মুহিব খান ।।
আমার লেখালেখি শুরুর দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই। তাছাড়া লেখালেখিতে আসার কোনো উপলক্ষ, কারণ বা প্রেরণা, উল্লেখ করে বলার মতো আমার ছিল না। আমার লেখক হওয়াটা, আমি যেটা অনুভব করেছি, সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে একটা প্রতিভা বা যোগ্যতা আমি পেয়েছি। এবং এটা জন্মগত।
যেহেতু জন্মগত, কাজেই কৈশোরের যে বয়সে গিয়ে লেখালেখির মতো যোগ্যতা হয়েছে, ভাষাগত যোগ্যতা, লিখতে পারার মতো যোগ্যতা, সেই একান্ত কৈশোরেই আমি লিখতে শুরু করেছি।
পরিণত বয়সে, বুঝমান হয়ে, অন্যান্য লেখকদের চেনা, তাদের লেখা পড়ে লেখালেখিতে উদ্ধুদ্ধ হওয়া, আগ্রহী হওয়া, এমন গল্প আমার নেই। যখন থেকে আমি লিখতে পারি, তখন থেকেই আমি লিখতে শুরু করেছি। যখন থেকে চিন্তা করার বয়স হয়েছে, লেখার জন্য কিছু চিন্তা-গবেষণা করতে পারি, তখন থেকেই আমি লিখতে শুরু করেছি। আমার প্রাথমিক শিক্ষার সময়েই সেটা হয়েছে।
লেখালেখি একটা সাধনার বিষয় বটে, তবে আমার সাধনাটা কখনোই লেখার সাধনা ছিল না। আমার সাধনাটা ছিল চিন্তার সাধনা। ভাবনার সাধনা। আমি ভাবনার জগতে কাজ করি। চিন্তার জগতে কাজ করি। সাধনাটা আমার চিন্তায়। চিন্তা থেকে যখন কিছু তৈরি হয়, ভাবনা থেকে যখন কিছু উৎপন্ন হয়, সেটাই আমি আমার লেখায় প্রকাশ করার চেষ্টা করি।
লিখতে শেখার যে সাধনা, লেখার প্রকাশভঙ্গি, ভাষাগত জ্ঞান, লেখার স্টাইল, লেখার মাপজোখ, এগুলো শেখার জন্য আমার জীবনে কোনো ঘটনা নেই। কোনো উস্তাদ, কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ আমার কখনো নেয়া হয়নি।
লেখালেখির কোনো কৌশলও আমার শিখতে হয়নি। আমার ভাবনা-চিন্তার জায়গায় যখন আমি কিছু পেয়ে যাই, সেটা প্রকাশ করতে আমার কখনো কোনো সমস্যা হয় না। আমার লেখার জন্য আলাদা টেবিল, নির্দিষ্ট খাতা বা ডায়েরি, নির্ধারিত সময় বা নির্দিষ্ট কোনো আয়োজনও নেই।
যেকোনো সময়, যেকোনো ভাবনা আমার আসতে পারে, সেই ভাবনা থেকে একটা লেখা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আর কখন ভাবনা আসবে সেটা আমি আগে থেকেও জানি না। একটা লেখা যখন আমার ভেতরে তৈরি হয়ে যায়, সেটা লেখার জন্য আমি প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাই না। তাৎক্ষণিক কোথাও না কোথাও আমি সেই লেখাটা লিখে ফেলি এবং সেটাই হয় আমার ফাইনাল লেখা।
প্রতিদিনই লেখার জন্য কিছু সাধনা, প্রতিদিনই লেখার জন্য ভাবনা বা সপ্তাহে কিছু নিয়ম করে লেখা, মাসে নিয়ম করে কিছু লেখা, কিংবা কী কী নিয়ে ভবিষ্যতে লিখতে চাই- সেইরকম কোনো প্ল্যান-প্রোগ্রাম মাথায় সাজিয়ে রাখা, সেই মোতাবেক আমার লেখা এগিয়ে নেয়া বা কত দিনের মধ্যে, কত মাসের মধ্যে, কত বছরের মধ্যে আমি কোন লেখাটা শেষ করতে চাই, সেইসব ট্র্যাক সাজিয়ে নেয়া, এই কমন বিষয়গুলো আমার মধ্যে নেই।
আজ হয়তো কিছু লিখছি, কাল হয়তো কিছুই লিখবো না, দুদিন হয়তো খুব লিখছি আবার ছয় মাস হয়তো কিছুই লিখছি না। আবার হয়তো দুদিনে এক লাইন লিখেছি আবার কখনো দুই ঘণ্টায় আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছি। এসব আমার হাতে না।
