মূল: শায়খ আহমাদুল্লাহ
অনুলিখন: মুহাম্মদ হামিদ হুসাইন
সম্মানিত ভাই ও বন্ধুগণ! পবিত্র রমজানুল কারিম আমাদের একেবারে দোরগোড়ায় চলে এসেছে। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হচ্ছে মহান আল্লাহ তাআলার রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারক।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! রমজানুল কারিমকে যথাযতভাবে ব্যবহার করতে হলে আমাদেরকে আগে থেকেই যথাযোগ্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভালো প্রস্তুতি মানে কাজটির অর্ধেক পূর্ণতা। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা বড় কাজে যদি আগে থেকে যথাযথভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে তাহলে সেই কাজ অর্ধেক পরিপূর্ণতায় পৌঁছে যায় আর যদি প্রস্তুতিটা যেনতেনভাবে হয় তাহলে সেই কাজ সফল হবে এমনটি বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেনতেন প্রস্তুতি নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই শতভাগ সফল হয় না।
প্রিয় বন্ধুগণ! রমজানুল কারিম মহান রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে বিশাল একটি অফার, একটি সুযোগ ও রহমতের ভান্ডার নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছে। সেই রমজানুল কারিম কে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে হলে, সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করতে হলে, এর মাধ্যমে আমাদের জীবনকে সফলতার মূল প্রান্তে পৌঁছুতে হলে, এখন থেকে আমাদেরকে সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের সমাজে রমজান মাসকে বরণ করার জন্য, রমজান মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য যে প্রস্তুতি আমরা দেখতে পাই, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, রমজানকে স্বাগত জানানোর যে চিত্র, যে পরিবেশ আমরা দেখতে পাই সেটি রমজানের যে বার্তা, রমজানের যে শিক্ষা, রমজানের যে ডাক, রমজানের যে বরকত, রমজানের যে মাগফিরাত, রমজানের যে ফজিলত, রমজানের যে আহ্বান তার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বরং অনেকখানি সাংঘর্ষিক।
আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের রমজানের প্রস্তুতির চিত্র যদি আমরা দেখি, তা হলে দেখা যায় আমাদের দেশের সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য ও বাণিজ্যমন্ত্রণালয় রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চাল, ডাল, চোলা, চিনি, খেজুর ইত্যাদি আমদানিতে তাঁরা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কেন ভাই? যে জনসাধারণ রমজানের আগে দেশে ছিলেন, রমজান উপলক্ষে কি কোন জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে? কিন্তু তা না হলে খাবারের জন্য এ বিশাল আয়োজন কেন? প্রতি বছরই দেখা যায় বাজারে হাহাকার অবস্থা এবং মানুষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা শুরু করে দেন অর্থাৎ ভাবখানা এমন যে রমজানের প্রস্তুতি মানে খাবারের বিশাল আয়োজন। এটি একটি ভুল প্রস্তুতি।
প্রিয়ভাই ও বন্ধুগণ! ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের দেশে মিডিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত, বিশেষত যারা ফিল্ম-সিনেমা- নাটক ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট। তাদের রমজানের প্রস্তুতিটা কি? তাদের রমজানের প্রস্তুতি হল, রমজান উপলক্ষে আগে থেকে সিনেমা তৈরি করা, ঈদের সিনেমা বানানো নিয়ে তারা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটাই হলো তাদের রমজানের প্রস্তুতি। ঈদের সিনেমা তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে এখন থেকে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ঈদের নাটক দেখাবেন, রমজান উপলক্ষে তারা বিষেশ অনুষ্ঠান প্রচার করবেন। এ নিয়ে তাদের মহাপ্রস্তুতি।
অন্য দিকে যারা প্রিন্টমিডিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবেন। এখন থেকে শুরু করে দিয়েছে তাদের রমজানের প্রস্তুতি। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ম্যাগাজিন যারা প্রকাশ করেন ঈদ উপলক্ষে তারা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবেন। সেই সংখ্যায় কোন কোন লেখকের লেখা থাকবে? কোন কোন বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন থাকবে? সেসব কর্মকাণ্ডই তাদের রমজানের প্রস্তুতি।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে যারা খাদ্যের দোকানদার তারা এখন থেকে সজাগ। তাদের রমজানের প্রস্তুতি হলো, অতিরিক্ত খাদ্য গুদাম জাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা। যাতে রমজান আসলে উচ্চমূল্যে অধিক মুনাফায় বিক্রি করা যায়।
যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের রমজানের প্রস্তুতি কী? রমজানে তো সভা-সমাবেশ করা যায় না, রাজনীতি বন্ধ থাকলে কিভাবে হবে? সেজন্য ইফতারের নামে রাজনীতি করার জন্য তারা এখন থেকে ইফতার পার্টির সিডিউল ঠিক করার জন্য ব্যস্ত। যেহেতু মিছিল-মিটিং ইত্যাদি সব বন্ধ, সুতরাং কোন দল কোন দিন কাদের সাথে ইফতার করবেন?
