শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

করোনা ভাইরাসের মহামারীতে মুমিনের করণীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ জাবের হোসাইন।।

কুরআন, হাদিস ও ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায়, মহান আল্লাহ যখনই কোনো জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠির নাফরমানীর কারণে তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তখনই তাদের উপর আসমানী-যমিনী, জানা-অজানা বিভিন্ন ধরনের আযাব-গযব, ভাইরাস, রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত ও মহামারিতে আক্রান্ত করেছেন। যেমন- হজরত নূহ আ. এর সম্প্রদায়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মহাপ্লাবন দিয়েছেন। (সূরা হূদ: ৪৪)

হজরত হূদ আ. এর সম্প্রদায়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে প্রবল বেগে ঝড়-তুফান-বাতাস দিয়েছেন। (সূরা যারিয়াত: ৪১) হজরত সালিহ আ. এর সম্প্রদায়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে বিকট আওয়াজ ও বজ্রাঘাত দিয়েছেন। (সূরা যারিয়াত: ৪৪)

হজরত লূত আ. এর সম্প্রদায়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে জনপদকে উল্টিয়ে উপর-নিচ করে দিয়েছেন, উপরন্তু প্রস্তর কংকর বর্ষণ করেছেন। (সূরা হিজর:৭৪) হজরত মূসা আ. এর সম্প্রদায়ের সামিরী নামক এক ব্যক্তিকে জ্বরাক্রান্ত করেছেন। তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যাক্তিও জ্বরাক্রান্ত হতেন। (সূরা ত্বহা: ৯৭)

পৃথিবীতে যখন আল্লাহ তা’আলার নাফরমানি সীমাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন দূর্যোগ-মহামারি দ্বারা তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বর্তমান করোনা ভাইরাস মহান আল্লাহ অসন্তুষ্টির নিদর্শন। সুতরাং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে মু’মিনের করনীয়।

এক. খাঁটি-বিশুদ্ধ তওবা করা: অতীত গুনাহের উপর লজ্জিত হওয়া। চলমান গুনাহ ছেড়ে দেয়া। ভবিষ্যতে গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। কারও হক নষ্ট করলে তা আদায় করা কিংবা ক্ষমা চেয়ে নেয়া। সূরা তাহরীম-৮

দুই. গুনাহ বর্জন করা: যিনা-ব্যাভিচার, দূর্নীতি, বেপর্দা-অশ্লীলতা, সুদ-ঘুষ, জুয়া, কালোবাজারি, সিন্ডিকেট, মজুদদারী-মাপে কম দেয়া, মিথ্যা-ধোকা-প্রতারনা, নেশা-মাদক, চুরি-ডাকাতি, মাতা-পিতার অবাধ্যতা, গুম-খুন, অসৎ-অযোগ্য নেতৃত্ব, নাচ-গান-বাদ্য, মসজিদে হৈ-চৈসহ প্রভৃতি গুনাহ বর্জন করা। সূরা শূরা-৩০

তিন. অধিকহারে দান-সদকা করা : রাসূল সা. বলেছেন, দান-সদকা মহান আল্লাহর ক্রোধকে ঠান্ডা করে দেয় এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৬৬৪

চার. রোনাজারি করে ইস্তিগফার-ক্ষমা প্রার্থনা করা : ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনারত বান্দাদেরকে আল্লাহ আযাব দিবেন না। সূরা আনফাল-৩৩

ইস্তিগফারের শব্দ : أَسْتَغْفِرُ اللهَ [আস্তাগফিরুল্লাহ] [আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৯১

أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ، وَأَتُوبُ إِلَيْهِ উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযী লা-ইলাহা, ইল্লা হুওয়াল, হায়ি্যুল কাইঊমু, ওয়া আতূবু ইলাইহি।

অর্থ: আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তিনি ছাড়া ইবাদাতের উপযুক্ত আর কোনো মাবূদ নাই। তিনি চিরঞ্জীব সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। আমি তাঁর নিকটই তওবা করছি। সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং-১৫১৭

পাঁচ. চোখের পানি ফেলে দোয়া-প্রার্থনা করা : যারা আল্লাহর নিকট দোয়া-প্রার্থনা করবে না, আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন। সূরা গাফির-৬০

কিছু দোয়া: ১। হযরত আইউব আ. কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে এই শব্দে দোয়া করেছেন। رَبِّيْ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ উচ্চারণ: রাব্বি আন্নী মাছ্ছানিয়াদ্দুররু ওয়া আন্তা আরহামুর রাহিমীন।

অর্থ: আয় আল্লাহ! আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছি, আপনি আমার উপর রহম করুন আপনি দয়াবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়াবান। সূরা আম্বিয়া-৮৩

২। হযরত ইউনূস আ. কঠিন বিপদে আক্রান্ত হয়ে এই শব্দে দোয়া করেছেন। لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ উচ্চারণ: লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা ছুব্হানাকা ইন্নী কুন্তু মিনায্ যালিমীন

