শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আ.লীগ নেতাকর্মীর প্রভাবে নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সংবর্ধনা বাতিল আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা ইসলামি লেখক ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত, আসছে নতুন কর্মসূচি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

স্মৃতিতে ভাস্বর আনসারী রাহি.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী ।।

‘জন্মেছি আমরা মরিবার তরে’ অমোঘ এ বিধিকে বরণ করে ১৭ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধায় পরপারে চলে গেলেন, দেশের কীর্তিমান ইসলামি চিন্তাবিদ, সুন্দর, সাবলীল ভাষার আলোচক, আমাদের প্রেরণার বাতিঘর, চেতনার সু-উচ্চ মিনার- হাফেজ মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী।

৫৬ বছরের বর্ণিল, ছন্দময় জীবনের অধিকারী আনসারী রাহি. প্রায়ই দুয়া করতেন- প্রভু, শুক্রবার দিনে যেন মৃত্যু হয়, মাহফিলে বলতেন- এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবণ। বাস্তবেই তা হলো। আশা নিয়ে বলা যায়- মহান আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেছেন। জগৎবাসীর মধ্যে তার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। গৃহবন্দীকালীন এ কঠিন সময়ে, সকালবেলায় অনুষ্ঠিত, অনাহুত জানাযায় মানুষজনের অকল্পনীয়, সাড়া-শব্দহীন উপস্থিতি তাই প্রমাণ করছে।

স্মৃতি যদি ভুল না করে, যুবায়ের আহমদ আনসারী- নামের সাথে শৈশব থেকে পরিচয়। যতদূর মনে পড়ছে দেশের শীর্ষ মুফাচ্ছিরে কোরআন মুহতারাম মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী সুপরিচিত হওয়ার পরেই ওয়াজের মাঠে বিশেষত কওমি অঙ্গনে তাঁর সরব পদচারণা এবং পরিপক্কতা।

তখন প্রাইমারি স্কুলে ছিলাম। আমাদের বাড়ির একেবারে পাশে মাদরাসা, আর আব্বাজান রাহি. ধার্মিক-পরহেজগার ছিলেন, উলামায়ে কেরামকে ভালোবাসতেন, তাঁদের কাছে যেতেন, বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সম্ভবত, এসব কারণে ছোটকাল থেকে আলেম, মাদরাসা ছাত্রদের প্রতি অনেকটা দুর্বলতা কাজ করতো। এ সুবাদে প্রায়দিন বিকেলবেলা খেলাধুলায় না গিয়ে মাদরাসা ছাত্রদের সাথে মিশে সময় কাটাতাম।

এতে আব্বাজানেরও সন্তুষ্টি থাকতো। তখন এ নামটি নিয়ে আলোচনা শুনতাম। পরবর্তীতে আমাদের ওই মাদরাসার মাহফিলে একবার মুহতারাম আনসারী আসলে আব্বাজান আমাদের ঘরে তাঁর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। আব্বাজান আমার মাথায় হাত মাখিয়ে দুয়া দিতে অনুরোধ করেন। তিনি আমাকে নাম জিজ্ঞেস করেন, নাম শুনে আরোও খুশি হয়ে দুয়া দেন। আমাদের বাড়িতে অবস্থানকালে তাঁর হাস্যরসময় আলাপচারিতার হাসিমাখা চেহারাখানা আজও চোখে ভাসছে। সেই প্রথম দেখা থেকে শুরু করে বহুবার তাঁকে দেখেছি। পরবর্তীতে স্কুল ছেড়ে মাদসারায় চলে আসি। ফলে মাহফিলে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। আশেপাশে মাহফিল হলে সহপাঠীরা একসাথে দল বেঁধে যেতাম, প্রাণভরে তাঁর হাসি আর কান্নামাখা বয়ান শুনতাম। সবাই জটলা বেঁধে বসতাম, মাঝেমধ্যে তাকবির ধ্বনি জুড়ে দিতে ভুল করতাম না।

সদালাপী, নিরহংকারী, সকলের প্রিয় আনসারী রাহি. নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক পর্যন্ত ওয়াজ-মাহফিল কেন্দ্রিক দাওয়াতি কার্যক্রমে দুর্বার গতিতে পথ চলেছেন। অজস্র-অগণিত মানুষকে সুপথ দেখিয়েছেন। ঈমানি শক্তি, চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন। দেশ-বিদেশে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করে নায়েবে নবির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী নসিহত যে কারোও হৃদয়কে আন্দোলিত করতো, তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতো।