কোন রাজনৈতিক দলের সাথে কোন রাজনৈতিক দল ইফতার পার্টি করবে এই হলো রাজনীতিবিদদের রমজানের প্রস্তুতি।
আর আমাদের সাধারণ মানুষের রমজানের প্রস্তুতি হলো রমজানের ২০-২৫ দিন আগে থেকে রমজান উপলক্ষে অতিরিক্ত সয়াবিন তেল, ছোলা, চিনি, চাল, ডাল, খেজুর, বেগুন, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি সংগ্রহ করা। কারণ রমজানে এই জিনিসগুলোর দাম বেড়ে যায়। ঈদের কাপড়-চোপড় তো আছেই। এই হলো আমাদের সাধারণ জনগণের রমজানের প্রস্তুতি। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন।
এটা কি রমজানের প্রস্তুতি হওয়ার কথা ভাই? আমাদের সকলের, সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের রমজানের প্রস্তুতি দেখলে মনে হয়, রমজান মাস আসছে ভোগের জন্য। মনে হয় রমজান আসছে খাওয়ার জন্য। অথচ রমজান হল ত্যাগের মাস। আমাদের প্রস্তুতি দেখে বুঝা কঠিন, এটা কি আসলেই রমজান মাস নাকি অন্য কিছু।
প্রিয় বন্ধুগণ! আমাদের রমজানকে সুন্দরভাবে কাটানোর জন্য শরীয়াহ্ নির্দেশিত পন্থায় যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
মু‘আল্লাহ ইবনে ফজল, বিখ্যাত একজন তাবেঈ, তিনি বলেন, সালাফে সালেহীন-আমাদের পূর্বসূরীগণ রমজানের ছয় মাস আগে থেকে দোয়া করতেন, যেন তাঁরা রমজান পর্যন্ত হায়াত পান। রমজান শেষে বাকি ছয় মাস তারা দোয়া করতেন, যেন রমজানের আমলগুলো মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়।
প্রিয় বন্ধুগণ! তাবরানী তে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ان الله يحب احدكم عملا ان يتقنه “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন যে, বান্দা যে আমল করে তা যেন যথাযথ ভাবে করে।” ভালোভাবে করে, উত্তমভাবে করে, সুন্দর উপায়ে করে, সেই জিনিসটা আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন। ভালোবাসেন।
কোন কাজ যথাযতভাবে না করলে সেটা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। আমাদের রমজান সুন্দরভাবে কাটবে কখন? যখন আমরা সে বিষয়ে ভালোভাবে আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করব, ইবাদত বন্দেগী করার জন্য, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, আমাদের কৃত গুনাহ থেকে মুক্তিলাভের জন্য, জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য ভালোভাবে আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করব। তখন সেটাই হবে যথাযথভাবে রমজান অতিবাহিত করা। যার মধ্য দিয়ে আমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় পাত্র হওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারব।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! তাই রমজানের প্রস্তুতির জন্য আমরা কিছু বিষয় নির্ধারণ করতে পারি যে বিষয়গুলো আমাদেরকে রমজানের প্রস্তুতিটাকে সুন্দর করতে সহায়তা করবে। যে প্রস্তুতি গুলো আমাদেরকে রমজানুল মোবারক কে সুন্দর ভাবে কাটাতে সহযোগিতা করবে।
