শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
তাপপ্রবাহ নিয়ে নতুন সংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ

আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.: স্মৃতিতে বিষ্ময় এক মহীরুহের গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আশিক আশরাফ ।।

আজকের গল্পটা একান্তই আমার। না, খানিকটা একজন বিস্ময়কর মনীষীকে নিয়েও। মিলিয়ে মিশিয়ে বলি গল্পটা? মনটা খুব খারাপ। খুব। মনটা পড়ে আছে ভেজা নেকড়ার মতো। মাঘ মাসের ১৫ তারিখ আমার জীবনে দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ট মানুষটি ঘুমিয়ে গেলেন। আমার স্বপ্নপুরুষের নাম আনোয়ার শাহ। এই নামেই ডাকতেন বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতহার আলী রহ. তাঁর আদরের সন্তানকে।

সন্তানের জনপ্রিয়তার কথা তিনিও জেনে গিয়েছিলেন। এখন সেটা সবাই জানে। কিন্তু বেঁচে থাকতে ভালো করে জানতে পারেনি। আমি বিশেষ কেউ নই তার জন্যে। কিন্তু সে আমার জন্যে বিশেষ ছিল। তাঁর প্রতি আমার মতো মোহগ্রস্ত মন আল্লাহপাক অবশ্যই সবার মধ্যে দেননি। আল্লাহর কাছ থেকে সে উপহার আমিই পেয়েছি।

আমি এই মানুষটার খুব গভীরে প্রবেশ করেছিলাম। সেই ভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু ঢুকে আর বেরোনোর রাস্তা পাইনি। এখন তিনি বের হওয়ার একমাত্র দরজার চাবি নিয়ে ইহজগত ছেড়ে চলে গেছেন। আমি এখন তাঁকে কোথায় খুঁজে বের করবো?!

আনোয়ার শাহ সাব হুজুরের দীর্ঘ সংস্পর্শ এটা আমার পক্ষে দুর্লভ সুযোগ ছিল। আমি বরাবরের মতোই আল্লাহর দেওয়া আমার এই জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ। এতো বড় কাজটা করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। একা একা এই সৌভাগ্য বহন করা খুব কষ্ট।

তবে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে, মানুষটা খুব দুঃখী ছিলেন। সেই ১৯৭১ থেকে লড়াই করে করে তিনি খানিকটা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন কি-না। অপরিণত বয়সে পিতাকে জেল থেকে মুক্তির জন্যে আইন আদালত করেছিলেন। বিধ্বস্ত মানুষটা শেষ জীবনে একলা হয়ে যাবেন, এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি তার কাছে গিয়েছি। আর এটাই আমার জীবনের আশ্চর্য অর্জন! আশ্চর্য প্রাপ্তি!!

তাঁর অন্তরদৃষ্টি ছিল খুব প্রখর। যে শক্তি-ই আমাকে ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল। আমার মাথার উপর থেকে কি যেন একটা ছায়া সরে গেল। আমি বুঝতেই পারছিলাম না অনেক্ষণ। আমার কে ছিলেন তিনি? যে এতো হাহাকার বোধ হচ্ছে! অমিতো তার কেউ ছিলাম না! কোনদিন না! তিনি আমার নিত্যদিনের কোনো মানুষও ছিলেন না। নাকি ছিলেন?

সাক্ষাৎপ্রত্যাশি ঘরের বারান্দায় যার সঙ্গে স্মৃতি, শুধু এই কারণেই কি আপন তিনি? তিনি আমার এতোটাই গভীরে অবস্থান করছেন যে, আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো; সুযোগ পেলেই পৃথিবীকে জানান দেবো আমার দেখা জীবনের পৃথিবীর শ্রেষ্ট মানুষ ছিলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি।

একটা গল্প বলি! খুব সম্ভবত, ২০০৬ অথবা ২০০৭-এর দিকে এক বিকেলে শহিদী মসজিদের সামনে আমাদের আশরাফিয়া লাইব্রেরিতে ক্বারী বাসেতের তেলাওয়াতের ক্যাসেট বাজাচ্ছিলাম। পাশের আতহারে নিয়ম করে বসেন আল্লামা আনোয়ার শাহ। দোকানের সামনে ছাত্রদের ভীড় লেগে আছে।