পূন্যের নামে ওরস, গান-বাজনা, ইত্যাদি মনগড়া ইবাদত বিদূরিত করতে তাঁর প্রজ্ঞাসুলভ যুক্তি, কৌশলপূর্ণ কথামালা কার্যকর ভূমিকা রাখতো। আবার স্বার্থান্বেষী, পকেটলোভীরা তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠতো। দিকভ্রান্ত কিছু লোকেরা সর্বদা তাঁর পিছু লেগে থাকতো। মাঝেমধ্যে তিনি বিরুদ্ধাচারণকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু পিছপা না হয়ে উদারতা আর ভালবাসা দিয়ে ভুলপথে থাকা ওই ভাইদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর ওপর এবং যুবক তরুণদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা তাঁর আলোচনার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল। পরিবার ও সমাজে সহজ হয়ে পড়া পাপকর্ম, অনৈসলামিক কার্যক্রম ও যাবতীয় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খুবই বলিষ্ঠ, সোচ্চার। মানুষের প্রতি কোনোপ্রকার ভয়ভীতি তার মাঝে কাজ করতো না।

তার তেজস্বী কন্ঠ সমাজের অত্যাচারী-প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে ভাবনায় ফেলে দিতো। তার মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াতে শ্রোতারা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলতো। তাঁর অনলবর্ষী বক্তৃতা মাহফিলে পিনপতন নীরবতা এনে দিতো। হঠাৎ তাঁর রসময়, সকৌতুক কথাবার্তা মানুষজনের তন্দ্রাভাব দূর করে চেতনা ফিরিয়ে দিতো।

কথার জাদুকর আনসারী রাহি. 'র কন্ঠে কোরআনের আলোচনা শুনতে মানুষজন পায়ে হেটে কয়েক মাইল দূরে যেতেও ক্লান্তি বোধ করতেন না। মাহফিলে গভীর রাত পর্যন্ত সর্বস্তরের লোকজন তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতেন। তিনিও বিনিদ্রভাবে মাহফিল থেকে মাহফিলে ছুটে চলতেন।

২০১৪ ঈসায়ি সাল থেকে অসুস্থতা তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি বিরত থাকেননি, তাঁর অদম্য দাওয়াতি মিশন থেকে। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর অসুস্থতা আর চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞা সাথে নিয়েও তিনি কোরআনের পাখি হয়ে গান গেয়েছেন। তাফসির করেছেন। আমৃত্যু সকলের হৃদয়-মন তৃপ্ত করেছেন।

২০১৬ ঈসায়ি সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যান, একাধিকবার অস্ত্রোপচার হয়। কন্ঠ অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায়, আওয়াজ নীচু হয়ে যায়, শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। তবু থামেননি। প্রিয়জনদের ভালোবাসার আবদার রক্ষার্থে কোথাও কোথাও মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার সদয় সম্মতি দিয়ে দিতেন।

ভক্তরা তার আগমনের সংবাদ শুনলে একনজর তাঁকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে উপস্থিত হতেন। চিরচেনা সে চেহারাটা দেখামাত্র সকলেই আবেগাপ্লুত হয়ে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন।

মহান হৃদয় ও সুললিত কন্ঠের অধিকারী, ইসলামের নন্দিত ভাষ্যকার, আনসারী রাহি. কোরআন-হাদিসের জ্ঞান বিতরণ করে করে জীবনভর মানুষজনকে আলোকিত করেছেন। নিজের যোগ্যতা ও ত্যাগ তিতিক্ষায় ইসলাম প্রিয় কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন।

বরেণ্য আলেম, ধর্মচিন্তক, ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক, সমাজসেবক, মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের জীবনের ওপর এক বর্ণাঢ্য অধ্যায় রচনা করে গেছেন আনসারী রাহি.।

ছোট্ট কথায় বলা যায়- বিভিন্ন অপসংস্কৃতির মোকাবেলায় ওয়াজ-মাহফিলকে দেশের সর্বত্র সহজভাবে ছড়িয়ে দিতে তিনি পথিকৃৎ এর ভূমিকা পালন করেছেন। কোটি হৃদয়ে তিনি অমর, ভাস্বর হয়ে থাকবেন।দেশবাসী যুগ যুগ ধরে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে তাঁকে স্মরণ করবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