আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এউপলক্ষে জাতীয় ইতিহাসবেত্তা, বর্ষিয়ান সাহিত্যিক, বাংলা সাহিতের খাতিমান ইতিহাসবিদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাষা গবেষক, বহুগ্রন্থপ্রণেতা তরফরত্ন সৈয়দ আবদুল্লাহর মুখোমুখি হয়েছিল আবরার আবদুল্লাহ। বর্ষিয়ান এই পণ্ডিত গবেষক বাংলা ভাষার ইতিহাস পঠন -পাঠন ব্যবহারসহ নানান বিষয়ে সার্রগর্ভ মতামত ও তথ্য প্রদান করেন।
স্যার আজ মহান মাতৃভাষা দিবস। একজন ইতিহাসবিদ হিসাবে আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি?
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মধুরতম ভাষা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আজ মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। আজকের ভোর রাত্রির বৃন্ত থেকে ছিনিয়ে এনেছে এক আলো ঝলমলে সকাল। যার স্পর্শে বাঙালি চেতনা শানিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
একুশের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি ঐতিহ্য আর বীরত্বগাথা। তবে এই মহান একুশ, মাতৃভাষা বাংলা আমরা এমনিতে পাইনি।
১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা মুখের ভাষা, মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রঞ্জিত করেছিল রাজপথ, দিয়েছিল প্রাণ বলিদান। পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সেদিন রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ এ দেশের দামাল ছেলেরা ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে জীবন উৎসর্গ করে।
আজকেে দিনে সেসব মহান বাষা সৈনিক ও শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করছি। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জীবন ত্যাগের নজির আর নেই। তাই তো একুশ আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব।
মহান একুশ বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের। একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করতে, দাবি আদায় করে নিতে, ভাষা ও স্বদেশকে ভালোবাসতে। একুশের প্রেরণায় আমরা পেয়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধ।
শুধু আমাদের দেশে নয়, মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের ইতিহাস আজ বিশ্বদরবারেও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে।
এক সময় একুশের সকল প্রোগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহন করতাম। আজকের দিনে নানান অনুষ্টানে প্রবন্ধপাঠ ও আলেচনা সভায় বক্তৃতা করতাম। এখন বাধর্ক্য ও শারিরিক অসুস্থতার কারনে বাড়ি থেকে তেমন বেড় হতে পারি নি। সাড়া দিন পড়া লেখা করেই কাটাই।
স্যার ভাষা আন্দোলনে আপনার পরিবারের ঐতিহাসিক অবদান আছে। সে সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি?
আমাদের পরিবারের অনেক মনীষাই সরাসরি ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ারও আগে ১৯৪৭ সালের ৩০ নবেম্বর অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তিন মাস সময়ও যায়নি, আমাদের পরিবারের কৃতি মনীষা বহুভাষাবিদ পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের এক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রক্ষণশীল লোকজন সে সময় তাঁকে হয়রানি করেছিল ও হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। কিন্তু অদম্য মুজতবা দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে সাহসিকতার সঙ্গে যুক্তি সহকারে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছিলেন এবং নিজ দাবি পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। সেটা ছিল এক বিস্ফোরণোন্মুখ সময়। আন্দোলন তখন দানা বাঁধছিল এবং স্থানীয় ছাত্ররা তাতে জড়িয়ে পড়ছিল।
গোড়া থেকেই শহরের রক্ষণশীল মহল তাঁর নিয়োগকে সুনজরে নেয়নি। তারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তে নেমে পড়ে। কলেজ স্মারকে বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রবন্ধ লিখার অপরাধে তার বিরোদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়।
কলেজে যোগ দেয়ার সাত মাস যেতে না যেতেই মুজতবা আলী চাকুরিচ্যুত হন এবং তার উপর গ্রেপ্তারি ফরোওয়ানা জাড়ি করা হয়। মুজতবা আলীর বড় দুই ভাই জাতিয় ইতিহাসবেত্তা স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সৈয়দ মুর্তাজা আলী, সাংবাদিক মুস্তফা আলী ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন।
তার ভাতিজা তক্ষিন পর্র্ব এশিয়ার বিখ্যাত সাংবাদিক ডেইলি ষ্টারের প্রতিষ্টাতা সম্পাদক এস এম আলীও ভাষা সৈনিক ছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ইউনোস্ক কতৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে তিনিই প্রথম কাজ করেন এবং আবেদন জমাদেন আমাদের পরিবারের কৃতি সন্তান বর্তমান ভারতের হাই কমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জম আলী।
১৯৯৯সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারে সময়ে এই বরেন্য কূঠনৈতিক জাতিসংঘ স্থায়ী কমিটিতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন।
বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে যানতে চাচ্ছি?
বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। আমিতো বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাসে লিখেছি, আদম আ. প্রপৌত্র নুহ আ. যাকে দ্বিতীয় আদম বলা হয়ে থাকে। নবী নুহ এর এক পুত্রের নাম ছিল হাম।
হাম পৃথিবীর দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। হামের পুত্রের নাম হিন্দ। যার নাম অনুসরণে হিন্দুুস্থানের পরিচিতি। হিন্দের ২য় পুত্র বঙ্গ এর নাম করণেই বঙ্গ ও বাংলার প্রচলন ঘটে।
বাংলা ভাষার একাধিক লিপি ব্যাবহার পৃথিবীর প্রচীনতম ভাষার সাথে মিল খোঁজে পাওয়া যায়।
অনেকে বলেন, বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে ‘সংস্কৃত’ ভাষা থেকে। কারও মতে ‘প্রাচীন প্রাকৃত’, কারও মতে ‘গৌড়ি প্রাকৃত’ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম।
মহান ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহাম্মদ শহীদউল্লাহর মতে ‘গৌড়ি প্রাকৃত’ থেকেই নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উত্পত্তি ও বিকাশ লাভ ঘটেছে।
অনেকের ধারণা আর্য-ব্রাহ্মণবাদী গুপ্ত যুগের অবসান শেষে বৌদ্ধ পাল রাজাদের রাজত্বকালের শুরুতেই অথবা তার কিছু পূর্বে বাংলা ভাষার পূর্ববর্তী স্তর অপভ্রংশের উত্পত্তি।
আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো ভাষার নাম ‘প্রাচীন প্রাকৃত’। কালক্রমে ‘প্রাচীন প্রাকৃত’ অভিহিত হয় ‘আধুনিক প্রাকৃত’রূপে। আধুনিক প্রাকৃত ভাষা থেকে শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে ‘গৌড়ী প্রাকৃত’, ‘মাগধী প্রাকৃত’ ইত্যাদি নামে আরো কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়।
কালের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষার আরো পরিবর্তন ঘটে যায় এবং নাম হয় অপভ্রংশ। এই অপভ্রংশ থেকে জন্মলাভ করে আসামের ‘অহমিয়া’ ভাষা, উড়িষ্যার ‘উড়িয়া’ ভাষা, ভারতের ‘হিন্দী’ ভাষা এবং এতদাঞ্চলের ‘বাংলা’ ভাষা ইত্যাদি।
মনে হয় প্রাচীনকালের কোন ভাষার সংস্কার করেই ‘সংস্কৃত’ নাম রাখা হয়েছে। কেননা, যা সংস্কার করা হয় সেটাই সংস্কৃত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীন প্রাকৃত বা আধুনিক প্রাকৃত জনগণের মুখের ভাষা। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা কখনও জনগণের মুখের ভাষা ছিল না। এখনও জনগণের মুখের ভাষা নয়। এটা হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা।
ব্রাহ্মণ-ভট্টাচার্য ছাড়া এ ভাষায় পণ্ডিত হবার কারও অধিকার ছিল না। হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজাদের যুগে বাংলা ভাষার উপর যে অত্যাচার হয়েছে তাতে বাংলা ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাংলাকে ধরে রেখেছিল, টিকিয়ে রেখেছিল।
পরবর্তীকালে ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন ঘোড়ু-সওয়ার নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার পর শুরু হলো বাংলায় মুসলিম শাসন।
তাতে মুক্ত হলো সংস্কৃতি, মুক্ত হলো ভাষা। এদেশের কর্মের সাথে, জীবনের সাথে জড়িত হলো বাংলা। বাঙালি মুসলমান বাংলার প্রতি পুরোদমে আকৃষ্ট হলো।
বাংলার পাঠান বাদশাগণ, আমীর-ওমরাহ এবং সাধারণ মানুষ বাংলার কদর করতে লাগলেনন। এভাবেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ।
স্যার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতির কথা অনেকে বলছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?