আশ্চর্যজনক ঘটনা! শাহসাব ছুটে চলে এলেন আমাদের দোকানে। আব্বা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বসতে ইঙ্গিত করে ভেতরে রাখা সাউন্ডবক্সের কাছে বসে চোখ বন্ধ করলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, করাচিতে থাকাকালীন হযরত বিননুরী রহ. আমাদের অনুরোধে কারী বাসেতকে দাওয়াত করেছিলেন। সেদিন কারী বাসেতের গা ঘেঁষে তেলাওয়াত শুনেছিলেন। আর তাছাড়া মঞ্চে বাসেত যখন তেলাওয়াতের সময় লম্বা টান দিতেন, তখন শ্বাস নেওয়ার জন্যে পুরো মঞ্চটা একটা চক্কর দিতেন। এগুলো আমার চোখে দেখা, হুজুর বলেন- আশরাফ! আমারে একটা ক্যাসেট দিয়ে দাও।

ক্যাসেট নিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলে আব্বা বললেন, হুজুর টাকা লাগবে না। এমনিতে দাম পঁচিশ ত্রিশ টাকা। তিনি আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন। সেই টাকা দিয়ে আমি একটা মাটির ব্যাংক কিনেছিলাম। বাকি টাকা আব্বা নিয়ে নিয়েছিলেন।

এরকম ঘটনা আর একটা বলি, তেমনি আরেক ঈদের দিন বিকেলে সব দোকানপাট বন্ধ। আমরা দোকানে বসে গজলের ক্যাসেট বাজাচ্ছিলাম। হঠাৎ তিনি রিকশায় থেকে নেমে দোকানে এসে বসলেন। আমি তখন জামিয়ায় নাজেরা পড়ি। শাহসাবকে দেখেই আমি পেছনে দু’তলার সিঁড়িতে উঠে যাই। খুব গরম ছিল। ঘামে সাদাপাঞ্জাবী ভিজে একাকার।

পান খাবেন, হুজুর ডাকলেন। আব্বাও ডাকলেন আশিক বলে! অগত্যা বের হয়ে আসার পর আমার ঘামেভেজা শরীর দেখে আব্বাকে বললেন, কী হইছে এর? হুজুর! আপনারে ভয় পায়। তিনি তখন বলেছিলেন, আমি বাঘ না ভাল্লুক? যাও, আবদুল আলীর দোকান থেকে আমার কথা কয়া পান আনো। বলে পাঁচটি টাকার একটা নোট দিলেন। দুই টাকা দিয়ে পান এনে অবশিষ্ট তিনটাকা ফেরত দিলে তিনি আমাকে দশটাকা দিয়েছিলেন।

এরপর জামিয়া ছেড়ে তারাপাশা ভর্তি হয়েছিলাম। তবুও প্রায় বিকেলে শাহ সাবের জন্য পান আনতে হয়েছে আমার। রশিদ সাব হুজুর অথবা জুবায়ের ভাই ডেকে বলতেন, হুজুরের লাইগা পান নিয়াও। তখন আমি জামিয়া থেকে চলে গেছি জানতে পেরে বলেছিলেন, সাততলা করতেছি এটা তোর পোষাইলনা, টিনের মাদরাসাত গেছোস?

আমার সেদিনের এইকথার কোনো উত্তর ছিল না। আমি হুজুরের ঘোরবিরোধী ছিলাম। হুজুরের বিরোধীরাই আমাকে হুজুরের কাছে যেতে বাধ্য করেছে। অকথ্য ভাষায় হুজুরের সমালোচনা করতো আমাদের দোকানে বসে। স্বাভাবিক ব্যাপার, আমাদের দোকনটা ছিল বিরোধীদের আখড়া। অনেক কিছু জেনেছি আমিও। কিন্তু তবুও শহিদি মসজিদে শাহসাব ছাড়া আমি জুমুআ এবং ঈদের নামাজ অন্যকোথাও পড়িনি।