যে উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে রমজান দান করেছেন, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা সিয়াম দান করেছেন, তার পথে আমরা অগ্রসর হওয়ার জন্য এই পরামর্শগুলো আমাদের কাজে আসবে। ইনশাআল্লাহ।
তার মধ্যে প্রথম হলো তাওবা এবং ইস্তেগফার করা। কেউ যদি আল্লাহর কাটগড়ায় আসামি হয়ে থাকি। আগে থেকেই তার নামে মামলা চলমান থাকে। আগে থেকেই যদি আমরা দাগে আসামিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকি। তাহলে নতুন করে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নেক আমলের তৌফিক অর্জন করা একটু কঠিন ও কষ্টকর।
এজন্য আমাদেরকে আগের যে অপরাধ গুলো আছে, রমজান আসছে সেজন্য আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে ফরিয়াদ জানানো, তাওবা করা, ফিরে আসা, নতুনভাবে সরল পথে জীবন গড়ার জন্য সংকল্প করতে হবে। শপথ করতে হবে। আমাকে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। পেছনের গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে ফিরে আসতে হবে। তাওবা করতে হবে। এটি হল রমজানের প্রথম প্রস্তুতি।
দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে সেটি হল কুরআন এবং সুন্নাহয় বর্ণিত রমজানের ফজিলত সম্পর্কে অত্যাধিক আলোচনা করতে হবে। যে আমল গুলোর কথা কুরআন এবং সুন্নাহয় বলা হয়েছে। যে সমস্ত উপকারিতার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো এখন থেকে বেশি বেশি আলোচনা করতে হবে। পড়তে হবে। জানতে হবে এবং কল্পনা করতে হবে। মাথায় বারবার রিমাইন্ড করতে হবে যে, রমজান কিন্তু আসছে হে আমার প্রবৃত্তি।
নিজেকে নিজে বলতে হবে, এই যে রমজান আসছে, এ রমজান যেন আমার জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ হয়ে যায়। এ রমজান যেন আল্লাহ কে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করতে কাজে লাগাতে পারি। এ রমজান যেন জান্নাতের বিশেষ দরজা দিয়ে প্রবেশের একটি মহাসুযোগ হয়। এ রমজান যেন আমাদের জীবনের সমস্ত ভুল ভ্রান্তি থেকে মুক্তি লাভের একটি সুবর্ণ সুযোগ হয়। এ রমজান যেন আমার জীবনকে পরিবর্তন করার উপায় হয়।
শয়তানের সঙ্গে আমার যে দস্তাদস্তি চলে, লড়াই চলে, সে আমাকে অন্যায় করাতে চায়, আমি ভালো করতে চাই, এ রমজান যেন সেই লড়াইয়ে আমার জেতার সুবর্ণ-সুযোগ হয়। কারণ আল্লাহ শয়তানকে এ মাসে বেঁধে রাখেন। এ রমজান যেন আমি তাকে হারিয়ে জান্নাতী হওয়ার সুযোগ পেতে পারি। রমজানের যে সমস্ত উপকারিতাগুলো আছে, আগে থেকে সেগুলো মনে মনে কল্পনা করা, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা, তাহলে কি হবে? রমজানের জন্য আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারব। ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয় যে কাজটি করতে হবে সেটি হল ক্ষমা এবং অতিরিক্ত সাওয়াব লাভের জন্য, মাগফেরাত পাওয়ার জন্য এখন থেকে অবহেলায় না কাটানোর জন্য মানসিকভাবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, জীবনের অন্যান্য রমজান যেভাবে গেছে না গেছে। আমি এ রমজান টা অবহেলায় কাটাব না।
