শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

সমাজিক নিরাপত্তায় ইসলামের নির্দেশনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।

মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। সমাজ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। পৃথিবী নামক গ্রহটিতে বেঁচে থাকতে সমাজের প্রয়োজন পড়ে। ঘুম থেকে উঠার পরপরই শুরু হয় সমাজ জীবনের যাত্রা।  জীবনের প্রয়োজনে মানুষ মানু্ষের মুখাপেক্ষী হয়। সমাজ জীবনের পারস্পরিক আদান-প্রদান থেকে মানুষ বেরুতে পারে না। মানুষের জীবনে তাই সমাজের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

সমাজ জীবনের এই প্রয়োজনীয়তায় শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্ন অনেক গুরত্বপূর্ণ। জীবনে বেঁচে থাকার এ অংশটিতে শান্তি -নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে জীবন বিষিয়ে উঠে। জন-জীবন ভুগে অশান্তিতে । একটা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়।

ইসলাম সমাজ জীবনের এ প্রয়োজনীয়তাকে গুরত্বের চোখে দেখেছে। সমাজের শান্তি ও নিরিপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করতে এসব অনুসরণের বিকল্প নেই। আমরা এখানে কয়েকটি নির্দেশনা নিয়ে একটু আলোচনা করব।

পারস্পরিক কল্যাণ কামনা: মানুষের পারস্পরিক নিরাপত্তা বিধানে একে অপরের কল্যাণকামী হওয়া। এর মাধ্যমে মানুষ একে অন্যের ক্ষতি থেকে সহজেই বাঁচতে পারে। নিজের জন্য মানুষ যা পছন্দ করে,সেটুকু অন্যের জন্য করতে পারলে তার কল্যাণ কামনা হবে। নিজের জন্য যা অপছন্দ করে, অপর ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করার নাম কল্যাণ কামনা। নিজে যেই ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে, অপর ভাইকে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচানোর চেষ্টাও কল্যাণ কামনার অন্তর্ভূক্ত।

ইসলাম অন্যের কল্যাণ কামনার প্রতি খুব উৎসাহ দিয়েছে। প্রিয় নবীজি সা. ইরশাদ করেছেন, কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য (বা প্রতিবেশির জন্য) তা ভালোবাসে, যা সে নিজের জন্য ভালোবাসে। (বুখারি:১৩, মুসলিমঃ৪৫,তিরমীযি,২৬৮৪নাসাই ৮/১১৪,ইবনে মাজাহ:৬৬)

সামজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে, সমাজের মানুষজনের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতাও অনেক গুরত্বপূর্ণ একটা বিষয়। শুধু তাই না, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী পারস্পরিক এই ভালোবাসা মু'মিন হওয়ার নিদর্শন৷ রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন,
তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা (পরিপূর্ণ) মু'মিন হও। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত (পরিপূর্ণ) মু'মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। (মুসলিম, ৫৪ আবুদাউদ, ৫১৯৩, তিরমীযি, ২৮৮৩,,মুসনাদে আহমদ,৯৭০৯, ইবনে হিব্বান, ২৩৬, ইবনে মাজাহ,৬৮)

পরনিন্দা থেকে বাঁচা: পরনিন্দা বা অন্যের অগোচরে তার দোষচর্চা খু্বই ন্যাক্কারজনক। মানুষ যে বিষয়টা অন্যের সামনে প্রকাশ হওয়াটাকে অপছন্দ করে সে বিষয়টা নিয়ে তার চোখের আড়ালে চর্চা করাই গীবত বা পরনিন্দা। এমনকি ব্যক্তির মাঝে তা বিদ্যমান থাকলেও দোষ চর্চা করা যাবে না। আর না থাকলে তো এটা তার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ হবে।

আবু হুরায়রা রা থেকে বর্ণিত, রাসূল সা কে প্রশ্নকরা হলো গীবত কিভাবে হয়? তুমি তোমার ভাই যে বিষয় ( অন্যের সামনে প্রকাশ হওয়াটাকে) অপছন্দ করে, (তার অগোচরে) সেটা নিয়ে আলোচনা করাটাই গীবত। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, যদি ব্যক্তির মাঝে তা বিদ্যমান থাকে? তখন রাসূল সা বললেন, বিদ্যমান থাকলেই তো গিবত৷ আর না থাকলে তা অপবাদ হবে।

