রকিব মুহাম্মদ ।।
সম্প্রতি মাহফিলে স্টেজে ‘অশালীন’ মন্তব্য ও কুরুচিপূর্ণভাবে জুতা প্রদর্শন করায় সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছেন মাওলানা মো: মাসুদ ইবনে মুজিব ফারুকী নামের এক বক্তা। ওই মহাফিলে দেশের প্রখ্যাত ওয়ায়েজ মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকীকে নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জুতা প্রদর্শন করে হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় ধর্মীয় মহলে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মনে ওয়াজ মাহফিল সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্ম নিয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামের কথা হয় দেশের তরুণ তিন চিন্তক আলেমের সঙ্গে। এ ঘটনা নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
অনলাইন এক্টিভিটিস্ট ও লেখক মাওলানা রুহুল আমিন সাদী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বয়ানের মঞ্চে জুতো প্রদর্শন করেছেন একজন বক্তা। এবং কিছু শ্রোতা একে সাপোর্টও দিয়েছেন দেখা গেলো।
মাহফিলে যে বক্তা এরূপ করেন তিনি এই মঞ্চে উঠার উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলেন। তাকে আগে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিৎ। কারণ চিল্লাচিল্লি করা, প্রতিপক্ষের মুন্ডুপাত করা এক ধরনের মানসিক রোগ। সারাক্ষণ নিজেকে ভাইরাল করার ধান্ধায় থাকা খুবই মারাত্মক ব্যাধি।
আলোচ্য বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর পক্ষাবলম্বন করে অনেকেই মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গালাগালিতে অংশ নেন। একইভাবে অনেকে সিদ্দিকী সাহেবের পক্ষাবলম্বন করে জামায়াত ঘরানার বক্তাদের বিরুদ্ধে বলেন। সাধারণ মানুষ তা উপভোগ করে।
অথচ জানগণ টাকা পয়সা খরচ করে একটা মাহফিলের আয়োজন করে নসিহত শোনার জন্য। গালাগালি হুমকি ধামকি শোনার জন্য নয়। আমাদের বেওকুফির কারণে মাহফিলের ক্ষেত্রে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ আসে কি না আশংকা করছি।
আলেম সাংবাদিক ও খতিব মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেন, সম্প্রতি দেশের একজন বহুল আলোচিত জনপ্রিয় বক্তার আফশীআবিদেশ গমনকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর অনালোচিত অর্বাচীন বক্তার উন্মক্ত আবেগ আর লাগামহীন ক্ষুব্ধ বক্তব্য আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
একজন আলেম কিংবা শিক্ষিত মানুষ দেশের শ্রদ্ধেয় আলেমসমাজকে টার্গেট করে শুধু অনুমান ও অন্ধ আবেগের বশে এভাবে মাতাল ও মূর্খতাপূর্ণ বক্তব্য দিতে পারে তা অবিশ্বাস্য। এতে করে শুধু তাদের টার্গেট আলেমদের ইমেজের ক্ষতি হচ্ছে তাই না, বরং পুরো আলেমসমাজ যার মধ্যে তারাও আছেন, সর্বোপরি ইসলামের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
বস্তুত এসব বক্তব্য থেকে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুরা ছাড়া কেউ লাভবান হচ্ছে না। শত্রুরা উল্লসিত ও উপকৃত হচ্ছে। তারা এর সুযোগ নিয়ে ইসলামি মাহফিল তথা সার্বজনীন দাওয়াতের ময়দানের কণ্ঠরোধ ধরতে চাইছে। যা ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে ইসলামের এদেশীয় চেনা শত্রুদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে।
তাই আমি মনে করি, এসব অর্বাচীন বক্তাকে মাহফিলের শ্রোতা, আয়োজক ও আলেমসমাজের প্রত্যাখান করা উচিত। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের সম্পূর্ণ বয়কট করা উচিত। প্রতিবাদের উদ্দেশেও এসব শেয়ার করলে প্রকারান্তরে তাদের প্রসিদ্ধ করা হয়।
আর মৌলিকভাবে গত কিছুদিন ধরে দেখছি মাহফিলের সংখ্যা যত বাড়ছে, জাহেল বক্তার প্রকাশও ঘটছে তত বেশি। চারদিকে ওয়াজ হচ্ছে ঘরানাভিত্তিক। তাই ওয়াজও হচ্ছে ঘরানা বাঁচানো বা ঘরানা প্রতিষ্ঠার। ইসলামের নীতিমালার আলোকে এসব না ওয়াজ-নসিহত না দাওয়াত বা তাবলিগ। এসবের দ্বারা গ্রুপের ভক্তরা খুশি হয়, আল্লাহ খুশি হন না।
হাদিস বলছে, কিয়ামতের দিন জাহান্নাম উদ্বোধন হবে তিনশ্রেণীর স্পেশাল লোক দিয়ে। তাদের একদল এ ধরনের রিয়াকার হামবড়া আলেম-বক্তা। মাআযাল্লাহ। এসব বরং গজব ডেকে আনছে। এদের কারণে ইসলামের কাজ করার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে।
আমি মনে করি, মুত্তাকি দরদি আলেমদের এ নিয়ে কথা বলা দরকার। আমজনতাকে এসব আলেমে সু থেকে সতর্ক করা উচিত। মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও উত্তেজনা ও বিদ্বেষ না উস্কে দিয়ে গঠনমূলক ভাষায় এদের প্রতিহত করার ডাক দেওয়া উচিত।
তরুণ আলেম ও চিন্তক লেখক মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, এই ব্যাপারটি আমাদের জন্য ভীষণ রকম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার যে, চারদিকে আদব-শিষ্টাচার ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যৌক্তিক পন্থায় সুন্দরভাবে যে সমালোচনা করা যায় এটা আমরা ধীরেধীরে ভুলে যেতে বসেছি।
আলেমগণ হলেন সমাজের শিক্ষক। সাধারণ মানুষজন তাদের থেকেই আদব-কায়দা ও সভ্যতা-ভদ্রতা শেখার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছেই না, ধীরেধীরে বরং অনেক আলেমের মাধ্যমেই জনসাধারণ ও তরুণ-যুবকদের মধ্যে বেআদবি ছড়িয়ে পড়ছে।
একজন আলেম যখন দীনী কথা বলতে ওয়াজের স্টেজে ওঠেন তখন তিনি আসলে শুধু একজন ওয়ায়েজই নন; বরং একজন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তার দায়িত্ব তখন অনেক বেড়ে যায়। তার প্রতিটি কথা, বলার ভঙ্গি থেকে মানুষ শিখে।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সেসব কথা ও ভঙ্গি আবার ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। সেজন্যই বক্তাদের উচিত প্রতিটি কথা ভেবেচিন্তে মেপেমেপে বলা। দর্শক-শ্রোতার সামনে অন্যের গীবত-কটুবাক্য আর অশালীন শব্দ ব্যবহার পরিহার করা।
জুতা প্রদর্শের মত চূড়ান্ত পর্যায়ের বেআদবীমূলক কর্ম পরিহার করা। কারণ সাধারণ মানুষ যদি বেআদবি শিখে, তাহলে এর মন্দপ্রভাব একসময় বেআদবি শেখানো লোকদেরকেও আক্রান্ত করবে।
আরএম/