প্রিয় বন্ধুগণ! আমরা দেখতে পাই, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে সাত-আটটি রমজান পেয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রদিয়াল্লাহু আনহুম রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর কেউ দুইটি কি তিনটি, কেউ পাঁচটি কি ছয়টি রমজান তারা অতিমাত্রায় পেয়েছেন। এর পর জিহাদে শহীদ হয়ে গেছেন বা ইনতেকাল করেছেন কিন্তু ওনারা এই স্বল্প সময়কে এত সুন্দর ব্যবহার করেছেন যে তারা জীবনে সফল হয়ে গিয়েছেন।
আলহামদুলিল্লাহ, আমরা একেক জন জন্মসূত্রে মুসলিম। প্রাপ্তবয়স্ক থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রমজান পাচ্ছি। ৩০-৪০টি রমজান পাচ্ছি। প্রিয় বন্ধুগণ! আমরা ৩০-৪০টি রমজান পেয়েও আমাদের জীবনকে সফল ভাবে কাটাতে পারছি না! এর অন্যতম একটি কারণ হলো রমজানের জন্য আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি যথাযথ নয়।
অতএব প্রিয় বন্ধুগণ রমজানের প্রস্তুতি সমূহের মধ্যে তৃতীয় প্রস্তুতি হল এ মাস উপলক্ষে আল্লাহর ক্ষমা-রহমত-বরকত-মাগফিরাত-নাজাত এগুলো পাওয়ার জন্য মানসিকভাবে আমাদেরকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, এ রমজানে টাকা আসুক আর না আসুক, ব্যবসা হোক আর না হোক, অন্যান্য কাজগুলো হোক বা না হোক, লাভ বা ক্ষতির সম্মুখীন যাই হই না কেন আমি প্রতিজ্ঞা করলাম এই রমজানটা আমি ব্যতিক্রমভাবে অতিবাহিত করবো। এই রমজানে আমি আমার মালিক কে খুশি করে ছাড়বো।
এই রমজানে আমি আমার নাম যদি জাহান্নামের খাতায় উঠে থাকে (আল্লাহ না করুন।) কাটিয়ে ছাড়বো। ইনশাল্লাহ। এ রমজানে আমি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবো। ইনশাআল্লাহ।
চতুর্থ যে প্রস্তুতি নিতে হবে হবে সেটি হল প্রিয় বন্ধুগণ এর আগে গত বছর বা পূর্ববর্তী বছর অতিবাহিত জীবনের রমজানের কোন রোজা যদি কাযা হয়ে থাকে তাহলে শাবান শেষ না হতেই অবশ্যই আমাদেরকে পূর্বের রমযানের কাযা রোযা আদায় করে নিতে হবে।
আমাদের মা-বোনদের থাকার সম্ভাবনা আছে, তাদেরকে সেগুলো আদায় করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের নিজেদের থাকলে, কোনো অসুস্থতার কারণে বা যেকোনো কারণে রমযানের রোযা যদি কাযা হয় তাহলে এই রমজানের পূর্বেই সেই রোজাগুলো আমাদেরকে রাখতে হবে এটি হলো ৪ নম্বর প্রস্তুতি।
প্রিয় বন্ধুগণ! রমজানের প্রস্তুতির পঞ্চম নাম্বার হল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমজান উপলক্ষে যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা করেন, এই ক্ষমা পাওয়ার জন্য শিরক ও হিংসা থেকে দূরে থাকা। এই সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার জন্য কোন কোন হাদীস শরীফে দুটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল থেকে শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহর সাথে, আল্লাহর ক্ষমতা সমূহে কাউকে অংশীদার ভাবাপন্ন মনোভাব থেকে দূরে থাকা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া।