লেখালেখিতে প্রথম উৎসাহটা পরিবার থেকেই পেয়েছি। আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন কেউ আমাকে নিরুৎসাহিত করেননি। তবে তারা কেউ আমাকে লিখতেও বলেননি। যখন দেখলেন, আমি লিখছি, আমি লিখলে লেখাটা হয়, তখন থেকেই তারা আমাকে লেখায় উৎসাহিত করেছেন। বলেছেন, তুমি লিখতে পারো মাশাআল্লাহ। লিখো, কাজটা ভালো।
যখন লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করলো তখন আমার লেখার পাঠকরা আমাকে উৎসাহিত করেছেন। তখন আমার প্রতিবেশী, আমার মহল্লাবাসী, গ্রামের লোকেরা আমার লেখা পড়েছেন এবং তারা আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আমার যারা শ্রোতা, আমার যারা পাঠক, যারা আমার কবিতা পড়েন, অন্যান্য লেখা পড়েন তারা আমাকে উৎসাহিত করেছেন।
আমার কবিতা, সঙ্গীত বা অন্যান্য লেখার যারা পর্যালোচক, বিশ্লেষক, বোদ্ধা, তারা আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আমার এ পর্যন্ত উঠে আসার পেছনে আল্লাহর একটা পরিকল্পনা আমি বুঝি।
এছাড়া, যদিও আমি এই পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে আসিনি, তবু আমার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা, কার্যে পরিণত করার পেছনে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা, উদ্যোগটাই ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে যারা আমার শিল্প-সাহিত্য, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে ছিলেন, আমার সাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারাই আমাকে উৎসাহিত করেছেন।
একটা ভালো লেখা লিখতে পারার পর যেই অনুভূতিটা হয় সেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নিজেকে খুব নির্ভার লাগে। একটি লেখা, যেটি শুধু চিন্তা থেকে নয় বরং হৃদয় থেকে সৃষ্টি হয় সেটি লিখে প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত একটি ভার নিজেকে প্রতিনিয়ত আচ্ছন্ন করে রাখে। এটা একপ্রকার মধুর যন্ত্রণার মতো। যে মধুর যন্ত্রণাটা সন্তান প্রসবের জন্য মায়েরা অনুভব করেন।
এই যে একটা ভার প্রায় দশ মাসের মতো মায়েরা বহন করেন, সেই সময় কিন্তু মায়েরা ব্যথিত হন না। ব্যথা পান, কিন্তু ব্যথিত হন না। যন্ত্রণায় ভোগেন, কিন্তু তারা বিরক্ত হন না। তারা জানেন, কিছু পাওয়ার জন্যই এই মধুর যন্ত্রণার সময়টা যাচ্ছে। একটা ভালো লেখা ভেতরে নিয়ে সময়টা কাটানো ঠিক এমনই। এরপর পৃথিবীকে ফুটফুটে সন্তান উপহার দেয়ার যে অনুভূতি হয় একটা লেখা লিখতে পারার পর একজন লেখকের ঠিক তেমন একটা অনুভূতিই হয়।
আমার প্রথম লেখাটা ছাপা হয়েছিল, কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রকাশিত লেখক সাহিত্যিকদের একটি পত্রিকায়। তখন আমি ফাইভে পড়ি। আর আমার দ্বিতীয় লেখাটি ছাপা হয়, জামিয়া এমদাদিয়া থেকে প্রকাশিত বার্ষিক স্মরণিকা আল কাউসারে।
এরপর জাতীয় পর্যায়ে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় আমার বয়স যখন তের। আর সেই লেখাটি ছিল একটি প্রবন্ধ। লেখাটির নাম যতদূর মনে পড়ে- ‘বিদেশের ষড়যন্ত্রে বিপন্ন বাংলাদেশ’। ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাবে।
আমার বড় ভাই মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী তখন ওখানে ছিলেন না। তখন তিনি সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে ছিলেন। তখন ইনকিলাবে আমার পরিচিত কেউ ছিল না। লেখাটি আমি ডাকযোগে ইনকিলাবে পাঠিয়েছিলাম এবং তারা সেটা উপসম্পাদকীয় পাতায় ছেপেছিল।
এরপর আরও কয়েকটি লেখা পরপর ইনকিলাবে ছাপা হয়েছে। কিন্তু ইনকিলাবের কেউই জানতেন না যে, কত বছর বয়সের একজন মানুষ লেখাটা লিখেছে। আমার পাঠকরাও সেটা জানতেন না।
প্রথম লেখা প্রকাশের অনুভূতি খুব আনন্দের। লেখা যখন প্রকাশিত হলো, ম্যাগাজিন হাতে এলো, বারবার লেখাটি দেখছিলাম। পড়ছিলাম। ঈদের নতুন জুতো জামার মতোই ব্যাপারটা। লেখাটা সবাইকে দেখালাম। একান্ত আপনজন যারা ছিলেন, তাদেরকে পড়তে দিলাম। তারা পড়ে খুশি হলেন। আমাকে দোয়া দিলেন, উৎসাহ দিলেন। সে এক আনন্দের অনুভূতি।
বই করার মতো লেখা ছাত্রজীবনেই আমার কাছে জমা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বইটি প্রকাশ করার জন্য বেছে নিয়েছিলাম ফারেগ হওয়ার পরবর্তী সময়টাকে। আমি ভেবেছিলাম, বইটি যদি ফারেগ হওয়ার পর প্রকাশ করি, তাহলে বইটির ওজন, গ্রহণযোগ্যতা, তাৎপর্য অনেকাংশেই বেড়ে যাবে।
ফারেগ হওয়ার পর ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম বই, কাব্যগ্রন্থ ‘লাল সাগরের ঢেউ’ প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত এ বইটি সর্বাধিক বিক্রীত, পঠিত, সমাদৃত। সে সময় তো বাংলাদেশে কবিতার পাঠক, বিশেষ করে আমাদের চিন্তাধারার মানুষজনের মধ্যে ছিলই না। সেই সময়টাতে ‘লাল সাগরের ঢেউ’এসে এমন একটা বিপ্লব সৃষ্টি করলো যে, আমাদের জগতেও কবিতার বিপুল পাঠক তৈরি হয়ে গেল।
বলা যায়, আমার বইটি বিরাটসংখ্যক পাঠক তৈরি করে নিলো। শুধু তাই না, তখন ছাত্র, উস্তাদ সবার ট্রাংকে, ব্যাগে, বাক্সে, সফরে আমার ‘লাল সাগরের ঢেউ’ বইটি থাকতো।
আর আমি কবিতা লিখতেই ভালোবাসি। প্রকৃত অর্থে, জন্মগতভাবে, আল্লাহর রহমতে আমি একজন কবি। কবিতা লিখতেই আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কাজেই আমার ভাব, চেতনা, উপলব্ধি কবিতায় যতটা সুন্দর করে, তৃপ্তির সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেভাবে আমার অন্যান্য লেখায়ও হয়ত ফুটিয়ে তুলতে পারি না।
কবিতাই আমার ভাষা, আমার বক্তব্য। আমার ভালোলাগা, আমার ভালোবাসা। যে কারণে কবিতা লেখার পর আমার তেমন কোনো সম্পাদনারও প্রয়োজন হয় না। আর্টিস্ট যেমন সর্বশেষ আঁচড় দেন, ফাইনাল টাচ দেন তেমনি আমার কবিতার ক্ষেত্রেও বড় কোনো সম্পাদনার প্রয়োজন হয় না, সামান্য আঁচড় দিই, ফিনিশিং দিই।
অনুলিখন : সায়ীদ উসমান
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘লেখকপত্র’ এর জানুয়ারি-মার্চ: ২০২০ সংখ্যার সৌজন্যে]
আরএম/