দূর থেকে আগত মেহমানরা এটা শুনে অবাকই হতেন যে, শোলাকিয়ার পাশে থেকে জন্মের পর সেখানে নামাজ পড়িনি। শতো বিরোধীদের মাঝে থেকেও শাহসাবের প্রতি ছিলাম দূর্বল। তিনি আমার কাছে বিস্ময় ছিলেন। তিনি তার মতো সমস্ত কাজ করে গেছেন। কারও কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি। কর্ণপাত করা এটা যেন তার শানের খেলাফ ছিল। তাঁর নামে কবিতা গানে আরও কতো রকম, কতোরকম। তবুও আমি শাহসাবকে আলাদা করে রেখেছিলাম। একজন আদর্শ পিতার খুব যোগ্য সন্তান হিসেবে।

এরপরের গল্পটা এরকম, ২০১৮ এর ডিসেম্বররের ১৬ তারিখ বিকেল বেলা দুই হাতভর্তি বই নিয়ে হুজুরের বাসায় গেলাম। তিনি নামাজঘর থেকে বের হচ্ছেন তখন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির ওপর লুঙ্গি। পেছন পেছন বাসার দরজা পর্যন্ত গেলাম। তিনি রুমে ঢুকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, হুম! কি ব্যাপার?

কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম, হুজুর আমার কিছু বিষয় জানার ছিল। কী ব্যাপারে? তখন আমি বললাম, ভেতরে গিয়ে বলি! তিনি বোধহয় খানিকটা লজ্জা পেলেন। গেট ছেড়ে ভেতরে সোফায় পা তুলে বসলেন। আগের থেকে মার্ক করা বেশকিছু বইয়ের অংশ হুজুরকে পড়ে শোনালাম। শেষে বললাম, আপনার বাবার ব্যাপারে অনেক গসিপ শোনা যায়। এই বইগুলোর মধ্যে খুব নোংরাভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তিনি মারাত্মকভাবে খেপে গেলেন। সে ভাবটা মুখেও ফুঁটে উঠলো। উঠে চলে গেলেন ভেতরে। পান মুখে দিয়ে হাতে পিকদানী নিয়ে আবার সামনে এসে বসলেন। অতঃপর তিনি বিস্তারিত বলতে লাগলেন!... আমি তাজ্জব হয়ে শুনছিলাম। অনেক নতুন তথ্য পেলাম।

আমি নিবেদন করলাম, আমি মাওলানা আতহার আলি রহ. কে নিয়ে কিছু লিখতে চাই। যদিও আমার কোনো যোগ্যতা নেই। জীবনে কোনো বই লেখিনি। তবে পড়েছি প্রচুর। আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন? তাহলে একটু সাহস করতে পারি। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি আবার নতুন করে বলতে লাগলাম, আমি আপনাকে প্রচ ভয় পাই। আপনাকে রাস্তা দিয়ে রিকশায় দেখলে দৌড়ে আড়ালে চলে যাই সবসময়। তবে আজকে সাহস করে এসে গেলাম। আমি আমার পরিচয়, কি করি দিতে চাইলাম। তিনি তার আগেই সব বলে দিলেন, আমি তোমাকে ভালো মতনই চিনি। খানিকটা প্রশ্রয় পেয়ে কবে থেকে আসতে শুরু করবো বললে, তিনি দুইদিন পর মাদরাসা বন্ধ হবে তখন থেকে আসার অনুমতি দিলেন।

মনে আছে, দুদিন পর কলিংবেল বাজার খানিকটা পরে তিনি এসে গ্লাসের দরজা সরিয়ে বললেন, আশিক! আসো আসো। তিনি আরাম করে সোফায় বসলেন। আমি টাইলসের উপর আমার কাগজপত্র, রেকর্ডার রেখে নিচে বসে গেলাম। হুজুর খুব চেষ্টা করলেন তাঁর সামনে রাখা সোফায় বসতে। কিন্তু আমি কিছুতেই বসতে রাজি না দেখে তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। সেদিন সারাদিন এবং সন্ধার পর থেকে ইশা পর্যন্ত রেকর্ড করলাম। বুঝা যাচ্ছে, তিনি প্রথম দিন থেকেই আমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। একটু ভালোভাবে বললে, তিনি আমাকে পছন্দও করেছিলেন।