লক্ষণীয় বিষয় হলো, কিছু বামপন্থী ও সেক্যুলার শ্রেণীর ইতিহাসবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা কলাম লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত পরিপূর্ণভাবে উল্লেখ ও উপস্থাপনের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেন।
বস্তুতপক্ষে ভাষা-আন্দোলনের উৎপত্তি ও উৎসের ইতিহাসকে আজ মনে হয় অতি সচেতন ও সূক্ষ্মভাবেই খণ্ডিত করা হচ্ছে। সাধারণত বায়ান্ন’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে সালাম-রফিক-বরকত-জব্বারের গুলিবিদ্ধপূর্বক শহীদ হওয়া দিয়েই তারা লেখা শুরু করেন।
প্রশ্ন হলো, বায়ান্ন’তে যারা মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, যারা পাক হানাদারের বুলেটবৃষ্টির মুখে শহীদ হলেন—সেদিন তাদের ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিল কোন সংগঠন? এবং কারা?
একসময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষা আন্দোলনে অবদান ও ভাষার জন কারাগার করণকে অনেকে এড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস লিখেছেন রাজনৈতিক কায়দায় । এটা অন্যায় কাজ।
তেমনিভাবে আজ অনেকে তমদ্দুনে মজলিসসহ ভাষা আন্দোলনের অনেক নায়কদের এড়িয়ে খন্ডিত ইতিহাস চর্চা করেন। ইতিহিসকে ইতিহাসের মতো করেই আমাদের জাতিসত্তার বির্নিমানের জন্য চর্চা করা উচিত।
১৯৪৭ সালের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। কিভাবে হয়েছিল, কাদের মাধ্যমে বা কোন নেতৃত্বে বেগবান হয়েছিল তা আজ অনেকেরই অজানা। ভাষা আন্দোলনের ডামাডোলে আজ হারিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন তসদ্দুনে মজলিসের কথা।
ভাষার আন্দোলনের জনক খ্যাত প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের কথা। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মূখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের কথা। বায়ান্নর আন্দোলন থেকে হারিয়ে গেছেন মাওলানা ভাসানী ও তর্কাবাগিশরা।
অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, যে ৫২’তে যে সংগঠনটির মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে ওঠে সেই সংগঠনটি অর্থাৎ তমুদ্দন মজলিসের কথা সেকুলার সুশীলদের কথায়, লেখায় ও আলোচনায় গুরুত্ব পায় না।
সে কারণেই বর্তমান প্রজন্ম একুশে ফেব্রুয়ারির দিন পাক হানাদারের গুলিতে শহীদ হওয়া বরকত-রফিক-জব্বার-সালামের নাম জানলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মূল সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের নাম ও অবদানের ইতিহাস জানতে পারে না।
অনেকের কাছেই সম্ভবত অজানা, উপমহাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সর্বপ্রথম দাবি জানিয়েছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং তিনি ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত প্রস্তাব পেশ করেন।
সর্বপ্রথম মাওলানা আকরম খাঁ সংগ্রাম ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১৮৯৯ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সিলেবাসভুক্ত করা হয়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন৫২’র সর্বদলীয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন সেটা আজ অনোকেই বলতে চান না। পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন, ২১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদকারী মাওলানা তর্কাবাগিশ।
মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলায় প্রথম বক্তৃতা শুরু করেন।পশ্চিম পাকিস্তানি গণপরিষদ সদস্যরা নানা উপহাস করে এ সময় তর্কবাগীশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে।
কিন্তু উপহাস উপেক্ষা করেই তর্কবাগীশ বাংলায় বক্তব্য দেন। বাংলায় বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য ওই সময় আইনসভায় কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাওলানা তর্কবাগীশ বেশ কয়েকবার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়।
এরপূর্বে পাকিস্তান গনপরিষদের কোন সদস্য বাংলাতে বক্তৃতাকরেন নি। যারা অপরিসীম দরদ দেখিয়ে বাংলার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের হাটে মাঠে গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়াতেন এবং বাংলার জন্য সংগ্রামী হিসাবে খ্যাত ছিলেন এমন নেতারাও পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার সাহস পাননি ।
তেমনকি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা ফজলুল হক গণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে লজ্জাবোধ করেছেন। নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন।
পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাবিদ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ।
তিনি বলেন, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।”
সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন, উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন।
পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।
ইংরেজিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন।
এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি।
এভাবেই মহান ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে। আমি আশা করব ভাষা আন্দোলনের পুর্নাঙ্গ ইতিহাস চর্চা করবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। একুশকে বুকে ধারণ করে তারা দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও একুশের চেতনা লালন করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
আরএম/