রমজান আসছে আল্লাহ অটোমেটিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাধারণ ক্ষমা করে দিবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন বহু মানুষকে, আমি যেন আমার নামটি সেই তালিকায় উঠাতে পারি সেজন্য আমাকে এখন থেকে দুটি কাজ করতে হবে। অন্তর থেকে হৃদয় থেকে হিংসাকে মুছে ফেলতে হবে।
শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এই দুটি মহা অপরাধ থেকে নিজেকে পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র করতে হবে। যদি আমরা পারি তাহলে রমজান মাসের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার জন্য আমি উপযুক্ত হয়ে যাব। ইনশাআল্লাহ। তাহলে এখন থেকে রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে পাঁচ নম্বর হচ্ছে শিরক ও হিংসা থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।
প্রিয় বন্ধুগণ! রমজানের ষষ্ঠ নম্বর প্রস্তুতি হল রোজা সম্পর্কিত মাসআলা মাসায়েলগুলো যথাযথভাবে শিক্ষা করা।
সিয়াম সম্পর্কিত মাসআলা মাসায়েলগুলো যথাযথভাবে শিক্ষা করতে হবে। জানতে হবে। ইসলামে যে বিষয়গুলো ফরজ সেগুলো শিক্ষা করাও ফরজ। যে বিষয়গুলো ওয়াজিব সেগুলো শিক্ষা করাও ওয়াজিব। যে বিষয়গুলো সুন্নাত সেগুলো শিক্ষা করাও সুন্নত।
প্রিয় বন্ধুগণ! অতএব রমজানের রোজা কি কি কারণে ভেঙে যেতে পারে? কি কি কারনে অপছন্দনীয় হতে পারে? কি কি কারনে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে? কিভাবে রমজানের রোজা যথাযথভাবে আদায় করা যেতে পারে সে বিষয়ক জ্ঞান আমাদেরকে অর্জন করতে হবে।
রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে সপ্তম নম্বরে যে প্রস্তুতি আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে সেটি হল পূর্বের ভুল নির্ধারণ করা। পেছনের যে সকল রমজান আমাদের কেটে গেছে, অতিবাহিত হয়ে গেছে, গত বছরের রমজান, তার পূর্বের বছরের রমজান, তার পূর্বের রমজান গুলোতে আমরা যে সকল আমল করতে পারিনি। পরে আফসোস করি, চিন্তাগ্রস্থ হয়ে যাই।
মূলত আফসোস করে কোন লাভ নেই। পূর্ব থেকেই ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে রমজান কেটে যাবে কিন্তু রমজানের যে উপকারিতা আমাদের পাওয়ার কথা আমরা সেটি থেকে বঞ্চিত হব। আক্ষেপ করে লাভ নেই, যা করার আগে থেকেই করতে হবে।
সেজন্য প্রিয় বন্ধুগণ! কোন্ কোন্ কারনে, কোন্ সমস্যার কারণে পূর্ববর্তী রমজানগুলো আমরা যথাযথভাবে আদায় করতে পারিনি, সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এই রমজানে সেই সমস্যাগুলো থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে হবে। কেন আমার তারাবি পড়া হয়নি? কেন রমজানে আমি কুরআনুল কারিমের সম্পূর্ণ তিলাওয়াত শেষ করতে পারিনি? কেন অর্থ সহকারে পবিত্র কুরআন বুঝতে পারিনি?