অবাক ব্যাপার! দ্বিতীয় দিন হুজুরের বাসায় গেলাম। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বললো। রুমে নতুন জাজিম বিছানো হয়েছে। টকটকে লাল। হাত দিয়ে ধরে বুঝলাম বেশ দামি। খানিকবাদে শাহসাব হুজুর একহাতে লুঙ্গি ধরে রেখে অন্যহাতে পিকদান নিয়ে সোফায় এসে বসলেন। বসেই বললেন, “তুমি তো সোফায় বসতে চাও না। তাই তোমার জন্যে এটার ব্যবস্থা করলাম।”

এটা শোনার পর হুজুরের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথাটা নুইয়ে এসেছিল। আমি কে? আমি কেউ না। তবুও তিনি আমাকে তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে দেখভাল করেছেন। তারপর থেকে একাধারে কথা বলতেই থাকলাম। বিভিন্ন বিষয়কে সামনে এনে অসংখ্যবার তর্কে জড়িয়েছি। কখনোই রেগে যাননি। আমার কোনো প্রশ্ন এড়িয়ে না গিয়ে তিনি উপস্থিত সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য জবাব দিয়ে আমাকে তৃপ্ত করেছেন। আকার ইঙ্গিতে যদি কিছু একটা বুঝাতে চেষ্টা করতাম, সেটা আমাকে মুখ দিয়ে বলতে হয়নি। তিনি বুঝে ফেলতেন। তাঁর সেন্স অব হিউমার ছিল মারাত্মক লেভেলের। জামিয়ার খুব পুরনো কাগজপত্র দেখতে চাইলেও তিনি কখনো না করেননি। দেখিয়েছেন সানন্দে।

মাদরাসা বন্ধের সময়টার সুযোগ আমি নিয়েছিলাম খুব করে। আমার এক বন্ধু বদরুল মুমেন শাকিলসহ হুজুর মসজিদের দ্বিতলের বাবা মায়ের পুরনো স্মৃতিঘর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়েছিলেন। কোথায় তিনি খেলাধুলা করতেন। রুমের কোনপাশে মাওলানা আতহার আলী রহ.সহ তিনি ঘুমাতেন। কোথায় বসে মাওলানা আতহার আলী রহ. লেখালেখি করতেন। সবকিছু, সবকিছু। যখন কোনো প্রয়োজনে আমি ঢাকায় অথবা দূরে কোথাও গিয়েছি। তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। ফোন দিয়ে বলতেন, তোমার কাজ আর কতোদূর? কবে শেষ করবা? আমি থাকতে থাকতে করে ফেলো। হায়াত তো শেষ! আর তুমিও শেষ সময়ে আসলা। আর আমিও তোমারে দেখে আর না করতে পারলাম না।

কোনো একদিন মাগরিবের নামাজ শেষে হুজুরের পেছনে বসে আছি। তিনি নামাজ শেষে কিছুক্ষণ মালফুজাত পড়তেন নিয়মিত। চেয়ার থেকে উঠে পেছন ফিরে আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন, আরে! এইতো মাত্রই আমি তোমার কথা ভাবতেছিলাম। কই হারায়া গেছো? কাজ কদ্দুর? তিনি নিয়মিত তাগদা দিতেন দ্রুত শেষ করার জন্য। আমিও সেদিনের পর থেকে আর একটা দিনও রাতের বেলা ঘুমাইনি। দিন ছোট। কাজ করে বরকত পাওয়া যাচ্ছিলো না। তাই দীর্ঘ রাত জেগেই কাজ করতাম।

আবার সকালেই নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হতাম। চোখ লাল টকটকে দেখে তিনি বলতেন, রাতে ঘুমাও না নাকি? আমি বলেছিলাম, না। নিয়মিত রাতজাগি। খুব ঘুম পেলে হরতকি মুখে নিয়ে রাখি। তখন প্রচন্ড তিতার কারণে ঘুম আসে না চোখে। তখন তিনি বলেছিলেন, যাক! তোমাকে জাজাকাল্লাহ। আমি দোয়া করছি তোমার জন্য। আল্লাহই বরকত দেবে। বিকেলে আমার জন্যও দুটো হরতকি আইনো তো।