কুরআনে গীবতের খুব নিন্দা করা হয়েছে। এমনকি এটাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার ইরশাদ করেন, একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো এটাকে (মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া) ঘৃণার বিষয় মনে কর। (হুজুরাত:১২)

অন্যের ব্যাপারে মন্দ ধারণা থেকে বাঁচা: শুধু অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা অনেক বড়ো অন্যায়। ধারণা কখনো নিশ্চয়তা বহন করতে পারে না। পবিত্র কুরআনের ইরশাদ, (বাস্তবে)সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। (ইউনূস:৩৬)

কোন ধারণার ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। তাই কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা করা সমীচীন না। একজনের প্রতি মন্দ ধারণায় ব্যক্তির প্রতি অযথা ঘৃণা জন্ম নেয়, যা পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনষ্ট করে৷ কুরআনুল কারিমে, অন্যের ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণের ব্যাপারে কঠোর নিষেধ রয়েছে। এবং মন্দ ধারণায় কখনো-সখনো গোনাহ হয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে। ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাকো। কারণ, অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ। (হুজুরাত:১২)

হাদিসে কারো ব্যাপারে (মন্দ) ধারনা পোষণ করাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তোমরা কারো ব্যাপারে (মন্দ) ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ (মন্দ) ধারণা পোষণ সবচে বড় মিথ্যা কথার নামান্তর। (তিরমীযি:২০৭)

তবে হ্যাঁ! একজনের ব্যাপারে সুধারণা রাখতে বাধা নেই। এবং তা ইসলামে কাম্যও।

মানুষের দোষে না পড়া: নবী রাসূল ছাড়া অন্য কোন মানুষই ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। ব্যাক্তি যতই ধার্মিক হোক, তার কিছু ভুলচুক হতেই পারে। প্রত্যেক মানুষেরই ভুল-ত্রুটি থাকে, কোন মানুষই ভুলের উপরে না। এবং মানব প্রকৃতি অনুসারে এটাই স্বাভাবিক। তাই অন্যের দোষের পিছু পড়া কোনভাবেই উচিত না। আল কুরআনে কঠোরভাবে এ ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে,
তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না।(হুজুরাত:১২)

যতদূর সম্ভব অন্যের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখুন। এতে আপনারই লাভ। দু'জাহানে আপনার দোষগুলো ঢাকা পড়বে৷
হাদিসের ইরশাদ, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার মুসলিম ভাইয়ের কোন দোষ ঢেকে রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাত উভয়জগতে তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (তিরমীযি: ১৮৪)

হিংসা থেকে বাঁচা: হিংসা এক জ্বলন্ত আগুন৷ যা হিংসুকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। হিংসার মাধ্যমে যার ব্যাপারে হিংসা করা হচ্ছে তার (সাময়িক কষ্ট হলেও)কোন ক্ষতি হয় না; বরং হিংসুকের উল্টো ক্ষতি হয়। হাদিসে হিংসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে,

তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে একে অপর থেকে দূরে সরে যেয়ো না, পরস্পরে হিংসা-বিদ্ধেষ করো না৷ তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই হিসেবে থাকো।

অন্যকে উপহাস না করা: কাউকে উপহাস করা মারাত্মক অন্যায়। উপহাসের মাধ্যমে অনেক সময় ব্যক্তি মানুষের চোখে খাটো হয়। ব্যক্তির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তের মতোই ভয়ংকর উপহাস। ইসলাম উপহাসের ব্যাপারে কড়া নিষেধ করেছে। কুরআন মজীদের ইরশাদ, হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে;কেননা যাকে উপহাস করা হয়ে সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেনো উপহাস না করে। কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। (হুজুরাত :১১)