কেন আমি কুরআনের আলোচনা যেখানে হয় সেখানে বসতে পারিনি? কেন আমি বিগত রমজান সমূহে যথেষ্ট পরিমাণ দান-সদকা করতে পারিনি? কেন আমি মিসকিনদের ইফতার করাতে পারিনি? রোজাদারকে ইফতার করাতে পারিনি? কোন সমস্যার কারণে? ঐ সমস্যাটি যেন এ রমজানে কাছে আসতে না পারে, সেই থেকে দূরে থাকতে হবে। আমার বন্ধুর কারণে? আমার প্রতিবেশীর কারণে? কোন সমস্যার কারণে? কারণ সমূহ থেকে নিজেকে যোজন যোজন দূরে রাখতে হবে। তহলে এবারের রমজান আমরা সুন্দর ভাবে, সফল ভাবে অতিবাহিত করতে পারব। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাওফীক দান করেন।
প্রিয় বন্ধুগণ! রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে অষ্টম হল রমজানের যে নেক আমল গুলো রয়েছে সেগুলোর উপর শাবান মাস থেকে প্রস্তুতিমূলক মহড়া শুরু করতে হবে। রিহার্সেল শুরু করতে হবে। আমল করা শুরু করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো অভিযানের আগে থেকে সাধারণত মহড়া চালানো হয়। আমাদের জন্য রমজান আসছে, সেজন্য আমাদেরকে অনেক আগে থেকে সে আমলসমূহের মহড়া শুরু করে দিতে হবে। বেশি বেশি রোজা রাখতে হবে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবানে বেশি বেশি রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। শাবান মাস থেকে আমাদেরকে কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়তে হবে। যাতে রমজানে তিলাওয়াত করতে সুবিধা হয়। এখন থেকে রমজানের আমল সমূহ বেশী বেশী অনুশীলন করতে হবে।
নবম প্রস্তুতিটি হল পবিত্র রমজান মাসের ২৪ ঘণ্টার একটি রুটিন আমাদেরকে এখন থেকে তৈরি করতে হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটিতে আমি কোন মুহূর্ত কিভাবে অতিবাহিত করবো? কিভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করব? আমি কিভাবে আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথ থেকে ফিরে আসবো এ চেতনা থেকে পুরো ২৪ ঘন্টার একটি রুটিন আমাকে তৈরি করতে হবে।
আমি প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত কোন সময় করব? কোন সময় কত পারা কুরআন তেলাওয়াত করব? আমি প্রতিদিন কত টাকা করে দান করব? প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যার কোন কোন দোয়া গুলো আমি নিয়মিতভাবে পাঠ করবো? প্রতিদিন আমি কতবার নিয়মিতভাবে দরুদ শরীফ পড়ব? একটা তালিকা করে নিতে হবে। মহান আল্লাহ তৌফিক দান করুন।
প্রিয় বন্ধুগণ! রমজানের দশম যে প্রস্তুতি আমাদেরকে নিতে হবে, তা হল আমাদেরকে রমজানের চাঁদ নিজের চোখে দেখার চেষ্টা করতে হবে। এখন তো আমরা সকলে হেলাল কমিটির দিকে চেয়ে থাকি। টেলিভিশন রেডিও তে আমরা কান পেতে থাকি কখন তারা ঘোষণা দিচ্ছে? কখন কোথায় ঘোষণা দিচ্ছে চাঁদ উঠেছে? এতে করে যেটা হচ্ছে, চাঁদ দেখার যে একটি সুন্নত রয়েছে সেটি আমাদের থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এটি কাম্য নয়। দায়িত্বশীলগণ অবশ্যই দেখবেন, সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমাদেরকেও চাঁদ দেখার জন্য চেষ্টা করতে হবে। অতএব রমজানের প্রস্তুতি হবে শাবানের শেষের তারিখ গুলোতে ২৯-৩০ তারিখ আমাদেরকে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতে হবে। পশ্চিমাকাশে একটু অনুসন্ধান করতে হবে।
রমজানের সর্বশেষ প্রস্তুতিটি হল এখন থেকে আল্লাহর দরবারে বেশী বেশী তাওফীক প্রাপ্তির দোয়া করতে হবে। যে আল্লাহ, আমি যতই চেষ্টা করি, তোমার তাওফীক না হলে কোন ভাল কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আল্লাহ রমজানে কত মানুষ সৌভাগ্যবানদের কাতারে দাঁড়াবেন।
আমাকেও তুমি তাদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করো। আল্লাহ রমজানে কত মানুষ ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে যাবে, আল্লাহ কত মানুষ জান্নাতি হয়ে যাবে, মালিক! আমিও যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি। সেই সৌভাগ্যবানদের সাথে আমিও যেন দাঁড়াতে পারি। আল্লাহ তুমি একটু আমাকে তৌফিক দান করো। আল্লাহ তুমি আমাকে সহজ করে দিও।
এজন্য এখন থেকে আল্লাহর কাছে অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে তাওফীক চাইতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: বিশিষ্ট দা’য়ী ও ইসলামি আলোচক।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম