আদায় করে, তবে সবাই জানবে। কারণ একজন মানুষ সুস্থ সবল হয়েও মসজিদ মুখি না হলে, লোকে দেখবে, বেনামাজি বলে সমালোচনা করবে। তদ্রুপ সম্পদশালী হয়েও যাকাত না আদায় করলে এবং হজ্ব পালন না করলে, আশপাশের মানুষ জানবে, সমালোচনা করবে।

কিন্তু রোজা এমন এক এবাদত, যা বান্দা আদায় করছে কি না তা একমাত্র আল্লাহই জানতে পারেন। কারণ কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি পানাহার করে, লোক সম্মুখে নিজেকে রোজাদার বলে প্রকাশ করলে আল্লাহ ছাড়া তার এই লুকোচুরি আর কেউ জানবে না। এখানেই হলো রোজা ও অন্য আমলের তফাৎ।

সুতরাং কেউ যদি রমজানের এই আত্মশুদ্ধির পাঠশালায় নিজেকে শুদ্ধ করে নিতে পারে, তাহলে আরেকটি পাঠশালার আগমন পর্যন্ত পরিশুদ্ধভাবে নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারবে সারাটি বছর।

তিন.
(ক) অন্তরের রোজা।

অন্তরের শুদ্ধতা হল সকল হিদায়াতের মূল। হাদিসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, মনে রেখো, শরীরের মধ্যে একটি অঙ্গ রয়েছে যার পরিশুদ্ধতার উপর পুরো শরীরের শুদ্ধতা নির্ভর করে এবং যার অনিষ্ট পুরো শরীরের অনিষ্টতা, আর সেটা হল অন্তর। (বুখারি,মুসলিম)

সুতরাং আপনার অন্তরের শুদ্ধতা আপনার জন্য দুনিয়া আখিরাতের সফলতা, আর অন্তরের অনিষ্টতা নিশ্চিত ধ্বংশ ছাড়া কিছু নয়। সব মানুষেরই রয়েছে অন্তর বা হৃদয়। কিন্তু তা দুরকমের হয়।১- জীবিত অন্তর, যা ঈমানের আলোয় আলোকিত, আল্লাহ তাআলার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীরুতায় ভরপুর।আল্লাহ তাআলা সূরায়ে নূরে এর বর্ণনায় বলেন “জ্যোতির উপর জ্যোতি! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ নির্দেশ করেন তার জ্যোতির দিকে” (সূরা নূর-৩৫)

২- মৃত অন্তর, যা অবিশ্বাসে পূর্ণ এবং যা নিফাক্ব বা মুনাফেকি ইত্যাদীতে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন “তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে” (সূরা বাক্বারা-১০)

আরো ইরশাদ হয়েছে, “তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেনা? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ” (সূরা মুহাম্মাদ-২৪)

রাসুল সা. এ জন্য সব সময় এ দোয়া পাঠ করতেন “হে অন্তর সমূহের পরিবর্তনকারী প্রভূ আমার অন্তরকে আপানর দ্বীনের উপর স্থির ও অটল রাখুন” (তিরমিজি)

মুমিনের অন্তরের জন্য রয়েছে রোজা, যা রমজান ও রমজানের বাইরে সবসময়ের জন্য। তবে রমজান যেহেতু আত্মশুদ্ধির পাঠশালা তাই রমজানে অন্তরের রোজার প্রশিক্ষণ নিতে পারলে বাকি সময় সে অনুযায়ি চলাটা সহজতর হবে। অন্তরের রোজা হল অন্তরকে সকল অনিষ্ট ও ধ্বংসাত্বক শিরকি এবং বাতিল বিশ্বাস থেকে এবং কুমন্ত্রনা, খারাপ প্রেরণা ইত্যাদী থেকে মুক্ত রাখা।অহংকার থেকে পবিত্র রাখা অন্তর কে।

হাদিসে ক্বুদসীতে আল্লাহপাক বলেন, "অহংকার হলো আমার চাদর আর বড়ত্ব হল আমার লুঙ্গি স্বরূপ। এ দুই বস্তুর মধ্যে যে আমার অংশিদার হতে চেষ্টা করবে তাকে আমি কঠিন শাস্তি দেবো। (আহমাদ)
এছাড়া অন্তরের রোজা হল আত্মতুষ্টিকে অন্তরে স্থান না দেয়া। আত্মতুষ্টি হল মানুষ নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দোষত্রুটিমুক্ত ভাবা। এটা মানুষের খুবই খারাপ একটা দিক। যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। রাসূল সা. বলেন, তিনটি বস্তু ধ্বংসর মূল, মানুষ আত্মতুষ্টিতে ভোগা (তারমধ্যে একটি) [সিলসিলাতুল আহাদিস আসসসাহীহা]

অন্তরের আরো রোজা হল হিংসা থেকে মুক্ত থাকা। কারণ হিংসা নেক আমলগুলোকে নষ্ট করে দেয় এবং অন্তরের জ্যোতিকে নিভিয়ে দেয়। হাদিসে পাকে এসেছে, তোমরা একে অপরকে হিংসা করো না।(মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে রাসূল সা. এক ব্যক্তি সম্পর্কে তিনবার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তখন ঐলোককে জিজ্ঞাসা করা হলো তুমি কী আমল কর? উত্তরে লোকটি বলল আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিম ভায়ের প্রতি হিংসা বা বিদ্বেষ বা ধোকা নিয়ে কখনো ঘুমাই না। (আহমাদ,নাসাঈ,বাইহাক্বী)

(খ) জিহ্বার রোজা।

জিহ্বার রয়েছে বিশেষ রোজা যা কেবল মিথ্যা পরিত্যাগ করাই যথেষ্ট না। বরং অনর্থক কথা বার্তা থেকে বিরত থাকাও জরুরী। রাসূল সা. মুআজ রা. কে জিহ্বা দেখিয়ে বলেন এটাকে সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখো। তখন মুআজ বলল হে আল্লাহর রাসূল আমরা কি আমাদের কথা বার্তার জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবো?

উত্তরে রাসূল সা. বললেন হে মুআজ (তোমার মা তোমাকে ধ্বংস করুক) অধিকাংশ মানুষই তাদের জিহ্বার ফসলের কারণে তাদের মুখমন্ডল নিম্নমুখি অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপিত হবে।(তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাজাহ)

এছাড়া মিথ্যা ও পাপাচারের হাদিস উপরে বর্ণীত হয়েছে।জিহ্বার রোজা শুধুমাত্র রমজানের সাথে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রমজানের বাইরেও তা প্রযোজ্য। কিন্তু রমজানের পাঠশালায় এই রোজায় অভ্যস্ত হলে আগামি দিনে এটা পালন তার জন্য সহজ হবে। অনেক রোজাদার আছে যার রোজা বিনষ্ট হয় শুধুমাত্র এই জিহ্বার কারণে।
জিহবা কে রোজা রাখতে হবে যথাক্রমে: মিথ্যা বলা থেকে, পরনিন্দা, চোগলি আচরণ(একের কথা অন্যের নিকট বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা), গালি গালাজ, খারাপ কথা, একে অপরকে লানত(বদ দোয়া), কাউকে উপহাস করা, ঠাট্টা তামাশা ইত্যাদি থেকে।

(গ) চোখের রোজা।

চোখের রোজা হল যথাক্রমে: হারাম দৃষ্টি ও দর্শন থেকে চক্ষু সংযত রাখা। নোংরা কিছু সামনে আসলে তা থেকে চক্ষু অবনমিত রাখা। নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে চোখ বন্দ করে ফেলা ইত্যাদি।

কুরআনে পাকে ইরশাদ হয়েছে, মুমিনদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে; এটা তাদের জন্য পবিত্রতম; তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। ঈমানদার নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে।
(সূরা নূর-৩০,৩১)

আলী রা. রাসূল সা. কে দৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উত্তরে রাসূল সা. বলেন “তোমার দৃষ্টিকে সংযত রাখো”
(মুসলিম, তিরমিযী, আবূদাউদ) অন্য এক হাদিসে এসেছে, চোখের জিনা হল অবৈধ দৃষ্টি।

(ঘ) কানের রোজা।

কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, নিশ্চিত কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।(বনী ইসরাইল-৩৬)

কানের রোজা হলো গান বাজনা, নোংরা কথা বার্তা, পরনিন্দা ইত্যাদি যা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়, এমন সবকিছু শ্রবন থেকে তাকে বিরত রাখা। পাশাপাশি কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত, আলেমদের ওয়াজ নসিহত, উপদেশাবলী ইত্যাদি শ্রবনে অভ্যস্ত করা।

(ঙ) পেটের রোজা।

পেটের রোজা হল তাকে হারাম ভক্ষণ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, হে রাসূলগন, তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর।
(সূরা মুমিনূন-৫১)

পানাহার থেকে সারাদিন পেট কে বিরত রেখে ইফতারে পানাহার করার সময় তা যদি হয় হারাম সুদ, ঘুষ কিংবা অন্যোপায়ে হারাম উপার্জনের খাবার তবে এ রোজা কী কাজে আসবে?

আবূ বকর রা. একবার কিছু খাবার খেয়ে পরে তার খাদেমকে জিজ্ঞাসা করলেন খাবারের উৎস সম্পর্কে।খাদেম বললো এটা আমার জাহেলী যুগে যাদু বিদ্যা দিয়ে উপার্জনের টাকার খাবার।তখন আবূ বকর রা. সাথে সাথে গলায় আংগুল ঢুকিয়ে বমি করে পেটের সব খাবার বের করে ফেললেন। সুবহানাল্লাহ! তাদের আল্লাহভীতি ছিল এরকম।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজানের এই শ্রেষ্ঠ পাঠশালায় আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ নিয়ে সারা বছর তার আলোকে জীবন পরিচালনার তৌফীক্ব দিন। আমীন।

(ড. আয়েজ আল ক্বারনীর সালাসূনা দারসান লিসসাইমীন বইয়ের একটি লেখার ছায়া অবলম্বনে রচিত।)

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