হ্যাঁ! আমি হুজুরের ব্যাংকক যাওয়ার পাঁচ মাস আগেই আমার দুটো বইয়ের কাজ টোটাল শেষ করেছি। হুজুরকে অনুরোধ করলাম প্রুফ দেখার জন্য। তিনি বলেছিলেন, আমার উপর জুলুম কইরো না। আমার অবস্থা ভালো না। তুমি পড়ে শোনাইও আমি শুনে যাবো, আর সমস্যা থাকলে আমার সামনে বসেই ঠিক করে নিবা। এর আরও দুদিন পর হুজুরের সামনে ৫০০ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি নিয়ে হাজির হলাম। হুজুরের সুবিধার্থে পঞ্চাশ পেজ করে স্টেপলার করে নিয়েছিলাম। হুজুর এতোমোটা পান্ডুলিপি দেখে হতবাক! এগুলো আমার বলা কথা? আশ্চর্য! এতোকথা তুমি আমারে দিয়া বলাইছো এই শেষ সময়ে! জাযাকাল্লাহ! জাযাকাল্লাহ!!

হুজুরের হাতে পঞ্চাশ পৃষ্ঠা করে ভাগ করে রাখা পান্ডুলিপি থেকে একটা উঠিয়ে দিলাম। তিনি আবেগে বললেন, নাহ! সবটাই দেও। তিনি পায়ের উপর পা তুলে একপৃষ্ঠা করে করে উল্টিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে হাসছেন। দীর্ঘ দেড়ঘন্টা আমি চুপচাপ বসেছিলাম। কোনো কথা বলিনি। অবশেষে তিনি বললেন, তুমিতো সবকিছু হুবহু উঠায় রাখছো। কোন কিছু বাদ দেওনাই। সামনে মাদরাসা বন্ধ এই সময়টাই দেখতে থাকি।

হ্যাঁ! তিনি নিজ হাতে কাটাকাটি করে কারেকশন করেছেন। আর মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে বলতেন, তুমি আমারে কি কাম দিলা এই শেষ বয়সে। আমিতো শেষ। বসে থাকতে থাকতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়ে যায়। এখন মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়ে দেখি। বিবিসাহেবা তো হাসাহাসি করে। শেষ বয়সে আবার লেখাপড়া শুরু করেছি কিনা!! শোনো, লেখা মিসিং আছে অনেক(ফন্ট ভাঙ্গা)। এগুলো ঠিক করতে হবে। সবশেষে তিনি পরিপূর্ণভাবে বই দুটোর পান্ডুলিপি পড়েছেন এবং প্রুফ দেখেছেন।

মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর জীবন সম্পর্কিত বইয়ের প্রতি তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। তিনি খুব করুণভাবেই চাইতেন, যেনো সত্যি ইতিহাসটা কেউ একজন উঠিয়ে আনেন। আমি চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্তু আমার পিঠে একটা হাত সর্বদায় রাখা থাকতো। খুব ভারী একটা হাত। যেটার ওজন পাহাড়সম। আমি চেষ্টা করেছি সেই হাত দিয়ে কিছু লেখিয়ে নিতে। আমি পেরেছি। তিনি দোয়া করেছেন।

রঙবেরঙের পাঞ্জাবি পড়েই যেতাম হুজুরের কাছে। একটু নিজেকে ঘুঁছিয়ে, যে পোশাক ভদ্রলোকরা পরে সেগুলো পরে মাথা সিঁথি তুলে যাইনি। একদিন তিনি বলেছিলেনও। এই যে তুমি আমার কাছে একদম ফর্মালভাবে আসো। যেভাবে রাস্তাঘাটে দেখি ঠিক সেভাবেই। এটা আমার ভালো লাগে। তোমাকে ভালো লাগার অন্যতম কারণের মধ্যে এটা একটা যে, তুমি আমার কাছে ছদ্মবেশে আসোনি। সেটা আমি দেখেই টের পেয়েছি। যার কারণে আমার ভেতর উজাড় করে তোমাকে সবকিছু বলে গেলাম। আমার চারপাশে ছদ্মবেশী মানুষের ছড়াছড়ি।

চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যাওয়ার আগে তিনি ঘাড়ে একটা টিউমারের অপারেশন করিয়েছিলেন। নামাজ ঘরের ইমাম নাঈমকে সামনে রেখেই পাঞ্জাবীর বোতাম খুলে ক্ষত দেখালেন। বললেন, হাত দিয়ে দেখো এই জায়গা কেমন থেতলে গেছে। খুব ঠান্ডা গায়ে অগণিত বার হাত বুলিয়ে দিয়েছি।

তিনি সবসময় বলতেন, আর বোধহয় বেশি হায়াত নাই। যা নেওয়ার তুমি তাড়াতাড়ি নিয়ে নাও। পরে আমারে আর পাইবা না। আমি না থাকলে তোমারে আর কেউ এই ইতিহাস শুনাইতেও পারতো না। মাইক্রোফোন লাগানোর সময় গেঞ্জিতে ধরলে আমার হাতে হুজুরের শরীরের দলাপাকানো চামড়া এসে যেতো। তখন আমার কি যে কষ্ট হতো। আহ!

একদিন তিনি পপুলারে নাক, কান, গলার ডাক্তার দেখানোর জন্যে গেলেন। আমার সেদিন বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর কাঠের জানালা পড়ে পুরো নখ ভেঙে যায়। হুজুরকে জানানোর জন্যে বললাম, আমিতো শেষ! হাঁটতে পারছি না হুজুর। তিনি অস্থির হয়ে বললেন, কি হয়েছে?

ঘটনা শুনে বললেন, তুমি একদমই হাঁটতে পারো না? এখন তো তোমারে আমার দেখতে আমার আসা লাগে। আমিও রোগী। আমি প্রবল আপত্তি জানিয়ে বললাম, না না! হুজুর আমিই রিকশা নিয়ে আসছি আপনার বাসায়। আমি পা টেনে টেনে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি খুব ব্যথিত হলেন এই ব্যাপারটাই।

নিজেই গেট খুলে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি পা লম্বা করে বসে রইলাম। তিনি আঙুলে হাত চেপে ধরে কিছু একটা পড়তে থাকলেন। একটু আওয়াজ করেই। হুজুর ধরাতে অস্বস্তি হচ্ছিলো এবং খানিকটা ব্যাথাও পাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। তিনি বললেন, পুরো নখটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বললাম, উঠবে না আর?

তিনি বললেন, উঠবে। দুই তিনমাস সময় লাগবে বোধহয়। ততোদিন আমি বেঁচে থাকি কিনা দেখো। এখন তোমার অসুস্থতা আমাকে টেনশন দিচ্ছে। হুজুরকে আমি আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, নাহ! ব্যাথা তো পায়ে। ভাগ্যিস হাতের কিছু হয়নি। আপনার প্রুপের কাটাকাটিগুলিতো আমি হাত দিয়ে কম্পিউটারে এডিট করবো। বরং এটা ভালোই হলো যে, আমি হাঁটতে পারছি না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে বসে থেকে কাজ দ্রæত শেষ করবো।

আঙুলের নখটা প্রায় উঠেই গেছে। অল্প একটু বাকি। সেটাও কম সময়ে উঠে যাবে। আমি হুজুরের স্পর্শ নিয়ে বেড়ে উঠা নতুন নখ নিয়ে হেঁটে বেড়াবো জমিনের বুকে। কিন্তু আজকে তিনি নেই। তিনি বেঁচে নেই। তিনি কোথায়? আছেন, দূরে কোথাও। এইতো চলে আসবেন। অবশ্যই তিনি আসবেন। কারণ, তারসঙ্গে আমার আরও অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে। কতোরকমের গল্প সেগুলো।

হুজুরের অতি আদরের ভাই, মৌলবি আশরাফ আলী সাহেবকে ধরে যখন হুজুরের লাশ দেখাতে নিয়ে গেলাম। তিনি খুব কাঁদলেন। আমার মনে হচ্ছিলো তিনি তাঁর ভাইকে কিছু একটা বলতে চান। বলতে পারেন নি। আমি বেশকিছুক্ষণ লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম পর্দার ভেতরে। ঠিক চিনতে পারছিলাম না। এই শাহসাবকে তো আমি কল্পনায়ও ভাবিনি কোনদিন। শুধু তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে আমার কাঁধে একটা দায়িত্ব।