অর্থ: আয় আল্লাহ! আপনি ছাড়া ইবাদাতের উপযুক্ত আর কোনো মাবূদ নাই। আপনি পবিত্র, নিশ্চয় আমি গুনাহগার। সূরা আম্বিয়া-৮৭

৩। কুরআনের এক আয়াতে মহামারি-আযাব-গযব থেকে পরিত্রাণের জন্য এই শব্দে দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। رَبَّنَا اكْشِفْ عَنَّا الْعَذَابَ إِنَّا مُؤْمِنُونَ উচ্চারণ: রাব্বানাকশিফ আ‘ন্নাল আ‘যাবা ইন্না মু’মিনূন

অর্থ: আয় আল্লাহ! আমাদের থেকে আযাব-গযবকে সরিয়ে দেন, নিশ্চয় আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি। সূরা দুখান-১২

৪। রাসূল সা. যাবতীয় রোগ-ব্যাধি ও মহামারি থেকে মুক্তির জন্য এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন।্রاللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ البَرَصِ، وَالْجُنُونِ، وَالْجُذَامِ، وَمِنْ سَيِّئِ الْأَسْقَامِ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল বারাছি, ওয়াল জুনূনি, ওয়াল জুযামি, ওয়া মিন ছায়্যিইল আছকামি
অর্থ: আয় আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই শ্বেত রোগ থেকে। পাগলামি থেকে। কুষ্ঠ রোগ থেকে এবং সবধরনের কঠিন রোগ থেকে। সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং-১৫৫৪

দোয়া-ইস্তিগফার কবুলের শ্রেষ্ঠতম সময়: এক. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে : সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১১৪৫। দুই. পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর : সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩৪৯৯। তিন. জুমার দিন খতীব খুতবার জন্য মিম্বরে উঠার পর থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৮৫৩

চার. জুমার দিন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত: সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৪৮৯ ছয়. ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা : মহান আল্লাহ বলেন, [বিপদ-আপদ, দুর্যোগ-মহামারিতে] তোমরা ধৈর্য এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। সূরা বাকারা-১৫৩

রাসূল সা. ইরশাদ করেন : যে সালাত আদায় করে, সে মহান আল্লাহ নিরাপত্তায় থাকে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৫৭

সাত. কুরআন তিলাওয়াত করা : মহান আল্লাহ বলেন, কুরআন মু’মিনের জন্য সুচিকিৎসা এবং রহমত। সূরা ইসরা-৮২।

আট. কুনূতে নাযিলা পড়া : ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকাতে রুকূ থেকে উঠে হাদীসে বর্ণিত দোয়া পাঠ করা।
আল মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুওয়াইতিয়্যাহ, ৩৪/৬৬ হাদীসে বর্ণিত দোয়া : للَّهُمَّ اهْدِنِي فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِي فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنِي شَرَّ مَا قَضَيْتَ، فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلَا يُقْضَى عَلَيْكَ، وَإِنَّهُ لَا يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ

আয় আল্লাহ! আপনি যাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন, আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আপনি যাদেরকে নিরাপদে রেখেছেন, আমাকে তাদের দলভুক্ত করুন। আপনি যাদের অভিভাকত্ব গ্রহণ করেছেন, আমাকে তাদের দলভুক্ত করুন। আপনি আমাকে যা দান করেছেন, তাতে বরকত দান করুন। আপনি যে অনিষ্টতা নির্দিষ্ট করেছেন, তা হতে আমাকে রক্ষা করুন। কেননা, আপনিইতো সকলের ভাগ্য নির্ধারণকারী, আপনার উপর কেউ ভাগ্য নির্ধারণকারী নেই। আপনি যার অভিভাকত্ব গ্রহণ করেছেন, সে কোনো দিন অপমানিত হবেনা। আয় আল্লাহ! আপনি বরকতপূর্ণ ও সুমহান। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৪৬৪

নয়. সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা : রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা মহামারিতে আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করিওনা এবং যারা আক্রান্ত এলাকায় থাকবে তারা যেন সেখান থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে অন্যত্র চলে না যায়। সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৭৩।

দশ. চিকিৎসা গ্রহণ করা : সাস্থ্য বিজ্ঞান শরীয়ত সম্মত যেসব চিকিৎসা ও নিয়মাবলি প্রদান করে তা গ্রহণ করা। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২২০৪।

এগার. সদা-সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা : মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা যেখানেই থাকনা কেন, মৃত্যু তোমদেরকে আলিঙ্গন করবেই। এমনকি তোমরা যদি সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরেও আশ্রয় গ্রণ কর না কেন। সূরা নিসা-৭৮।

লেখক: জামিয়া কারীমিয়া আরাবিয়া রামপুরার দারুল ইফতার মুশরিফ, ইষ্টার্ণ বনকুঞ্জ-২ মসজিদ, বনশ্রীর ইমাম ও খতীব।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