হ্যাঁ! ইসলাম আপনাকে এমন উপহাসের অনুমতি দিয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যক্তি খাটো হয় না। বরং তা হয় নিরঙ্কুশ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। রাসূল সা. এ ধরণের উপহাস করতেনও। আনাস রা থেকে বর্ণিত, 'রাসূল সা আমাদের সাথে মিশতেন (এবং সে সুবাদে আমাদের পরিবারে তার আসা যাওয়া হতো)। আমার একটা ছোট্ট ভাই ছিল।(তার ছোট্টমণি একটা পাখি ছিল।) তিনি তাকে উপহাস করে বলতেন, ইয়া আবা উমাইর!মা ফাআলান নুগাইর? (আবু উমাইর! তোমার ছোট্টমণি পাখিটা কেমন আছে?) (তিরমীযি:২০৯)।

হযরত আবু হুরায়রা রা একদিন নবীজি সা. এর দরবারে এলেন৷ হঠাৎ তার আস্তিন থেকে একটি বিড়ালছানা বের হল। তখন নবীজি সা. তাকে উপহাস করে "আবু হুরায়রা" বলে সম্বোধন করলেন৷ এরপর থেকে তিনি তা নিজের নাম হিসেবে পছন্দ করেন, এবং এটা তার প্রসিদ্ধ নাম হয়ে যায়।

ঝগড়া না বাঁধানো: ঝগড়া কতোটা ভয়ংকর কাজ তা খুলে বলার প্রয়োজন নেই। এর মাধ্যমে ঝগড়াকারীরা সমাজের চোখে সহজেই নিঁচু হতে থাকে। মূলত: ঝগড়া রাগের চোরাপথ বেয়ে আসে। রাগ করা মানে হেরে যাওয়া। কুরআন রাগ না করার প্রতি খুব করে উধবোদ্ধ করেছে। এবং একে মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেছে। সূরা আল ইমরানে মুমিনের বৈশিষ্ট্যর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করা হচ্ছে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি দয়াশীল;আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।'(আল ইমরান-১৩৪)

ঝগড়া কখনো-সখনো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নিজেকে তখন সংবরণ করতে হবে। উচ্চারণ -আচরণ সবই তখন সংযত রাখা উচিত। ঝগড়ার তীব্রতায় অনেকসময় গালমন্দের অবস্থার সৃষ্টি হয়। এটা খুবই নীচুতা। ঝগড়ার সময় গালমন্দের ব্যাপারে হাদিসে কঠোর ধমকি এসেছে।এমনকি একে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসের ইরশাদ, যার মাঝে চারটি বিষয় পাওয়া যাবে, সে খালেস মুনাফিক....(তার মধ্যে একটি হল)যখন ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তখন সে গালমন্দ করে। (বুখারী, ১/১০, মুসলিম, মিশকাত:১৭)

তাছাড়া একজন মুসলমানকে গালি দেওয়া এমনিতেই গোনাহের কাজ। হাদিসের ইরশাদ," মুসলমানকে গালি দেওয়া গোনাহের কাজ। আর তাকে হত্যা করা কুফুরীর নামান্তর।'(ফাতহুল বারী: ১/১৩৮)

এসব নির্দেশনা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। ইসলামি সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য৷ পশ্চিমারা তাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হলেও, ওই সভ্যতায় এসব বিষয়ের সংকট রয়েছে।

পশ্চিমা সমাজে পরনিন্দা, অন্যের দোষের পিছনে পড়া ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়ের বিস্তার খুব বেশি। দুঃখজনক ব্যাপার হল, উপরের নির্দেশনাগুলো ইসলামি সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্য হওয়া সত্ত্বেও, আমরা এসব বিষয়ে অবহেলা করি।

প্রিয় পাঠক! আসুন, আমরা ইসলামের এই সুন্দর নির্দেশনাগুলোর প্রতি গুরত্বারোপ করি। এ বিষয়গুলো অনেক কঠিন ব্যাপার তা না। একটু সতর্ক হলেই, ইসলামের কালজয়ী নির্দেশনাগুলো মানা সহজ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের সবাইকে মানার তাওফিক দিন। আমিন!

লেখক: তাকমিল, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া, মুহাম্মপুর, ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