শুধুই দেখে যাওয়া। দেখলাম প্রাণভরে। যখনই লাশটাকে সবাই ধরাধরি করে উঠাতে চাইলো, তখন আমার ভেতর কেঁপে উঠলো। আমার সাইটে অন্য কেউ না থাকায় শাকের ভাই বললেন, এই ধরো! উঠাও!! তখন আমার ভেতর জেগে উঠলো। আরেহ! আমি একি করছি। শাহসাবকে তো নিয়ে যাচ্ছে। খুব জোরে চিৎকার করে করে শুধু বলতে লাগলাম, শাহসাব! শাহসাব! আমার শাহসাব!

মানুষ বাড়ছে। সরে আসলাম। ভুলে গেলাম তিনিই শাহসাব। মাদরাসায় এসে আবার লাশবাহী গাড়িতে শাহসাবকে দেখেছি। তেমন কোন ব্যাপার মাথায় কাজ করেনি। মনেই হয়নি এটা শাহ সাব। মন শুধু বলছিল, এটা একটা কর্মযজ্ঞ। এটা কাল পর্যন্ত স্থায়ী হবে। তারপর শেষ। কিন্তু শাহসাবের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? তিনি তো আছেন। তিনি মারা যেতেই পারেন না। অথচ তাঁর লাশ রাখা ছিল আমার সামনেই। কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!

জানাযায় স্টেজের আশপাশে ছিলাম সর্বক্ষণ। জানাযা শেষেই স্টেজে উঠে দাঁড়ালাম। মানুষ আর মানুষ! তাঁকে নিয়ে গেল দাফনের জন্য। আমি হেঁটে চলে আসি বাসায়। লাইফসাপোর্টে ঢুকানোর পর থেকে কিছুই খাইনি তেমন করে। মৃত্যুসংবাদ শোনার পর তো আর না-ই। শরীর মন বিধ্বস্ত। ক্লান্ত, অবসন্ন।

সন্ধায় শহরের শোকের ব্যানারগুলো দেখে দেখে শহরে হাঁটছি। বেশ কয়েকটা চক্কর দিলাম। শাহসাবকে নিয়ে সবার শোক আমাকে টানছে। ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। মানুষজনের কথা শুনলাম। অতঃপর? অতঃপর আমাকে শাহ সাবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এ সমস্ত কিছু তাকে জানাতে হবে না?

এতোকিছু হয়ে গেলো তাঁকে ঘিরে অথচ তিনি জানতেই পারবে না, এটা কেমন কথা? অস্থির হয়ে গেলাম শাহসাবের সঙ্গে কথা বলার জন্য। টের পেলাম ঠিক তখন থেকেই বুকের ভেতর একটা দম আটকে গেছে। যেটা শাহ সাবের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া বের হবে না। খুব কষ্ট দিচ্ছে আমাকে এটা। রাত গভীর হলে সেটা বেরিয়ে আসতে চায়। অবশেষে নির্যাতিত চোখ দিয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। রাত বাড়তে থাকে আর তার চেহারা স্পষ্ট হতে থাকে আমার কাছে। ফোনের গ্যালারিতে তো ঢুকতে পারি না। শতো শতো রেকর্ড, ভিডিও, পিকচারগুলো ভেসে উঠে। যেখানে আমার কণ্ঠটাও খুব স্পষ্ট।

একদিন পর গোরস্থানে গিয়েছি। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প চোখের পানি ফেলবো না। চাবি খুঁজে বের করে কবরের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। খালি পা বেয়ে একটা শীতল পরশ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। ইয়াসিন পড়ে হাত উঠালাম। কার জন্য দোয়া করবো?

যখন মাথায় এটা ঢুকে গেলো যে, এই মাটির নিচে শাহ সাব শুয়ে আছেন!... আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। নিজেকে আমি কতো শক্ত একজন মানুষ ভাবি। অথচ হুজুরের কবরে এসে কেমন বাচ্চাদের মতো কান্না করতে থাকলাম হেঁচকি দিয়ে। আমাকে আরেকজন ধরে রাখলো। বুক ভাসিয়ে আরও আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম একই অবস্থায়।

মাথায় ঢুকে গেছে হুজুর এখন মায়ের পাশে আছেন। তবে মৃত এটা আমি এখনও কল্পনায় আনতে পারি না। তবে ওখানে আছেন। রাতেও গেলাম এই ভেবে যে, যদি বুকে আটকে থাকা দমটা বেরিয়ে যায়! আগে মাথায় এটা ঢুকাতে হবে হুজুর মারা গেছেন। কিন্তু নাহ! কোনো কাজ হলো না। সত্যি বলতে কী, আনোয়ার শাহ সাবকে যে যতোটুকু চিনেছে; তাঁর ক্ষতের জায়গাটাও ঠিক ততটাই প্রশস্ত হয়ে আছে। এই ক্ষতের কোনো উপশম নেই।

সেখান থেকেই মনে হচ্ছে আম্মা হুজুরের সঙ্গে কথা বললে হয়তো দমটা বেরিয়ে যেতে পারে। দেখা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। একদিন আগে সন্ধার পর সাহস করে চলেই গেলাম, যা হয় হোক। বুক থেকে আটকে থাকা দম আমাকে বের করতে হবেই। কী ভাগ্য আমার! হুজুর যেখানে বলে গিয়েছিলেন যে, আমার বিবিসাহেবা এবং মেয়েদের সঙ্গে তোমাকে কথা বলিয়ে দেবোনে। আমিও খুব আগ্রহী ছিলাম। কারণ, হুজুর শুধু মেয়ে মেয়ে করতেন।

তাদের এটা জানাতে চাইছিলাম যে, হুজুর তাঁদের কতোটা ভালোবাসেন। শেষসময়ে হুজুর ছিলেন খুব নিঃসঙ্গ। তিনি খুব করে চাইতেন যে, মেয়েরা তার সঙ্গে এসে থাকুক। কিন্তু বলতেন না হয়তো কখনো। আমি বলেছিলাম তাদের বলতে। তিনি বলেছিলেন নাহ! এখন তাদেরও তো সংসার আছে। শুধু আমার দিকটাই তো দেখলে হবে না। এই মেয়েপাগল বাবাটাকে তাঁর সন্তানেরাও খুব ভালোবাসতেন বলেই বারবার তিনি তাদের কথা বলতেন। এমন মেয়ের জন্য গর্ববোধ করা যেতেই পারে।

আধাঘন্টার মতো হয়তো মা বেটিদের সঙ্গে পর্দার একপাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বক্তৃতার মতো কথা বলে গেলাম। কিন্তু কী বলেছি এখন আমিই মনে করতে পারি না। তবে খুব আক্ষেপ করেছি এটা ঠিক। কথার মাঝে খেয়াল করেছি ভেতরে আটকে থাকা দম বন্ধ ভাবটা কাটছে কিনা। নাহ! কাটছে না। বরং এটা আরও কুÐলি পাকিয়ে জেঁকে বসার চ’ড়ান্ত প্রস্ততি সম্পন্ন করেছে। আমি তৎক্ষণাৎ ক্ষমাপ্রার্থনা করে বের হয়ে আসলাম। আম্মা হুজুরের অনুরোধে ভাত খেয়ে আসতে হলো। কিসের খেয়েছি। নামকাওয়াস্ত তাঁর সান্ত¡নার জন্য কিছু মুখে দেওয়া।

আমার এখন খুব ইচ্ছে করছে, আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে। এমন জোরে যেনো প্রতি চিৎকারে শিরা উপশিরা ছিঁড়ে যায়। গলার রগ ছিঁড়ে সেই দমটা বের হয়ে যাক। বুকের উপর একটা আস্ত পাহাড় পড়ে আছে। কোনভাবেই সরাতে পারছি না। বড় অবেলায় তিনি চলে গেলেন। এই দায়িত্বের বোঝা আমি কিভাবে বহন করবো? ভারমুক্ত না হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তথ্যসূত্র: আপকামিং বুক ,১. দৃষ্টিকোণ : মুজাহিদে মাওলানা আতহার আলী রহমাতুল্লাহি আলায়হি
২. শাহনামা : খতিবুল উম্মাহ আল্লামা আযহার আলী আনোয়া শাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